মেয়েটি (কল্যাণী রমার অণুগল্প)

কল্যাণী রমা:

সুপারনোভা

অমলকান্তি রোদ্দুর হ’তে চেয়েছিল। আর এই মেয়েটি সুপারনোভা। আলোতে চারপাশ ঝলসে দিয়ে নিজের চোখও ঝলসে যাবে আলোয়।
সংসারের দড়ি টানাটানি খেলায় মেয়েটির সুপারনোভা হওয়া হয়নি। ও সারাদিন বাসন মেজেছে, দেয়ালের ঝুল ঝেরেছে, আসবাবপত্রের ধুলো মুছেছে। তবু ও কোন কালোই আলোতে ভরে দিতে পারেনি। হবে হয়তো সুপারনোভা হ’তে পারেনি বলেই বুঝি সব আলো মেয়েটির জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
মেয়েটি শত শতাব্দি যদিও বেঁচে থেকেছে। রান্নাঘরের মাটি কামড়ে তেলাপোকা যেভাবে বেঁচে থাকে!

 

বাসন

মেয়েটি যখন খুব ছোট ছিল, বাবা-মায়ের বাড়িতে ছিল, সে বড় আহ্লাদে ছিল। ওর একটা কাঁসার বড় জামবাটি ছিল। গরমকালে সে বাটিতে ঘন দুধ দিয়ে, আম-কাঁঠালের রস দিয়ে মেয়েটি দুধভাত খেত। দুধের সর ওর বড় প্রিয় ছিল। ঠাকুমা মেয়েটির জন্য বাড়ির সকলের চোখ বাঁচিয়ে সরটুকু আলাদা করে রাখতো।
বরের বাড়িতে মেয়েটি এলো। কোনদিন মেয়েটির জন্য কেউ দুধের সর আলাদা করে রাখলো না। তারপর আলাদা পথে যখন হাঁটতে হলো, মেয়েটি সাথে করে তার প্রিয় ভ্যান গ্যঁ কাপ নিয়ে যেতে পারলো না।

মন খারাপ করতে করতে মেয়েটি ভাবলো, ‘মানুষের প্রথম বাসন মাটির তৈরি ছিল। মাটির যা কিছু তা কবরে মিশে যায়।’

 

গয়না

মেয়েটিকে কেউ বলেছিল অন্য কোন মেয়ের পুরনো সোনার হার কখনও কিনতে নেই। অনেক চোখের জল মিশে থাকে তাতে। মেয়েরা সহজে গলার হার বেচে না। তাতে গায়ের ঘাম মিশে থাকে। মিশে থাকে প্রতিদিনের স্বপ্ন, ভালোবাসা।

অন্যের বিয়ের বেনারসীও নাকি কিনতে নেই।

অন্যর দু:স্বপ্ন কেনা যায় না।

 

ছোঁয়া

মেয়েটি তখন খুব ছোট ছিল। হয়তো চার বছর বয়স। ওদের বাড়ির একজন বয়স্ক পুরুষ ওকে ছুঁয়ে দিয়েছিল। এ ছোঁয়া খেলার মাঠের গোল্লাছুট, ছোঁয়াছুয়ি খেলা নয়। এ ছোঁয়ায় বেদনা ছিল।

আজ ভালোবাসা দিবস। এ দিনে বেদনার কথা বলতে নেই। কিন্তু স্তম্ভিত হয়ে যাওয়ার জন্য কি কোন দিন আছে? কিংবা নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য কোন বিশেষ দিনের সেলিব্রেশন?

বড় হয়ে মেয়েটির বাগানের গোলাপে হেমন্তে বরফকণা জমে উঠতো। জলজ্যান্ত নরম পাপড়ির গোলাপ কেমন মুচমুচে কাগজের মতো হয়ে যেত। মেয়েটির নিজের চার বছর বয়সের কথা মনে হতো।

 

বৃষ্টিতে ভিজে

কাকটা সকাল থেকে ভিজছে। কুচকুচে কালো রঙ আরো তেলতেলে হয়ে উঠছে বৃষ্টির জলে। জানালা দিয়ে মেয়েটি কাকটা দেখছে বৃষ্টিতে অন্ধ হয়ে আর কিছু দেখবার না পেয়ে।

ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। মেয়েটিও বৃষ্টিতে ভিজতো। বড়বেলায় ও কেবল চোখের জলে ভিজে।

 

কাজল

মেয়েরা চোখে কাজল পরে – কখনো সাজতে। তবে বেশিরভাগ সময়ই জীবনের কালশিটে লুকাতে। মেয়েরা অযুত কাল ধরে চোখের নিচে ছায়ার মতো কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পারে।

মাঝে মাঝে সেইসব ছায়া গাছের চেয়ে দীর্ঘ হয়। সেই ছায়াঘেরা পথ তার নিজ জীবনের পথের চেয়ে লম্বা হয়।

শুধু চোখের নিচের কালশিটে নয়, মেয়েরা তার পিঠে আছড়ে পড়া চাবুকের দাগও ব্লাউজের ভাঁজে, পিঠের চামড়ার নিচে লুকিয়ে রাখে। যেখানে পৃথিবীর অন্য কারো চোখ পড়ে না।

 

চামচ

একটা চামচ। চায়ের চামচ। কিন্তু সকলের সামনে, কাপে কাপে চা দিয়ে চা নাড়বার চামচ নয় এটা। অন্যদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে দেখা যায় যে সৌন্দর্য, তা আঁকা নেই এ চামচের গায়ে।
এ চা চামচটি মেয়েটির একান্ত। এর সৌন্দর্য শুধু ও একাই দেখে। রান্নাঘরে একা একা একটা নক্সাকাটা টিনের কৌটো থেকে এ চামচ দিয়ে চা তুলে ফুটন্ত জলে ছেড়ে দেয় মেয়েটি। ধীরে ধীরে গাঢ় বাদামি রঙ জলে চুইয়ে পড়ে। বেদনাও একইভাবে।
পাশের বসবার ঘরে অনেকে এসেছে। মেয়েটি ধীর পায়ে চা নিয়ে যায় সে ঘরে। কারো সাথেই ও কথা বলতে পারে না। মাটির দিকে তাকিয়ে নিজের পায়ের নখ দেখে।
রান্নাঘরে যখন একা ছিল, অনেক স্বপ্ন আর গল্প বুনেছিল বুকে।

 

হঠাৎ দেখা

একই ঘরে ছেলেটি আর মেয়েটি।

ছেলেটি বললো, ‘তিরিশ বছর একসাথে আছি। কোনদিন তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখিনি।’

মেয়েটি বললো, ‘কেন? ঘৃণায় না অবহেলায়?’

ছেলেটি বললো, ‘ইচ্ছে করেনি।’

তারপর ধীরে ধীরে বললো, ‘তুমি বেশ সুন্দর দেখতে।’

বললো আজ ছেড়ে যাওয়ার সময়।

 

পিয়ানো

ছেলেবেলায় মেয়েটির বাড়িতে গানের স্কুল বসতো। মেয়েটি গান করতে পারতো না। কিন্তু বন্ধু-বান্ধবদের সাথে হারমোনিয়ামের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতো। বাড়িতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওস্তাদ হরিপদ দাদু আসতেন। মেয়েটি পুরো ছেলেবেলা তানপুরার পাশেও গন্ধ শুঁকে শুঁকে কাটিয়েছে। ওর কুকুর যেমন। কুকুরটি চাইকোভস্কি বাজাতে পারে না। পিয়ানোর নিচে গিয়ে একটু আগে যে ওই পিয়ানো বাজিয়ে চলে গেছে, তার ফেলে যাওয়া গন্ধ শোঁকে।

মেয়েটির কাছেও ফেলে যাওয়া গন্ধ সবসময়ই জলজ্যান্ত, পুরো মানুষের চেয়ে দামি। আজ গান থেমে গেছে। এই পিয়ানো দু’ভাগ করে তার কাঠ সের দরে বেচে দেওয়া হবে। হাটের মাঝে সেই চ্যালাকাঠ ডাঁই ক’রে রাখা হয়েছে – আলু, পিঁয়াজের পাশেই।

ঘরের দরজার গোল-মসৃণ, তেল-চকচকে নব; বহু একলা দুপুরে তাকিয়ে দেখা জানালার বাইরের আকাশ; যে কোন সময়েই শূন্যে ঝুলে পড়বার কড়িকাঠ – মেয়েটি সবই দেখতে পাচ্ছে। স্খলিত মানুষকে ভালোবাসতে পারেনি ব’লে মেয়েটি ওদের ভালোবেসেছিল। ওদের রক্ত-ঝরাটুকু ওরা মেয়েটির শূন্য পিগি ব্যাঙ্কে যত্ন ক’রে রেখে দিচ্ছে।

এ পিয়ানোতে আর কেউ কোনদিন ‘আভে মারিয়া’ বাজাবে না।

 

শরীর

গয়না খুলে ফেল। আজ শুধু তোমাকে চাই। ওপাল পাথরের জ্যোৎস্নার থেকে তোমার শরীরের বাঁক সুন্দর। ছেলেটি সেদিন মেয়েটিকে একথা বলেছিল, প্রেমে।

মানুষের জীবনে অনেক রাত থাকে যা কাটে হ্রদের ধারে। আকাশে কমলা রঙের চাঁদ থাকে। সে আলোয় জলের রঙও কমলা হয়ে যায়।

প্রেম শেষ হয়ে গেলে হ্রদের পাশে ছোট ছোট বুনো প্রাণীদের হাড় পড়ে থাকে। আর তার পাশে থাকে নীলচে হয়ে যাওয়া অজানা ফুল।

 

ক্লাউন

যখন কোন মানুষের জীবনে দু:খ খুব বেশি হয়, সে আর দু:খের গল্প বলে না। সে শুধু হাসির কথা বলে। কে যেন বলেছিল ক্লাউনরা পৃথিবীর সবচেয়ে দু:খী মানুষ। মেয়েটির তবু দু:খটুকুর কথা কেন যেন জানতে ইচ্ছে করে না। মেয়েটি ক্লাউনের হাসির নানাকিছু খুব ভালোবাসে। হাসতে হাসতে দম ফেটে মরে যেতে ভালোবাসে।

শুধু সার্কাস থেকে বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়ালে মেয়েটি দেখে ওর চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে।

 

আগুন

ছেলেটির আর মেয়েটির বেশকিছু কড়ির পয়সা ছিল। মেয়েটি ভেবেছিল কড়িগুলো দেখতে খুব সুন্দর। বুকের কাছে কড়ির গোলাপি রঙ থাকে। কিছুটা খাঁজকাটা। কড়ির খাঁজে কি কড়ির বয়স লুকানো থাকে? গাছের শরীরের ভিতরের বৃত্তে গাছের বয়স যেমন? কড়ির উপরের দিকটা দুধসাদা, মসৃণ। মেয়েটি এইসব নিয়ে চিন্তায় এত বেশি মগ্ন ছিল, এত বেশি ব্যস্ত ছিল যে ছেলেটি সব কড়ির পয়সা নিয়ে একদিন একটি নৌকায় পাল তুলে মাঝ নদীতে চলে গেল। মেয়েটি সাঁতার জানতো না।

বিয়ের বেনারসি পরে মেয়েটি নদীপাড়ে কাদার উপর বসে থাকলো। সব কানাকড়ি চলে গেছে বলে আটপৌরে শাড়ি কিনবার পয়সা ওর নেই। আত্মভোলা, কবি কবি স্বভাবের মেয়েরা কানাকড়ির জন্য কাঁদে না। ওরা নদীপাড়ের কাশফুল দেখে। একটু দূরে চিতায় মানুষের শরীর ছাই হয়ে যেতে দেখে।

যখন চিতার আগুনে মানুষের শরীর ছাই হয়ে যায়, তখনো আগুনের পাশে অনেক মানুষ জড়ো হয়। আগুনের রঙ দেখতে।

 

‘কোন রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে’

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখি আকাশের সব আলো নিভে গেছে। আশেপাশে কোন ঝরণা নেই। তবু ঝরণার জলের মতো নৈ:শব্দ ঝরছে। সেই কালোর ভিতর উচ্চস্বরে গান গাচ্ছে সিকাডা পোকা। মাটির নিচে সতেরো বছর ছিল ওরা। মাটির নিচে বেঁচে ছিল। এখন মাটি ফুঁড়ে পৃথিবীতে মরতে এসেছে সন্তানের জন্ম দিয়ে। মেয়েটির মনে হলো মানুষের জীবনের সার্থকতাও সন্তানের জন্ম দিতে দিতে মরে গিয়ে।

নিজের জন্য বাঁচে না মানুষ, বাঁচে পরের প্রজন্মের জন্য। সিকাডা পোকার মতো গান গেয়ে। ‘একাকী, সংগীবিহীন অন্ধকারে।’

 

“আমার এ ঘর বহু যতন করে ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে”

আজ সারাদিন আর কোন কাজ নেই, শুধু ঘর পরিষ্কার করা ছাড়া। তবে মেয়েটির ঘরের উঠোন বরফে ঢেকে আছে, চালের গুঁড়ো দিয়ে আলপনা দেওয়া যাবে না। ও শুনেছিল কালরাতে চাঁদ উঠেছিল। কুয়াশা ছিল, অনেক মেঘ ছিল। সে চাঁদও মেয়েটি দেখতে পায়নি।
এ ঘর থেকে ও ঘর ঘুরপাক খেয়েছে। বিড়বিড় করে নিজের সাথেই কথা বলেছে – একা। ছেলেবেলার কথা, বৃষ্টিভেজা কৈশোরের কথা, দামাল তারুণ্যের কথা, যৌবনের প্রেমের কথা। বার্ধক্যের কথা ও বলে না। মৃত্যুর কথাও না। যেসব সময়ে মনে হয়েছিল ও আকাশ ছুঁতে পারে, শুধু সেইসব দিনের কথা মনে করতে চায় মেয়েটি।
আজ সারাদিন সত্যিই কোন কাজ নেই। সাদা রঙের গ্র্যান্ড পিয়ানোটার উপর থেকে কাঠের সব ‘কাটুম কুটুম’ সরিয়ে আজ মেয়েটি পুরোটা দিন ধরে শুধু ধূলো ঝাড়বে।
সুর বলেছে সে ফিরে আসবে!

 

কবি

‘একমাত্র যখন লিখি তখন জোনাক পোকার মত আলো জ্বলে ওঠে জীবনে।’ একথাটা বলেছিল এক কবি। ‘বাকি সময় গাঢ় অন্ধকার।’

কথাটা শুনে খুব কষ্ট হয়েছিল মেয়েটির। শুধু জোনাক পোকা নয়, কবির জীবনের ধ্রুবতারা হতে ইচ্ছে করেছিল ওর।

সব আলো জ্বলে না।

 

সুধা

একটি মেয়ের নাম ছিল ‘সুধা।’ ‘সুধা’ মানে কী? ‘অমৃত।’ ‘সুধা’ মানে ‘জ্যোৎস্না।’ রক্ত নয়। তবু রক্তেই ভেসে গেছে মেয়েটির পুরোটা জীবন।

কেউ কেউ বলেছিল, ‘সবচেয়ে যারা ভালো মানুষ, তাদের জীবন রক্তধারাতেই ভেসে যায়। ঈশ্বর বলে যদি কেউ থেকে থাকেন, এ তাঁর পরীক্ষা।’

সুধা নামের মেয়েটির আর কোন পরীক্ষা দিতে ইচ্ছে করে না। ওর ইচ্ছে করে এক নদীপাড়ে গিয়ে বসে থাকতে। যার পাশে কাশবন, বুনো ফুল। এমন কী আকাশ থেকে যেন ঝরছে উইন্ডচাইমের টুংটাং শব্দ – অমৃতের গান। ঝরছে জ্যোৎস্না – ওর নামের অর্থ।

 

লেখক পরিচিতি –

কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং-এ বি টেক করেছেন । এখন আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে।

প্রকাশিত বই:
আমার ঘরোয়া গল্প;
হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা;
রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথ, মেরি অলিভারের কবিতা;
মরণ হ’তে জাগি – হেনরিক ইবসেনের নাটক;
রেশমগুটি;
জলরঙ;
দমবন্ধ।

শেয়ার করুন: