আয়নার ওপাশে

আফসানা কিশোয়ার:

শ্রাবণের চশমা চোখে আমার তখন ঢেউ গোণা ছাড়া কিছু করার ছিল না। অনিবার্য আগুনের ভেতর কুঁচকে যাওয়া কাঠে পরিণত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এমন মনোভাব নিয়ে আমি সব দ্বিধা ঝেড়ে আবার শ্রাবণের বাসার কলিং বেলে হাত রাখি।

– আপনি আবার এসেছেন?  আপনাকে কতবার বলেছি যে আপার চশমা, মোবাইল, ডায়েরি কোনকিছুই আপনাকে দেয়া যাবে না!

কেন দেয়া যাবে না? আমি তো ওর জন্য যে ফান্ড তোলা হয়েছে তা চাইতে আসিনি। আমাকে শুধু ওর একটা দু’টা জিনিস দাও যেন স্মৃতি ধরে রাখতে পারি।

-আপনার সাথে তার কী সম্পর্ক যে এসব দেবো? কত মানুষের কত বন্ধু চলে যায়, তারা এমন বিরক্ত করে না চলে যাওয়া মানুষের পরিবারকে। ধরেন, এই চশমা নিয়ে যান। আর জ্বালাতন করবেন না প্লিজ।

আমার সাথে শ্রাবণের সম্পর্ক! বিশ বছরের উপরে প্রতি স্মৃতির পরতে পরতে যে তার সাথে কী নিয়ে আমি যুক্ত এখন জনে জনে ব্যাখ্যা করতে হবে।

সেদিন কী যে এক গরমের দিন, হলে ওপেন এয়ার কনসার্ট। ভাবলাম একটু দেরিতে কনসার্টে যাই, সবাই যেহেতু গান শুনতে গিয়েছে, এখন গণ গোসলের জায়গা ফাঁকা থাকবে। অনেক কাপড়ও জমেছে, কিছু ধুয়ে নিতে পারবো। আমি কী ছাই জানি ঐ গণ গোসলের জায়গায় আমার আগামী বিশ বছরের ইতিহাস রচিত হবে!

কাপড়ের বালতি রেখে কলের কাছে যেতেই দেখি ফ্লোরে কে যেন শুয়ে আছে না বলে পড়ে আছে বলা ভালো। কাছে গিয়ে দেখি দুই রুম পরের আমার এক জুনিয়র। হায়রে, এ কী, অজ্ঞান হয়ে গেছে! মগে পানি নিয়ে মাথাটা কোলে করে চোখেমুখে ছিটাতেই একটু চোখ খুলে। আমি আস্তে ধরে বসাই, প্রায় ফ্ল্যাট চেস্ট আমার হাতে থাকা গামছা দিয়ে ঢেকে দেই, ভেজা মাথাটা মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করি, রুমে যেতে চায় নিজের, না গোসল করিয়ে দেবো!

-ওহ,তোমার নাম কী, তাই তো জিজ্ঞেস করিনি।

নাম বলে, শ্রাবণী, ২০৫ নম্বর রুম। ধীরে স্নান করানোর পরে ওকে রুমে দিয়ে ফিরবো এমন সময় বলে, আপা, আমার তো ডায়াবেটিস আছে, সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। তাই সুগার ফল করেছে। আমাকে কিছু খেতে দেন।

বুঝলাম আজকে আমার আর কাপড় ধোয়া বাদ। দ্রুত চিনি গুলে শরবত করলাম। হিটারে নুডলস বসালাম। শ্রাবণীকে খাওয়ানোর পর দেখলাম গালে রঙ ফিরেছে।

আমাদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা, তার উপর জুনিয়র, এমনি গল্পে গল্পে জানলাম, বোর্ড স্ট্যান্ড দু’বারের। চুল ছোট, পাঞ্জাবি পরা, সমতল স্তন, সব মিলিয়ে তাকে ছেলে ছেলে দেখা যায়, এজন্য অন্যরা বেশ শ্রাবণ ভাইয়া ডেকে ঠাট্টা করে।

মূল বিষয় হলো, হলে উঠেছে, কিন্তু লাগাতার পড়াশোনা করতে পারা ছাড়া সে আর কিছুই শেখেনি। দিনের পর দিন চিপস মুড়ি চিড়া এসব খেয়ে থাকার কারণে চার মাসে ছয় কেজি ওয়েট লুজ করেছে। আমিও কবে থেকে যেন শ্রাবণ ডাকা শুরু করি। ওকে বলি, আমাদের রুমে যে আমরা মেস সিস্টেমে খাই, সেখানে যোগ দিতে। ডাইনিং এর খাওয়া খেলে বাঁচবে না যে।

হলের রুমে যে মেস সিস্টেম সেখানে সবাইকে যার যার দিনওয়ারি রান্না করতে হয়। শ্রাবণেরটা আমিই করে দেই। হলের প্রভোস্টের সাথে কথা বলে আমাদের রুমে একটা সিট খালি থাকাতে শ্রাবণকে আমাদের রুমে নিয়ে আসি।

পরীক্ষা, আমি ওকে মুখে খাবার তুলে দিচ্ছি, ও পড়ছে। ও ওর চেস্টে ক্র‍্যাপ ব্যান্ডেজ জড়িয়ে তারপর পাঞ্জাবি পরে যেন ওকে সহজে মেয়ে হিসেবে বোঝা না যায়। কী অদ্ভুত মেধাবী বাচ্চা চেহারার এই মেয়েটা! চিন্তা ভাবনার ধরনই আলাদা। সব কথায় হাসে। রাতে মশারির নিচে আমার বুকে ঢুকে ঘুমায়। কোন ছুটিতে নিজের বিভাগীয় শহরে বাসায় যেতে চায় না। ওর বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, আর আমার ননী চোরা কৃষ্ণ নিয়ে আমাদের কী যে হাসাহাসি চলে!

ওর ছাত্র ইউনিয়নে, ও কেন ছাত্রী হয়ে যায়, এ নিয়ে ক্ষেপাই, আবার ও আমাকে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক নারী হতে পারে কিনা এ নিয়েও আমাকে লেগপুল করে। আমাদের রুমের অন্য দুইজন নীলা, আর জয়া আমাদের টম এন্ড জেরি ডাকে। পড়ছি, অনার্স ফুরালো প্রায়, শ্রাবণও সেকেন্ড ইয়ারে। কে কী করব ভাবি। নীলা একদিন বলে পড়া গোছানো হলে আমরা একসাথে বাসা নেবো তিনজন। জয়া তো আতিক ভাইকে বিয়ে করবে অনার্স শেষ হলেই। আমাদের তিনজনের বাসা থেকে যে খরচ আসে তা দিয়ে যদি দু’রুমের একটা বাসা ভাড়া নেয়া যায় তাহলে চাকরি খোঁজাও সহজ হবে, ঢাকায় থাকাও হবে।

অত ভীড় ভালো লাগে না তো! অন্য হলে রাতে পুলিশি হামলা হতেই আমরা অপছন্দের ভীড়ে রোষে মিশে গেলাম। অনশন, লাঠি চার্জ – পুলিশের উদ্যত লাঠি শ্রাবণের শরীর ছোঁয়ার আগেই আমি পিঠ পেতে নিলাম। পত্রিকায় পত্রিকায় ছবি এলো আমি পক্ষীমাতার মতো শ্রাবণকে বুকে নিয়ে পিঠে লাঠির বাড়ি খাচ্ছি। আমি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক ছাত্রীবিহীন ছাত্র ইউনিয়নের শ্রাবণকে বাঁচাতে টিয়ারশেল ওড়নায় চেপে ধরে আবার পুলিশের দিকে ছুঁড়ে মারি। জিয়ার সৈনিকরা এদিকে চাপাতি কিরিচ এসব নিয়ে আমাদের দাবড়ানি দিয়েছে। শ্রাবণ পিটি ঊষার বেগে আমাকে নিয়ে হাকিম চত্বর থেকে শহীদ মিনারের দিকে ছুটে। নীলা ওড়না হারিয়ে আমার উপর রাগ, আমি কেন নিজের ওড়না দিয়ে ধরে টিয়ার শেল মারলাম না, কেন ওরটা নিলাম।

আমি হাসতে হাসতে বলি, আরে তোর কিছু কেউ ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়েও খুঁজে পাবে না, আমার অবস্থা তো জানিস, অস্ট্রেলিয়ার ডেইরি ফার্ম। আমরা হাঁপাতে হাঁপাতে কিরিচ বাহিনী পেছনে নেই দেখে গোটা পঞ্চাশেক মানুষ শহীদ মিনারে অনশনে বসে পড়ি।

এই অনশন চলাকালে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে শ্রাবণের প্রবল জ্বর যখন তখন একদিন ও আমাকে হয়তো অজান্তে বা কারও স্পর্শ চাওয়ার প্রাবল্যে চুমু খায়, কোনকিছু না ভেবেই আমিও যে কেন সাড়া দিই!

আমাদের তিনজনের সংসার টাইপ হয়। দিনের শেষে কে সারাদিন কী কী করলাম একজন আরেকজনকে বলি। নীলা এক রুমে থাকে। আমি আর শ্রাবণ আরেক রুমে। আমাদের তিনজনের একই সাথে একটা এনজিওতে জব হয়।

আমাদের কাউকে আর লাগে না। কিন্তু পরিবার? শ্রাবণ বাড়ি থেকে ছুটি কাটিয়ে ফেরে হাতে প্লাস্টার নিয়ে। ওর এই ছেলে ছেলে ভাব দূর করতে ওর ছোট ভাই ওকে রুমে আটকে তার দুই বন্ধু ঢুকিয়ে দিয়েছিলো ওকে রেইপ করার জন্য। ওর মায়েরও তাতে সায় ছিলো। কীভাবে কীভাবে যেন মারামারি করে ও সেটা ঠেকাতে পারে। কিন্তু হাত ভেঙ্গে গেছে।

শ্রাবণ আমার কাছে কান্নায় ভেঙে পড়ে – অনু, আমি তো অসুস্থ না। ছোট থেকে আমি এমন। আমার এসব পিরিয়ড, লম্বা চুল, ব্রা অসহ্য লাগে। আমি তো তাদের সন্তান, আমার ভাইয়ের বোন হই, ভাই হই, তার সিবলিং আমি, কেন ওরা এমন করে? বাবা পর্যন্ত বলেছে, এমন সন্তান বেঁচে না থাকলে তার কিছু যাবে আসবে না। আমাকে কোন আত্মীয় স্বজনের প্রোগ্রামে নেয় না আমাকে দেখলে নাকি অমঙ্গল হয়! শ্রাবণের কান্নায় ওকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকি।

আমার বাসায় মা আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছে। নিজের সিঁদুর মুছে ফেলবে, মঙ্গলসূত্র ছিঁড়ে ফেলবে এমন তাণ্ডব। সে আর আমি শ্রাবণকে বলি না। আমরা তো আমাদের মতো ভালোই ছিলাম। কেন যে সবার এতো মাথাব্যথা!

শ্রাবণ জেএনইউতে এমফিল করতে চলে গেলো, নীলার পোস্টিং হলো কক্সবাজার। আর আমি মায়ের জান বাঁচাতে বিয়ে করে ফেললাম।

আমাদের তিনজনের কথা থামে না। শ্রাবণ আমাকে প্রতিদিন প্রশমিত করে সঞ্জীবকে কীভাবে মেনে নেবো তা বোঝাতে। এমন কোনদিন নেই আমাদের তিন বন্ধুর আলাপ হয় না। আমরা একজন আরেকজনকে সাহস জোগাই। ফেলে আসা একসাথে থাকার দশ বছরের আনন্দ উচ্ছ্বাস মনে করে করে বর্তমানকে গুটানো আস্তিনে ভরে নেই আলগোছে।

শ্রাবণকে বলি তুমি আরেকটা প্রেম করো। ও শুধু হাসে। বলে প্রেম কি শুধু দেহ দিয়ে হয় অনু! স্নেহ লাগে, মায়া লাগে, ভালোবাসা লাগে, শব্দের সাথে শব্দ মিলতে হয়। যখন হবে, তো হবে। তুমি চিন্তা করো না। আমি ভালো আছি।

ঠাকুরের কী কৃপা আমার আর সঞ্জীবের মেয়েটা দেখতে পুরা শ্রাবণের মতো এবং শ্রাবণের কোলে গেলে আর নামে না। এমফিল শেষ করে শ্রাবণ ওর বিভাগীয় শহরের ইউনিতেই লেকচারার হিসেবে জয়েন করে। প্রতি মাসে ঢাকা আসে। সঞ্জীবের সাথে, আমাদের মেয়ে ঈপ্সিতার সাথে সময় কাটায়, আমরা আগের মতো দেশ রাজনীতি, নারীবাদ, ইনক্লুসিভ সমাজ এসব নিয়ে আড্ডায় ভেঙে পড়ি।

কেন যে শ্রাবণ ওর প্রবল ব্যথার কথা প্রতি পিরিয়ডের মাসে কাউকে জানায়নি কে জানে! ওর একধরনের বিরাগ ছিল ওর নারী অঙ্গের প্রতি। ফোর্থ স্টেজ ওভারি ক্যান্সার ধরা পড়তেই দ্রুত সব পালটে যেতে থাকে! যে পরিবার ওকে কখনও কাছে টানেনি, আমরা বন্ধুরা ওর চিকিৎসার জন্য সব টাকা যোগাড় করতেই কোথা থেকে যেন তারা হাজির হয়। অপারেশন, থেরাপির পর থেরাপি, আবার অপারেশন, হসপিটাল-বাসা, বাসা-ইন্ডিয়া এসব করতে করতে গত পরশু আমার হাতের উপর শ্রাবণ চলে গেছে তার বুদ্ধের শরণাগত হতে।

আয়নার এপাশে আমার ছায়া, ওপাশে শ্রাবণের হাসিমাখা অভয় দেয়া মুখ। অনু একটা ইনক্লুসিভ সমাজ কবে হবে? কোন জনমে আমি তোমার পাশে থাকার অনুমতি পাবো? আমার চোখে শ্রাবণের চশমাটা, আমি জলচোখে দৃষ্টির উপর বয়ে যাওয়া ঢেউ গুনছি।

আপনার সাথে আমার বোনের সম্পর্ক কী- এ প্রশ্নের যুতসই উত্তর খুঁজছি।

শেয়ার করুন: