নারীজন্মের জোয়াল টানি আমরা!

সুমনা শারমীন শম্পা:

সমস্যাটি টিপ নয়। সমস্যাটি লতা সমাদ্দারও নন। লতার জায়গায় সাবিনা ইয়াসমিন বা মেরি গোমেজ থাকলেও একই ব্যাপার ঘটতো, বিশ্বাস করুন। সমস্যাটি নিখাদ মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়ার।

সত্যিই তো, “তের হাত কাপড়ে যাদের কাছা হয় না”, কালো বোরখায় আপাদমস্তক ঢেকে চললেও যে পাপিয়সীরা ধর্মপ্রাণ পুরুষের দিলে তেঁতুলের মতো লালাক্ষরণ ঘটান, যাদের ছায়াতেও ধর্মভ্রষ্ট হতে হয়, যে সেবাদাসীর জন্মই পায়ের নিচে পিষে যেতে যেতেও প্রভুর গুণগান গাওয়ার জন্য- সেই কীটস্য কীট প্রাণিটি যদি হঠাৎ নিজের মর্জিমাফিক সেজে বা না সেজে, অন্যের চক্ষুর হেফাজতের তোয়াক্কা না করে কেবল নিজের ইচ্ছেরই তোয়াক্কা করে হঠাৎ বেরিয়ে পড়ে চার দেয়ালের ঘেরাটোপ থেকে, তাহলে তো সমস্যাই। আজ বাইরে বেরুবে, কপালে আঁকবে টিপ, ওড়না থাকবে মাথায়, গলায় বা এর বালাই-ই থাকবে না, বাইক চালানো বা বাসে ওঠার সুবিধার অজুহাতে পরে ফেলবে জিন্স; তাহলে কাল যদি সে অস্বীকার করে বসে, ‘তোকে আমি পুছি না! তখন?’ তার চেয়ে শুরুতেই শাবল মেরে ও বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলা ভালো।

টিপ পরসোস ক্যান? ওড়না কই? মাথায় ঘোমটা নাই কেন? মেয়েমানুষ সন্ধ্যার পরে রাস্তায় কী? স্বামী কই? একলা থাকিস? গায়ে একটু লাগলেই যদি জাত যায়, প্রাইভেট কারে গেলেই পারেন-সেই শাবলের একেকটি ঘা। লতা সমাদ্দার- বেচারি! একে তো মেয়ে মানুষ, তার উপর “হিন্দু”-পাপের কী শেষ আছে তার? পুরো সমাজ ধর্মের দাড়িপাল্লায়, জাত-বেজাত আর শালীনতার বাটখারায় চুলচেরা বিচার করবে তার। অবশ্য কবেই বা করে না? কেই বা রেহাই পায় এই মব ট্রায়াল থেকে?

গায়ে ওড়না না থাকলে ছেলেরা বলবে না কেন? মেয়েমানুষ ঘোরে প্যান্ট শার্টে; আরে নারীবাদী- দেখিস না টিপের বাহার? নারী আন্দোলনের কর্মী?-নিজের সংসার তো টেকাতে পারেনি, তাই হাতকাটা জামা পরে পুরুষ ধরতে এসেছে। ধর্ষণ কী আর এমনি এমনি হয়? এইসব ‘মেয়েমানুষের’ জন্যই হয়! সমাজটাই উচ্ছন্নে গেল এইসব ‘বারোভাতারি’ মাইয়াদের জন্য! এতো রাতে কোন ভদ্র ঘরের মেয়ে বাইরে থাকে? এসিড তো অন্যদের মারে নাই, ওরে মারছে, কারণ ওই মেয়ের চালচলনই ঠিক না।

মব ট্রায়ালে সবচে সহজে বিচার তো করা যায় মেয়েমানুষেরই। “মেয়ের চরিত্র ভালো না”- ব্যস, একবাক্যেই বিচার শেষ। আর এ বিচারে কখনই অপরাধী বলে প্রমাণ হয় না ধর্ষক, ইভ টিজার বা অত্যাচারী পুরুষ-যাই বলো, মেয়েটারও দোষ আছে। টিপ পরা-না পরা, হাতকাটা, ফুলস্লিভ, সালোয়ার কামিজ – শাড়ি, জিন্স – হিজাব, চাকরি করা- হাউজ ওয়াইফ, বাসে ঝোলা-প্রাইভেট কার থেকে নামা, সংসারী – ডিভোর্সি, হিন্দু- মুসলিম-খৃষ্টান- বৌদ্ধ, পাহাড়ি- বাঙালী – কারোর দোষই কম নয়।

মেয়েমানুষ -জন্মই তো তার আজন্ম পাপ। এ পাপখণ্ডনে শুধু তার তো নয়, আহুতি দেয়ার, মিছিলে পা মেলানোর দায় তো ছিল পাশের পুরুষ মানুষটিরও। আফসোস- পাশের বেশিরভাগ পুরুষের এখনও মানুষ হতে ঢের বাকি। সে পর্যন্ত তো এই পাপের জোয়াল টানতেই হবে- উপায় কী? তাই লতা সমাদ্দার- আসুন জন্মের জোয়াল টানি, নারীজন্মের পাপের জোয়াল- নিশ্চয়তা নেই, শুধু আশায় বুক বাঁধি- এর পরের প্রজন্মে ওরা নিজের জীবন পাবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.