দিনা ফেরদৌস:
“একা একা কিছু ভালো লাগে না ” দুইদিন পর পর এই গান গেয়ে যদি অতীত স্মৃতিতে ডুব দিতে হয় তো ডিভোর্স দেয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। যারা ডিভোর্স দেয়, তাদের আর কোন উপায় থাকে না বলেই দেয়। তা না হলে এতো পয়সা খরচ করে, এতো লোক খাইয়ে আনন্দ ফূর্তি করে বিয়ে করতো না। বিয়ে করে মানুষ সংসার জুড়তে, ভাঙতে নয়। তাই ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেবার আগে ভালো করে ভেবে দেখুন সমস্যাটা আসলে কোথায়, কেন দিচ্ছেন, এর পরে কী হবে, কেউ পাশে না থাকলে নিজে নিজের জন্যে কী করতে পারবেন! ভাববেন না, চাকরি আছে, তাই টাকার অভাব হবে না, অথবা বাচ্চাদের সমস্যা হবে না। চাকরি আছে সেটা প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু ডিভোর্সের পরে টাকার চেয়েও বেশি দরকার কাছের মানুষদের সাপোর্ট। তারপর নিজের আত্মবিশ্বাস, যা সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
ডিভোর্সের পর কেউ কেউ ভাবেন, তাড়াতাড়ি বিয়ে করে তাকে দেখিয়ে দেবো আমি কত দামি ছিলাম। আমার জন্যে পাত্রের অভাব নেই। এই দেখিয়ে দেবার মানসিকতা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে গেলেই ভুল হবার সম্ভাবনা বেশি। এই সময়ে সাহায্যের নাম করেও অনেক মানুষ কাছে ভিড়ে। যাদের সাথে মিশলে মনে হবে এই মানুষ আপনাকে অনেক বোঝে। আপনার বাচ্চা থাকলে দেখবেন, সেই লোক আপনার থেকে আপনার বাচ্চাদের দিকে বেশি যত্নবান। আপনি কোনকিছু চাওয়ার আগে সেই লোক আপনার প্রয়োজন বুঝে ফেলে। এইসব কিছু দেখেই যদি মুগ্ধ হয়ে যান, তো বুঝে নিয়েন ফাঁদে পা দিয়েছেন। কারণ এই দুনিয়ায় কেউ এমনি এমনি আপনার জন্যে কিছু করবে না।
এতো বছর সংসার করে যেখানে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি, সেখানে দুইদিনের গুরুত্ব পেয়ে এতো মুগ্ধ হওয়ার কিছু নেই। দূর থেকে সব ভালো, সব সুন্দর। লোকটা যদি বুঝতে পারে আপনি তার উপর মানসিকভাবে নির্ভরশীল, তখন আপনাকে শারীরিকভাবে চাইতে পারে, আর পাওয়া শেষ হলে ফেলেও যেতে পারে। অথবা সে চেয়েই যাবে, আপনিও দিয়ে যাবেন, কিন্তু সংসার আর হবে না। যদি বিয়ে করেও, হয়তো কিছুদিন পর যখন প্রেম কমে যাবে, তখন মনে হবে এটা আপনার দ্বিতীয় বিয়ে, এখন যদি আবার ছাড়াছাড়ি হয়, তো সমাজ আপনার দিকেই আঙ্গুল তুলবে। তখন আপনাকে তার কথামতো নাচালেও কিছু করার থাকবে না।
ডিভোর্স হবার কিছুদিন পর মনে হবে একা হয়ে বেশ ভালো আছেন। বছরখানেক এইভাবে কাটালে দেখবেন আপনি আসলে ভালো নেই। কারণ সংসারের অভ্যাস আপনাকে টানবে। প্রাক্তন স্বামীর দোষ নিয়ে যখন আলোচনা করবেন, বুঝতে হবে আপনি তাকে ফিল করছেন। মানে সে এই রকম না করলে, সংসারটি আজ থাকতো।
ডিভোর্স দেয়ার আগে নিজেকে এই সংসার থেকে মুক্ত করার একটা রাস্তা থাকে, কিন্তু সংসার থেকে বের হওয়ার পর যুদ্ধটা তখন আর একটা ঘরের বা সংসারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না , জগৎ সংসারে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ এই সমাজ একজন ডিভোর্সি নারীকে যেই চোখে দেখে, সেই তুলনায় ডিভোর্সি একজন পুরুষকে নিয়ে তার একভাগও ভাবে না। তাই ডিভোর্স একজন নারীর জীবন যতোটা ওলটপালট করে দেয়, একটা পুরুষের জীবনে তার প্রভাব তেমন পড়ে না। তারা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সংসারী হয়ে যান, সাথে থাকে পরিবারের সাপোর্ট।
সেইদিক থেকে ভাবলে নারীরাই বরং বেশি অসহায় হয়ে যান। পরিবার পরিজন থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধব পর্যন্ত কথা শোনায়। মানুষ উদাহরণ নিয়ে আসে, এর সংসারে আরো বেশি সমস্যা (মানে হচ্ছে, যতোই সমস্যা হোক আপনি সংসার চালিয়ে যাবেন), সে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে কষ্ট করে সংসার ছেড়ে যায়নি বলেই আজ ভালো আছে। কার সংসারে কে, কেমন আছে কেউই সঠিক বলতে পারে না। দূর থেকে সংসার করছে দেখলে মনে করা হয় সব ঠিকঠাক আছে। ফলে অনেক ডিভোর্সি নারীই কনফিউজড হয়ে যান এইসব কথাবার্তা শুনে। মনে করেন হয়তো তার নিজের ভুল ছিল। আরও একটু মানিয়ে নিলে আগামীতে হয়তো সব ঠিক হয়ে যেত।
তার কিছু কারণও আছে। একটা সংসার ভাঙার পর একটা পুরুষ চাইলে বাইরে ব্রথেল হোমে গিয়েও শারীরিক চাহিদা মেটাতে পারে, যার জন্যে সুব্যবস্থা আদিকাল থেকেই রাখা হয়েছে (সবাই যায় না, সবার যাবার দরকারও পড়ে না, তবে কেউই যদি না যায় তো যুগ যুগ ধরে এই ব্যবসা কারা টিকিয়ে রাখছে? )। কেউ যাক বা না যাক পুরুষদের জন্যে ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে, যা নারীদের জন্যে নেই। ফলে নারীদের হতাশা দ্বিগুণ তৈরি হয়। শারীরিক অতৃপ্তি মানসিকভাবেও যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যার প্রভাব কাজকর্ম থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজের অনেক কিছুতেই পড়ে। আর নিজে ভালো না থাকলে আশপাশকেও ভালো রাখা সম্ভব না। যদিও সংসারে খোঁজ নিলে দেখা যাবে দিনের পর দিন শারীরিক সম্পর্কহীন বহু স্বামী- স্ত্রী সংসার করছেন।
তাই আমি বলবো, ডিভোর্স দেয়ার ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন। ডিভোর্স দেয়ার আগে অনেকেই মনে করেন আগে এই নরক থেকে বের হতে হবে, কোন প্রস্তুতি থাকে না তখন। কারণ অনেক মেয়ে সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় শেষে লাশ হয়ে বের হয়েছেন/হচ্ছেন। সংসারে যখন মানাতে পারবেন না হাজার চেষ্টা করেও, তখন বাইরে যাবার পরে পুরো সমাজের সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হবে সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিন।
ঘরে-বাইরে কোথাও মেয়েদের জন্যে রাস্তা মসৃণ করে রাখা হয়নি। তাই মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আগান সামনে। আর ডিভোর্স দেবার পরে কী করেছেন সংসারের জন্যে, কী পাননি তা আসলে মানুষ শুনতে চায় না। “সে কেন আমায় বুঝলো না ” এই জাতীয় কথা বলে আপনি যখন অতীত কপচান, তখন যারা বহু চেষ্টার পরও সংসার করতে না পেরে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে , তারা আপনাদের এইসব মেসেজ দেখে বিভ্রান্ত হয়। ভয় পায় বেরিয়ে আসতে। মনে রাখবেন, আপনি ডিভোর্স দিয়ে একা হয়েছেন বলে সকলের চোখে পড়ে, এই সংসারে থেকেও বহু নারী একাই কাটাচ্ছেন।
তাই হুটহাট ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত রাখুন নিজেকে। এই সমাজ কোন কালেই নারী বান্ধব না। বাইরে- ঘরে, অফিসে, বাচ্চার স্কুলে সব জায়গায় আপনার ‘পতি বিনে গতি নাই’ বোঝাতে চেষ্টা করবেন সমাজপতিরা। আপনার কনফিউজড হওয়ার মতো বহু বিষয় আসবে সামনে। তখনই উচিত নিজের সিদ্ধান্তের উপর বিশ্বাস রাখা। ডিভোর্সের পর সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া ভাবাভাবির সুযোগ নেই। তাই ডিভোর্সের আগে মানসিক প্রস্তুতি রাখুন কী করবেন। নতুবা আরেকটু ভেবে সিদ্ধান্ত নিন।