সুমনা সরকার:
শাড়ি পরলেই আমি টিপ পরি। কেন পরি সে প্রশ্ন কখনই মাথাতে আসেনি। আজ যখন টিপ নিয়ে দেশ ঠিক না ফেসবুক উত্তাল, তখন নিজেকে প্রশ্ন করলাম , কেন আমি টিপ পরি? বাঙ্গালী সংস্কৃতির জন্য না কি সৌন্দর্যের কারণে! সত্যি কথা বলি– সৌন্দর্যের জন্যই আমি টিপ পরি। এই টিপ যদি আমার মুখের আদলের সাথে না মানাতো, তবে আমি হয়তো এটাকে পরতাম না। টিপ যদি আমার সংস্কৃতির বা প্রতিবাদের ভাষা হতো তাহলে সকল পোশাকেই তো টিপ অনুষঙ্গ হতো আমার। আজ ফেসবুকে যাদের টিপ পরা ছবি দেখলাম তাদের সবাইকেই টিপে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছিলো। এদের সবাই যে সৌন্দর্যের জন্য পরে ঢালাও এমন মন্তব্য আমি করছি না। আমি এটাও জানি, ফেসবুকে টিপ পরে প্রতিবাদ জানানো নারীদের কেউ কেউ হয়তো প্রতিবাদস্বরূপ ভবিষ্যতেও টিপ পরবে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সংখ্যাটি কত এবং কতদিন তাঁরা এই প্রতিবাদ ধরে রাখতে পারবেন এবং আবার নতুন কোন ইস্যুর ভিড়ে হারিয়ে যাবে না তো?
৬০ এর দশকে টিপ এবং রবীন্দ্র চর্চা যে পাকিস্তানী আদর্শের সাথে ঠিক যায় না, এমন কথা পাকিস্তানী সামরিক সরকার আকারে ইঙ্গিতে প্রকাশ করেছিল। সেই সময় সনজীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হকরা টিপ এবং রবীন্দ্রনাথকে একই সমান্তরাল রেখায় রেখে ধারাবাহিক আন্দোলন– সংগ্রাম করে পাকিস্তানী রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে ছেড়েছিলো। পাকিস্তান রাষ্ট্র যে নিপীড়ক, সাম্প্রদায়িক এবং বিশেষ একটি শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী সেটি আন্দোলনকারীদের নিকট পরিস্কার ছিলো। আর সেজন্যই প্রতিবাদটি কোন ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে না হয়ে , হয়ে ছিলো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এখনকার মতো তখন রাষ্ট্র এবং মিডিয়া এতো শক্তিশালী ও ধুরন্ধর ছিলো না এবং মিডিয়া আর রাষ্ট্রের “দুটি পাখি, একটি নীড়ে” এমন অবস্থাও ছিল না। আর সেই কারণে রবীন্দ্রনাথ এবং টিপ মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক প্রধান উপাদান হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। ওই সময় আন্দোলনটি সমগ্র মধ্যবিত্তের অন্দোলন হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের রুচি তৈরিতে ওই আন্দোলন ব্যাপক ভূমিকা রাখে এবং এখনও রেখেই যাচ্ছে। ছায়ানট প্রতিষ্ঠা এবং বাংলা নববর্ষের শুরুতে রমনার বটমূলে উৎসব এর জ্বলন্ত উদাহরণ।
আজ মিডিয়া এবং রাষ্ট্র যুগপৎভাবে কোন আন্দোলনকেই নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির মধ্যে আটকে রাখতে দিচ্ছে না। একই শ্রেণির ভিতরে নানান গ্রুপ করছে এবং তাদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাসে প্যান্ট–শার্ট পরার কারণে তিরস্কার হওয়া নারী, জাতীয় পরিচয়পত্রে হিজাব না খুলে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির দাবি জানানো আর ঢাবিতে হিজাব পরার অধিকার চাওয়া নারী এবং টিপ পরা নারী, এরা সবাই কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারী। শুধু মধ্যবিত্ত না, তাঁরা সবাই উচ্চশিক্ষিতও বটে। কিন্তু একই শ্রেণিভুক্ত হলেও এরা পরস্পরের কাছে অচেনা এবং বিচ্ছিন্ন। মধ্যবিত্তেরও এখন প্রকারভেদ আছে, সংস্কৃতিগত বিভেদ আছে। এরা একে অপরকে তীব্রভাবে ঘৃণাও করে। কে মূলধারার, তাই নিয়ে নিত্যই ঝামেলা চলে।
অন্যদিকে পরস্পরের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড় করানোর কাজটি আমাদের মিডিয়াগুলো খুব দক্ষতা সাথে করছে। আমাদের মূলধারা মিডিয়াগুলোর এখন সামান্য লজ্জাবোধও নাই। রাজশাহীর গোদাগাড়িতে জমিতে সেচের জন্য পানি দিতে না পেরে দুই আদিবাসী কৃষক অভিনাথ মারান্ডি, রবি মারান্ডির বিষ পানের খবর, দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় দামের প্রতিবাদে বামজোটের হরতালের খবর বা সরকারের দমন–পীড়নের খবর ছাপে না বা প্রচার করে না। এই খবরগুলোর আপডেট জানতে আমাদের চোখ রাখতে হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিন্তু টিপ নিয়ে ঘটনা, হিজাব পরার অধিকার… ঠিকই মূল্ধারার মিডিয়ায় স্থান করে নেয়। লতা সমাদ্দার এখন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারীর কাছে একটি পরিচিত নাম। কিন্তু রবি মারান্ডি, অভিনাথ মারান্ডিকে আমরা চিনি না। কারণ টিপ এর ঘটনায় দর্শকপ্রিয়তা আছে, একশ্রেণিকে তোষামোদির বিষয় আছে, বিশেষ করে নারী প্রশ্নে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীই বলুন আর আওয়ামী লীগ, বিএনপিই বলুন, সবাই সমান তৎপর।
ষাটের দশকের মতো শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করার মতো আন্দোলন আর সম্ভব না কারণ, এ অঞ্চলে পুঁজিবাদ ষাটের দশকের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং সৃজনশীল। পুঁজিবাদ বিকশিত হওয়া মানে তার দুটি মুখ সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাও বিকশিত হওয়া। বিগত দশকে এ অঞ্চলের মানুষের ভিতরে সাম্প্রদায়িকতা রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। একই শ্রেণিতে এখন বহুধা বিভক্ত সমাজ। সমগ্র মধ্যবিত্তকে একইসূত্রে বেঁধে আন্দোলনে নামানো আরও অনেক কারণেই সম্ভব না। তবুও বার বার মনে হয় দিনে দিনে দেনা যদি বাড়তে না দিতাম, যদি যথাসময়ে কোন প্রতিবাদ করা যেতো, তবে হয়তো আজকে এই দিন দেখতেই হতো না আমাদের।
হেফাজতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক থেকে নির্দিষ্ট লেখকের লেখা বাদ দেয়া, ৫ টার ভিতরে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান শেষ করে ঘরে ঢুকে যাওয়া এবং সবশেষ টিপ নিয়ে যা কাণ্ড হলো এই তিনটি একোই সূতায় অনায়াসে গেঁথে বৃহৎ আন্দোলন করা যেতো বা আমি মনে করি, এখনও যায়। আমি কুমিরের খাঁজ কাটা , খাঁজ কাটা গল্পের মতো করে মার্ক্সের শ্রেণিতত্ত্ব আওড়িয়ে বলতে পারতাম যে, টিসিবির ট্রাকের পিছনে ছুটতে যাওয়া নারী ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি বা ড্রেসের সাথে মিলিয়ে টিপ দেয় না অতএব, এখানেই এর বিরতি টানিয়া দাও। আমি তা বলছি না কারণ, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক’ মানে, আমিও মধ্যবিত্ত নারী। মধ্যবিত্ত নারী, লতা সমাদ্দারের প্রজন্ম বলেই আমি ফেসবুকের ঝড়কেও সমর্থন করি, পাশাপাশি যারা মিডিয়া এবং রাষ্ট্রের সমালোচনা করে তাদেরকে বেশি ভালোবাসি।
সুমনা সরকার
গবেষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢা.বি।