বেগুনি রঙকে ব্যঙ্গ নয়, আমরা বরং সমতার কথা বলি

সালমা লুনা:

নারী দিবসে বহুল প্রচলিত কিছু অপক্কবুদ্ধি বক্তব্য দেখা যায়, একটি দিন কেন নারী দিবস পালিত হয়, এই দিবস পালন করে কী হয় ইত্যাদি সম্পর্কে না জেনেই কিছু অর্বাচীন নারী দিবস নিয়ে হাস্যরস করে থাকে।
যারা এইজাতীয় আচরণ করেন তারা জানেন না কিংবা মানেন না একই কর্মক্ষেত্রে কাজ করা দুজন মানুষের মজুরি একজনের ৫০০ হলে আরেকজনের ৩০০। কাজ একই, কর্মঘণ্টাও এক।
দুজনই একই রক্তমাংসের মানুষ।
কেবল লিঙ্গ বিচারে মজুরির এই বৈষম্য।
নারীকে মজুরি কম দেয়া যায় বলে দ্রুত কাজের জন্য অধিক নারী শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে একদিকে যেমন কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে অন্যদেশের তুলনায় মজুরিবৈষম্য কমে যাওয়ার সূচকে গড়গড় করে উঠে যায় বাংলাদেশের নাম, বাংলাদেশে নারীর কর্মসংস্থান বেড়েছে মর্মে বিশ্বে মর্যাদা বাড়ে, অন্যদিকে অধিক সংখ্যক নারী লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়।

মজুরির এই বৈষম্য জানলেও নারী দিবস নিয়ে হাস্যরস করা মানুষগুলো নিশ্চয়ই এটা জানেন না যে, প্রতি ১৬ মিনিটে পৃথিবীর কোন না কোন দেশে একজন নারী কিংবা শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। প্রতি ৩০ ঘণ্টায় অন্তত একজন মেয়ে গণ ধর্ষণের শিকার হয়। প্রতি দুই ঘণ্টায় অন্তত একটি মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। প্রতি ছয় মিনিটে একটি মেয়েকে যৌন হেনস্থা করার চেষ্টা করা হয়। প্রতি চার ঘণ্টায় অন্তত একটি মেয়ে পাচার হয়ে যায়।
পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত একটি দেশেও প্রতি পাঁচজন নারীর একজন জীবনে কোনো না কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হন। যার বেশিরভাগই ১৮ বছর বয়সের আগে যৌন নির্যাতনের শিকার হন।

যারা নারী দিবস উদযাপনের বেগুনি রঙ নিয়ে বাচাল চটুল কথাবার্তা বলেন তারা হয়তো জেনেও না জানার ভান করেন, একজন নারী কর্মক্ষেত্রে কতভাবে নির্যাতিত হন!
কাজের ক্ষেত্র বাদই দেই। কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের যে চিত্র আছে তা তো লোকসমক্ষে প্রকাশিতই হয় না ঠিকমতো।
কেবল নারী দিবসের বেগুনি রঙ নিয়ে হইচই না করে বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে লজ্জিত হওয়ার কথা। কারণ দেশের ১২.৭০ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হন।
এই সমীক্ষা করা হয়েছে শুধু সেইসব নারীদের নিয়ে যারা নিজে থেকে মুখ খুলেছেন, এগিয়ে এসে নিজেদের নিপীড়নের কথা জানিয়েছেন। আসল সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি।

কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য হাইকোর্টের একটি নির্দেশনা সত্ত্বেও তা বাস্তবায়নে কোন উদ্যোগ আজও নেওয়া হয়নি। নারী দিবস নিয়ে মশকরা দেখেও অবশ্য বোঝা যায় কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আইন করতে কেন আগ্রহ নেই সরকারের।

খুব স্বল্প পরিসরে এবার আসুন গৃহের নারীদের কথা বলি।

‘বাংলাদেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৫০ শতাংশই স্বামী বা সঙ্গীর কাছে শারীরিক অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার হন।’
এটি একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিকের খবরের হেডলাইন।

দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন বলে যে আইনটি আছে তাকে কাগুজে কাজির গরু বলাই শ্রেয়। কারণ এর মাধ্যমে পারিবারিক সহিংসতার মামলা করা যায় না। আলাদা আইনে করতে হয়।
আমি এক নারীকে জানি যিনি এডভোকেসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন কমোডের উপর বসে পড়ালেখা করে। কারণ তার শ্বশুরবাড়ি এমনকি স্বামীও চাইতো না তিনি পড়েন।
এক লেখককে জানি তিনি লেখালেখি করেন রাঁধতে রাঁধতে, চলার পথে যানবাহনে বসে, কখনো বাথরুমে বসেও, কারণ তিনি ঘরের কাজ করতে গিয়ে তার শখের নেশা লেখালেখির সময় বের করতে পারেন না।
এক ডাক্তারকে জানি স্বামীকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিতে নিজে একটা ছোট্ট হসপিটালে ডিউটি ডাক্তার হিসেবে জীবনের চব্বিশটা বছর কাটিয়ে দিয়েছেন।
আমারই স্বজন এক অতি সাধারণ নারী যিনি যৌথ পরিবারে বিয়ে হয়ে এসে স্বামীর সাথে দুইযুগ সংসারের ঘানি টেনেছেন। এক শিশু কন্যা রেখে স্বামী মারা গেলে স্বামীর ওষুধের দোকান নিজে চালিয়ে কন্যাকে মেডিকেলে পড়িয়েছেন। এখন যখন মেয়ে প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার তখন মা আর মেয়েকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে দুইজন বাদে শ্বশুর বাড়ির সকলে একজোট হয়ে মামলা হামলার ভয় দেখায়। ওই নারীকে আইনের দ্বারস্থ হতেও বাধা দেয়া হয়।

আর কত বলবো!
শুধুমাত্র সন্তান মানুষ করতে হবে বলে চাপে পড়ে সরকারি চাকরি ছেড়েছেন এমন অন্তত গোটা দশজনের চেহারা চোখের সামনে ভাসলেও সন্তান কোলে নিয়ে কর্মক্ষেত্রে দৌড়ানো নারীর সংখ্যা অনেক বেশি হবে। বিপরীতে একজন পুরুষের দেখাও এই সারিতে মিলবে না।
নারী গৃহিনী হোন অথবা যে পেশাতেই কাজ করুন তাকে ছাড় দিতেই হয় নয়ত জান লড়িয়ে দিয়ে এডজাস্ট করতে হয়।

উদাহরণ আর না বাড়াই।
শুধু বলি এসবই হচ্ছে পুরুষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। এটাই বৈষম্য যা নারীকেই সহ্য করতে হয়েছে হচ্ছে।
পৃথিবীতে এখন এই মুহুর্তে এমন কোন কাজ নেই যা নারীরা করছে না। এমন কোন পেশা নেই যাতে নারীর অংশগ্রহণ নেই। এমন কোন ক্ষেত্র নেই যাতে নারীর পদচারণা নেই।
অথচ এই লিঙ্গ বৈষম্য এখনো নারীর পিছু ছাড়েনি।
লিঙ্গ সমতায় নারী পিছিয়ে পড়ার কারণ কেবল নারীর প্রতি সহিংসতা পদে পদে অসহযোগিতা দায়ী নয়। সচেতনতার অভাবও দায়ী, যা এমনকি নারীদের মধ্যেও বিরাজমান। এটা যে নির্জলা সত্য তা নারীর কথা বলার এই দিন, সচেতনতা দিবস নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ দেখেও বোঝা যায় ।

লৈঙ্গিক সমতা মানে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার অধিকার চাওয়া নয়। লৈঙ্গিক সমতা মানে কাপড় খুলে ঘুরে বেড়ানোর অধিকার চাওয়া নয়। লৈঙ্গিক সমতা মানে চলনে বলনে মননে কৌশলে নির্যাতনের মাত্রায় পুরুষ হয়ে উঠা নয়। লৈঙ্গিক সমতা মানে মানুষ হিসেবে লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সকলের সম অধিকার নিশ্চিত করা।

নারীর স্তন আছে যোনী আছে বলেই ঘরে বাইরে কর্মক্ষেত্রে তাকে শুধু যৌনসামগ্রী না ভাবা।

যে নারী পরিবারের সদস্য, জীবনসঙ্গী, মা, বোন, প্রেমিকা বন্ধু সহপাঠী সহকর্মী সে একজন মানুষও এই ভাবনাই সমতা।

আর এই জরুরি ভাবনাগুলো ভাবাতে একটি দিনকে বাছাই করা হয় নারী দিবস হিসেবে। সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন থিমে সাজানো হয় দিনটিকে। পাওয়ারফুল কালার হিসেবে বেগুনি রঙকে বাছাই করা হয়। বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করা হয়।
নারী দিবস পুরুষতান্ত্রিক ঠাট্টা মশকরার বিষয়বস্তু নয়।

এবারের নারী দিবসের ক্যাম্পেইন হচ্ছে ব্রেক দ্য বায়াস অর্থাৎ ভেঙে ফেল পক্ষপাতিত্ব।
পক্ষপাতিতায় একটা পক্ষকে যেমন সুবিধা দেয়া হয় তেমনি বিপরীত পক্ষ হয় নিগৃহীত।
তাই সকল পক্ষপাতিতার দেয়াল ভেঙে সকলের সমতা নিশ্চিত হোক। আশায় বাঁচি।
শুভেচ্ছা সকল নারীকে।
লৈঙ্গিক সমতায় বিশ্বাসী সকল সচেতন মানুষকে শুভেচ্ছা।

শেয়ার করুন: