নারী শিক্ষা ও একটি আলোকিত সমাজের স্বপ্ন

ইভনাত ভুঁইয়া:

নারী স্বাধীনতার ও আত্মনির্ভরশীলতার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বা উন্নয়নের বিবেচনায় বাংলাদেশ প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জনে এখনো পিছিয়ে। নারীর উন্নয়ন অনেকখানি সাধন হলেও এর সার্বিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত করে তোলার চিত্র অসম্পূর্ণ। জাতীয় সংসদে নারী আসন সংখ্যা ৫০ এ উন্নীত হবার জন্যে এ দেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৩৯ বছর। এই আসন ‘সংরক্ষিত নারী আসন’ নামে পরিচিত। এ দেশে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এখনো নারীদের দেখা হয় ‘অনগ্রসর জাতি’, ‘সংখ্যালঘু গোষ্ঠী’, ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী’ হিসেবে। একটি আলোকিত সমাজ বা রাষ্ট্র গঠনে নারী জাগরণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। যুগ যুগ ধরে নারীদের ‘অবলা উপেক্ষিত জাতি’র তকমা লাভ তথা নানান বৈষম্যের বেড়াজালে আবদ্ধ হওয়ার পেছনে বড় কারণ শিক্ষার আলোবিহীন জীবন কাটিয়ে দেয়া, অজ্ঞানতা, নিজেদের অধিকার সম্পর্কিত অজ্ঞতা।

একটি স্বনির্ভর জাতি বিনির্মাণে সে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। নারীদের আত্মনির্ভরশীলতার ক্ষেত্রটা গড়ে ওঠে তার আত্মবিশ্বাসের সুত্র ধরে। নারী আর আনাড়ী শব্দের সমার্থকতা প্রকট আকার ধারণ করে যখন নারীদের স্বকীয়তা, আত্মবিশ্বাস, আত্মশক্তি, আত্মউপলব্ধির জায়গাটা হয় নড়বড়ে। আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির অন্যতম নিয়ামক হল জ্ঞানান্বেষণ। পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঝর্ণারও আছে নিজস্ব গতিপথ; বলা হয়ে থাকে, সমাজ নারীদের ‘নিজের কোনো পথ থাকতে নেই’ নামক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আর্থিক অসচ্ছলতাকে নারী শিক্ষার প্রধান অন্তরায় বলা হলেও মূল জরাগ্রস্ত বস্তুটি হলো নারীদের চিন্তা চেতনায়, মস্তিষ্কে।

তবে এই বাধা যতটা না কথিত বা আরোপিত তার অনেকটাই স্ব-সৃষ্টও বটে। রেশমের গুটির মত নিজেদের গুটিয়ে-আটকে-বদ্ধ করে চিন্তাজগতের জানালা গুলোয় কপাট দিয়ে রাখা হয়। এই বলয় থেকে বের হবার উপায় নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানা। অধিকার মানুষকে জাগরণী শক্তিতে উজ্জীবিত করে তোলে। অধিকার নিয়ে অজ্ঞানতা এক সময় অধিকারহীনতার জন্ম দেয়। আইনশাস্ত্রে একটি বিখ্যাত তত্ত্ব রয়েছে, Ignorentia Juris Non Excusat, যার অর্থ হলো- আইন না জানা কোনো ব্যক্তি ঐ আইন লঙ্ঘনের দায় হতে অব্যাহতি পায়না। অর্থাৎ অজ্ঞানতা শাস্তির কারণ হতে পারে। ঠিক একইভাবে অজ্ঞানতা অধিকারের অপমৃত্যুও ঘটায়। অধিকার হলো সেই সঞ্জীবনী শক্তি যা ব্যক্তির মাঝে সজাগ চেতনার মালা গেঁথে দেয়।

অধিকার নিয়ে না জানা থাকলে অধিকার খর্ব হলেও তা টের পাওয়া মুশকিল। অধিকার খর্ব হবার বিষয়টিতে এক প্রকার প্রচ্ছন্ন অজ্ঞানতা বা অসচেতনতার বীজ লুকায়িত থাকে বোধ করি। মানুষ হিসেবে জন্মগত সুত্রে প্রাপ্য যা কিছু তা ধারণ করে চলাটা অধিকার। মানুষ হিসেবে আমার কিছু অধিকার আছে যা অবিচ্ছেদ্য এবং রাষ্ট্র আমাকে কিছু অধিকার দিয়েছে যা লঙ্ঘন করলে ন্যায়ালয় নামক একটি রাষ্ট্রীয় সংগঠন আছে তা বিচার করার দায়িত্বে- এই সামান্য তথ্যটি নেই এমন নাগরিক সংখ্যায় কম নয়, বিশেষত গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, বলা বাহুল্য নারীরা যারপনারই এ অজ্ঞানতার বৃহৎ অংশ।

এখানে প্রশ্ন আসে জানার এই আগ্রহ জন্ম নিবে কিভাবে, জানার ইচ্ছে তৈরি করতে হয়, যা উন্নত জাতি গড়তে ভুমিকা রাখে। নারীরা এই ‘জানার ইচ্ছে’ ব্যাপারটা থেকে শৈশব হতেই বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে। নারীশিক্ষার একটা মূলোৎপাটন চলে গ্রামাঞ্চল গুলোয় যেখানে শিক্ষার আলো পৌঁছনোর পথটা অতটা মসৃণ নয়। গ্রামীণ নারীদের ক্ষেত্রে একবিংশ শতাব্দীতেও অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্তিলাভের পথটা সুগম নয়, কুসংস্কার-ধর্মীয় গোঁড়ামি-বৈষম্য-বঞ্চনার ফাঁক গলে শিক্ষার দ্যুতি তাদের চার দেয়ালের গণ্ডি ভেদ করতে পারেনা পুরোপুরি। এই যে মানসিকতার বা চিন্তার অপরিপক্কতা তা আসে অজ্ঞানতা হতে। এই জ্ঞানহীনতা দূর করার একমাত্র মোক্ষম হাতিয়ার হলো শিক্ষা। অন্ধকে চক্ষূ দানে দৃষ্টি ফেরানোর মতন শিক্ষা জ্ঞানান্ধ ব্যক্তির ‘চিন্তার চোখ’ খুলে দেয়, ‘নতুন দৃষ্টিদান করে, অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে নিয়ে আসে আলোময় জগতে, জ্ঞানের ও উন্নত চিন্তার জগতে। শিক্ষার অভাব একটি রাষ্ট্রীয় সমস্যা আর নারী শিক্ষার অপ্রতুলতা জাতীয় দুর্যোগ এর ন্যায়।

নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে আমরা বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ করে যে বিমলানন্দ উপভোগ করি সেটা যে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতই ক্ষতিকর তা আমরা সজ্ঞানে অস্বীকার করে চলি। বাংলাদেশ নারী শিক্ষার প্রসারে অন্যতম বড় বাধা হলো সমাজের একটি বড় অংশ এখনো স্ত্রীশিক্ষায় বিশ্বাসী নয়। অথচ শিক্ষিত নারীই পারে শিক্ষিত জাতি প্রতিষ্ঠা করতে কেননা সন্তান তার পিতার চেয়ে তার মায়ের সান্নিধ্যে থাকে বেশি এবং মায়ের চিন্তা চেতনা, জীবন দর্শন, বিশ্বাস এর একটা বিশাল প্রভাব পড়ে সন্তানের জীবন সম্পর্কিত ধারণায়। তাই নারী শিক্ষাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে বাস্তবায়িত করা উচিত।

পৃথিবীতে এমন কোনো স্বাধীন দেশ হয়তো নেই যে দেশের সংবিধানে শিক্ষার সমানাধিকারের কথ উল্লেখ নেই, কেননা সংবিধান একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৭ক অনুচ্ছেদে থাকা ‘বালক-বালিকা’ শব্দগুচ্ছো যেন শিক্ষার সমতার ‘বিজয়তীলক’ এঁকে দেয়। এর মানে, শিক্ষার অধিকার নামক এ মানবাধিকারকে সাংবিধানিক, মৌলিক নাগরিক অধিকারের স্থান দেয়ার মাঝে এক প্রকার সমতার নির্যাস কিংবা সাম্যের দর্শন রয়েছে। কেননা সংবিধান-প্রণেতাগণ জানেন শুধু এক লিঙ্গের বা জাতির জন্য এ অধিকার সীমিত রাখা হলে তা রাষ্ট্র নামক সংগঠন এর বিকাশ ও অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়। দাড়িপাল্লার দুটো দিক অসমান হলে যেমন ভুল পরিমাপ আসে, নারী ও পুরুষ যে কোনো এক জনগোষ্ঠীকে অধিক বা কম সুযোগ দেয়ার প্রবণতাও একটি দিকহারা রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে এহেন বৈষম্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। শিক্ষার অধিকারকে এই যে রাষ্ট্রীয় মানবাধিকারের স্বীকৃতি দেয়া এটিকে রাষ্ট্রীয় অধিকারের মর্যাদা দেয়ার মানে দাঁড়ায়, রাষ্ট্র নারী ও পুরুষ কে একই দৃষ্টি তে দেখে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের সময় সরকার সেই মোতাবেক তার রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা ও আদর্শ সমূহ জনগণের নিকট উপস্থাপন করে। অর্থাৎ শিক্ষার অধিকারকে নিশ্চিত করার দ্বারা জাতিগত উন্নয়নের রাস্তা প্রশস্থ হয়। নারী শিক্ষার গুরুত্ব কে খাটো করে দেখার তাই কোনো সুযোগ নেই।

নারী শিক্ষা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সমাজে নারীদের উপর ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক মাত্রার নির্যাতন, বৈষম্য, অপরাধমুলক কর্মকাণ্ড হ্রাসে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাবে রাখা যাবে। শিক্ষার সকল স্তরে- প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়- এমনকি উচ্চশিক্ষায় নারী পদাঙ্ক সুনিশ্চিত করা গেলে নারীরা জাতীয় পর্যায়ে আর বড় অবদান রাখতে সক্ষম হবে। তাই একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি তথা নারী সমাজ গড়ে তুলতে নারীদের শিক্ষার সুযোগ, পরিধি এবং শিক্ষার পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি এ ব্যাপারে যথেষ্ট জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার দরকার।

লেখিকা: ইভনাত ভুঁইয়া, রিসার্চ এসোসিয়েট, রেডলিফ পাব্লিশিং, ঢাকা।

শেয়ার করুন: