আজও প্রতিবাদ না করলে কবে করবেন?

আসমা অধরা:

যখন স্কুলে পড়তাম, আব্বুর নিষেধ ছিলো। একমাত্র কাজল দিতাম, সেটা রেগুলার। আম্মার হাতে তোলা, সর্ষের তেল আর তুলো পুড়িয়ে সে কাজল হতো, কাজলদানি ভরাই থেকেছে সবসময়। কখনও লিপস্টিক বা অন্য কোনকিছুই ব্যবহার করিনি। কিন্তু আম্মু ছোট্ট করে প্রায়ই টিপ দিয়ে দিতো, ওটা রেগুলার না। কিন্তু স্কুল ফাইনালের পর কাজল আর টিপ আমার প্রতিদিনের সঙ্গী হলো। লিপস্টিক তো বুড়ো হয়ে দিচ্ছি কয়েক বছর ধরে। কিন্তু এই টিপ সারাজীবন ধরে আছে, থাকবে। আমার সাজগোজ বলতেই কাজল আর টিপ বুঝেছি।

এখন কথা হলো, বাংলাদেশের শুরু থেকেই এটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ ছিলো। আমরা স্কুল কলেজে পড়ার সময় নিজেদের বন্ধু বা বাবা-মায়ের বন্ধু জেনেছি। হিন্দু নাকি খৃষ্টান নাকি বৌদ্ধ এসব জানিনাই। মায়ের হাতে যেমন খেয়েছি, মাসি বা পিসি বলে ডেকে তাদের হাতেও খেয়েছি। খুব বেশি বেয়াড়াপনা করতাম আমরা, মা যেমন বকেছে, সেই মাসি বা পিসীরাও শাসন করেছে। বকা বা কানে ধরানোর পর আবার কোলে বসিয়ে আদর যেমন করেছে, মুখে তুলে দিয়েছে পছন্দের খাবার। কই আমাদের ধর্ম পালনে তো সমস্যা হয়নি। মুসলমান তখন ও সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিলো এখনকার মতন। আমরা কেউ কাউকে ভয় পাইনি, কোন উৎসব বিঘ্নিত হয়নি, কিছু নষ্ট হয়নি, অসম্ভব শান্তি ছিলো।

ঠিক পাশের ফ্ল্যাটেই এক ক্রিশ্চিয়ান খালামনি ছিলেন, আম্মু অসুস্হ হলে উনি উনার বড় মেয়ে, আমার বান্ধবী সুইটির সাথে একসাথে গোসল, খাওয়ানো, দুপুরের ঘুম, এবং পড়তে বসানো সব করতেন। তেমনি আম্মুও তাই করতো। এমনকি আমার প্রথম মিন্সট্রুয়েশনের সময় আমি যখন ভয়ে বিকট চিৎকারে বাড়ী, পাড়া মাথায় তুলছি, তখন আম্মু না উনি আমাকে সামলেছেন, বুঝিয়েছেন, প্যাড পরা শিখিয়েছেন এবং আমাকে শান্ত রেখেছেন, বুকে নিয়ে কান্না থামিয়েছেন। এটা যে খুব স্বাভাবিক, ভয়ের কিছু না এই সমস্তই আমার মায়ের সাথে মায়ের মতন উনি আমাকে বুঝিয়েছেন।
বিভিন্ন পার্বনে স্পেশাল খাবারের আইটেম এমনকি জামাকাপড় পর্যন্ত আমি পেয়েছি ইনাদের কাছ থেকে। আমার ধর্ম, জাত, কুল, মান কিচ্ছুই যায়নি, তাদেরও না। বরং যে মায়া যে টান ছিলো, তাতে একজনের ঘরে আগুন লাগলে আরেকজন পালায়নি, ঝাঁপিয়ে পড়েছে সে আগুন নেভাতে।
এই কিছু বছরে আমাদের সমাজ, আমাদের বেঁচে থাকা বা যাপন এতো নষ্ট হয়েছে যে, আগুন নেভানো দূর অস্ত, আমরা পারলে জ্যান্ত মানুষকেই পুড়িয়ে ফেলি, আমরা সন্তানদের তুলে নিয়ে যাই, মেরে ফেলি, কার বাবা, কার মা, কার কী গেল কিচ্ছু মাথায় রাখি না। মাত্র কিছুদিন আগের আমার বাংলাদেশ আর এখনকার আমার বাংলাদেশ এক না। এর পেছনে আপনি বা আমি দায়ী যেহেতু, এই রোগ সারাতে আপনার আর আমারই চিকিৎসা দরকার। এই বৈষম্য থাকলে কতোদিন আপনি গা বাঁচিয়ে নিরাপদ থাকবেন সেটা না বোঝার মতন দুগ্ধপোষ্য কেউ নই।

ইট মারলে পাটকেল খাবার মতন, যত আপনি আগুন উস্কাবেন সে আগুনে আপনার ঘর পুড়বেই পুড়বে। যার যার ধর্ম সে সাবলীলভাবে নির্ভয়ে পালন করুক, যার যেমন পছন্দ সে তেমন চলুক না। সবার সে স্বাধীনতা আছে। তাতে কোরো কোন ক্ষতি নেই, বরং সেই হারিয়ে যাওয়া শান্তিই ফিরে পাবে সবাই। কে টিপ দিলো, কে হিজাব করেনি, কে জিনস পরেছে, কে নামাজ পড়তে যায়নি মেসে থেকেও, কার হাত থেকে অসুস্থ অবস্থায় কোরান শরীফ পড়ে গেছে, এইসব তো যার যারটা তাকে দেখতে দেন। জাহান্নামের আগুনে পুড়লে সে পুড়বে, আপনি দশজনের হুর আর গেলমানের চিন্তায় পাগল হইয়েন না প্লিজ! তার হুর লাগলে সে বুঝুক, তার গেলমান লাগলে সে বুঝুক। তার জান্নাত নিশ্চিত করার দায় বা ঠ্যাকা আপনার না।

শেষ নবী মুহাম্মদ(সাঃ) তার কাজ সুষ্ঠুভাবে করে গেছেন, কাজেই ইসলাম প্রচারের কাজ সম্পন্ন। না হলে এটাও কোনো না কোন নবীর আমল হতো। আপনাকে যেহেতু সে দায়িত্ব দেয়া হয়নি, আপনার নিজেকে সে পর্যায়ের ভাবার দরকার নাই। আপনি সবাইকে তার ধর্ম, তার আচার, তার পছন্দ মতন চলতে দ্যান আর নিজে আপনার ধর্মটাই সুন্দর ভাবে পালন করেন, যেখানে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা আছে, যা যা আপনারা করছেন আজকাল ধর্মের নামে সেটা আপনার ধর্ম না। দয়া করে বাজারি সদাই এর মতন ধর্মকে আর বেইচেন না।

আর এই দেশ সাম্যের, এই দেশ সম্প্রীতির, এই দেশ বাক স্বাধীনতার, এই দেশ গণতন্ত্রের, এই শব্দগুলো যেন রূপকথা হয়ে না যায়, তার দায়িত্ব তো আপনাকে বা আমাকেই নিতে হবে। নিজেকে নিজের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ভাবেন, আপনি কতোদিন এমন ধারায় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন!
দেশও নাহয় বাদ দিন, নিজেকে বাঁচান। জলজ্যান্ত একটা মানুষের খোলসে পশু হয়ে জীবনপাত করে দিয়েন না। একটা পশুও নিজের উপর আক্রমণ না এলে কামড় বা ছোবল দিতে যায় না।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.