সারওয়ার-ই আলম:
টিপ নিয়ে আজ নারীদের যে প্রতিবাদ, এই প্রতিবাদটা যতটা না নারীর তার চেয়ে অনেক বেশি পুরুষের হওয়া উচিত। কারণ এটা পুরুষদের সমস্যা, তাদের রুগ্ন মানসিকতার পরিচয়। এটা আমাদের স্থূল চিন্তার সীমাবদ্ধতা। আমাদের কূপমণ্ডূকতা।
বাংলাদেশের সমাজে আমরা পুরুষেরা নারীদের বশে রাখতে চাই। আচার-আচরণে, পোশাকে-আশাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাই। নারীর পায়ে অদৃশ্য শিকল পরিয়ে দিতে পারলেই আমাদের পুরুষত্বের সকল কৃতিত্ব অর্জিত হয় বলে বিশ্বাস করি। যে কারণে নারী টিপ পরলে আমাদের সমস্যা। হিজাব না পরলে আমাদের সমস্যা। পোশাকের ফাঁক দিয়ে নারীর পিঠ দেখা গেলে আমাদের সমস্যা। নারী মধ্যরাতে একা বাইরে গেলে আমাদের সমস্যা। নারীদের নিয়ে আমাদের শিক্ষিত-অশিক্ষিত পুরুষদের হাজারটা সমস্যা আছে। যুগ যুগ ধরে আমরা এই সমস্যায় আক্রান্ত। তাই সমস্যা থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য পুরুষদেরকেই উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। আমাদের অসুস্থ বিবেকের পচন ঠেকানোর দায়িত্ব তো নারীদের নয়, এটা আমাদেরই।
খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে পুরুষদের এই রুগ্ন মানসিকতার পেছনে ধর্মের একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যুগ যুগ ধরে ওয়াজ মাহফিলের নামে কিছু তথাকথিত আলেম নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষদের মনে বিষোদগার ছড়িয়ে চলেছেন। তাদের সকল আক্রমণের লক্ষ্য বস্তু হলো নারী।
আমাদের মনে পড়ে থাকবে প্রয়াত শফী হুজুরের কথা। তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন আলেম ছিলেন, যাঁর অনুসারীর সংখ্যা প্রায় কোটি ছাড়িয়ে গেছে। সমাজে এরকম মানুষের প্রভাব প্রবল। খোদ প্রধানমন্ত্রী তাকে সমীহ করতেন। অথচ নারীদেরকে নিয়ে গত পঞ্চাশ বছরের সবচেয়ে নিকৃষ্ট, সবচেয়ে জঘন্য বক্তব্যটি তাঁর কাছ থেকে আমরা শুনেছি। একবার ওয়াজ মাহফিলে তিনি বলেছেন, তেঁতুল দেখলে মানুষের যেমন জিভে জল আসে তেমনি নারীদেরকে দেখলে দিলের মইধ্যে লালা বাইর হয়।
মিলিয়ে দেখুন তো- গতকাল ঢাকায় পুলিশের যে সদস্য ‘টিপ পরছোস কেন’ বলে নারীকে উত্যক্ত করেছেন, তার সঙ্গে শফী হুজুরের চিন্তাগত কোন পার্থক্য আছে কিনা! উত্তর পরিস্কার। না, নেই।
এরকম পুলিশ সদস্য সমাজে একজন নয়, সংখ্যাতীত। শফি হুজুররা তাদের তৈরি করেছেন। ধর্মের নামে তাদের মজ্জায় পচন ধরিয়ে দিয়েছেন। আর এই পচন নিয়েই অসংখ্য পুরুষ ঘুরে বেড়াচ্ছেন আমাদের চারপাশে। তাই শুধু টিপ নিয়ে সংঘটিত ঘটনার প্রতিবাদ করলে চলবে না। আঘাত হানতে হবে এর মূলে। বন্ধ করতে হবে ওয়াজ মাহফিলে ধর্মের নামে নারীর বিরুদ্ধে বিষোদগার ছড়ানো। আইন করে বলে দিতে হবে ধর্মীয় অপব্যাখ্যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। তা না হলে ভয়াবহ এই রুগ্নতা থেকে পুরুষদের কোন রেহাই নেই। আর এই দাবী আমাদের পুরুষদেরকেই তুলতে হবে। কারণ সমস্যাটা আমাদের, নারীদের নয়। নারী এখানে আমাদের অসুস্থ, রুগ্ন, বাতিকগ্রস্ত, পশ্চাৎপদ বিবেকের নির্মম শিকার।