পোশাকের কোনো জেন্ডার নেই, কোনো ধর্ম নেই

পূর্ণাশা অরোরা:

কাউকে হিজাব খুলতে জোর করা এবং কাউকে হিজাব পরতে জোর করা, দুইটাই অপরাধ। এতোকিছুর মাঝে দেখছি বিরোধটা কেবল‌ই নারীর ওপর। একেক দেশ তাদের সুবিধামতো এবং আরো ভালো করে বলতে গেলে, দেশের পুরুষদের সুবিধামতো নানান নিয়ম কানুন লিখে রুল জারি করে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে। এসব পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারার সকল মনোযোগ কেবল নারীর পোশাক ও চালচলনের ওপর‌ই! একজন মেয়ে কীভাবে থাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে তা তো ভাববার প্রশ্ন‌ই আসে না, বরং তার স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে যতরকম বাধা দেয়া সম্ভব তা নিশ্চিত করাই এই সমাজের দায়িত্ব।

কর্ণাটকের সংখ্যাগরিষ্ঠ উগ্রবাদীরা যেমন হিজাব খুলতে জোর করছে, ইরানে তেমনি উগ্রবাদীরা হিজাব পরতে জোর করছে। শুধু কি তাই? এদেশের ধর্মীয় বক্তাদের প্রিয় বিষয়‌ই তো নারীদের চালচলন ও পোশাক! এতো এতো মহান ধর্মপ্রাণ নেতা, সবাই গিয়ে নারীর পোশাক, নারীর কাজ, নারীতেই যদি আটকে যায় তবে সমাজ চালাবার মতো বড় দায়িত্ব নিতে যায় কেন?

কিছু মানুষকে দেখছি ভারতের ঘটনায় মেয়েদের অধিকার লঙ্ঘন নিয়ে অনেক কিছু বলছে, প্রতিবাদ করছে, সাপোর্ট জানাচ্ছে। তারা একজন‌ও আফগানিস্তান বা ইরানের নারীদের অধিকার লঙ্ঘন হবার সময় কিছুই বলেনি, উল্টা বিশ্রী হাসি হেসে “নারীবাদী আসছে হেহ” বলে পুরো ব্যাপারটাই উড়িয়ে দিয়েছে। এসব মানুষ আসলে ভারতের মেয়েগুলোর বা কারোর অধিকার নিশ্চিত হোক তা চায় না, ধর্মের দোহাই দিয়ে কেবল নিজেদের পুরুষ হবার, সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার ফায়দাটুকুই চায়!

পোশাকের কথা বলতে গেলে যদি সংস্কৃতির কথা উঠে আসে, তবে বলা যায় যে একেক জায়গার সংস্কৃতি সে জায়গার আবহাওয়ার এবং উপস্থিত উপাদানের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। আরব দেশে যে প্রখর সূর্যের তাপ, তা ত্বকের জন্য ক্ষতিকর, ক্যান্সার পর্যন্ত হয়। সে দেশে সম্পূর্ণ ত্বক ঢাকা যায় এমন পোশাক পরা লাগে তাই! সেখানে কেবল নারীরা বোরখা পরে না, পুরুষরাও জোব্বা পরে একই কারণে। কিংবা এস্কিমোদের কথাই ধরি, এমন কঠিন বরফের শীতে আইস বার্ন হতে পারে, ত্বকের টিস্যু ঠাণ্ডায় নষ্ট হয়ে যেতে পারে, ফলে তারাও মোটা পোশাক পরে যাতে সম্পূর্ণ ত্বক ঢাকা থাকে। বিভিন্ন দেশ বা পরিবেশে তাই নানান পোশাক। এসব কারণ ছাড়া পোশাকের কোনো জাতি বা ধর্ম নেই।

একজন ব্যক্তির কোন পোশাক পরতে ভালো লাগবে তা একান্ত‌ই তার ব্যাপার। এখানে “সংস্কৃতি নষ্ট হবে” এমন কথা বলাটাও বোকামি, কারণ সংস্কৃতি এতোটা ঠুনকো বিষয় না। আজ শাড়ি পরে কাল জিন্স পরলে কারোর সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে যায় না। সংস্কৃতিও মানুষ‌ই গড়ে তুলেছে। কারোর বোরখা পরে ভালো লাগতে পারে, কারোর শর্টস পরে ভালো লাগতে পারে, এটা তার ব্যক্তিগত মতামত সে কী পরতে চায়। এখানে কোনো ধর্ম বা জাতির কথা টেনে আনাটা অর্থহীন। নারীদের সকল বিষয়ে ধর্ম টেনে এনে বাধা দেওয়াটা কেবলমাত্র পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের সমস্যা।

আজ এদেশের অনেক ধর্মপ্রাণ ভাইদের দেখছি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে কর্ণাটকের ঘটনায়, তারা বলছে হিজাব নারীর অধিকার, তাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করো না। ঠিক এ মানুষগুলোই ইরানে যখন নারীদের ওপর হিজাব চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল তখন চুপ ছিলো। তখন কি ইরানের নারীদের অধিকার লঙ্ঘন হয়নি? অধিকারবোধটা কি তবে কেবল তাদের সুবিধামতো খাটে? যে দেশে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেদেশে তাদের কাছে যেটা সুবিধাজনক সেটাই নিয়ম! তাদের মতাদর্শের বাইরে সবাই খারাপ, সবাই পাপি! এসব কথা পুরুষ জাতির বিরুদ্ধে বলছি না, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে বলছি।

আমাদের সমাজে সুশিক্ষার এতো অভাব যে লোকে পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের পার্থক্য বোঝে না। যেমন পোশাকে নিষেধাজ্ঞা পুরুষেরও আছে। কোন ছেলে যদি “নারীদের পোশাক” পরে তবে তার আর কোনো মান সম্মান থাকবে না। এমনকি গোলাপী রঙের জামা পরলেও পুরুষত্ব চলে যায়। তবে কি পুরুষত্ব এতোটাই ভ‌ঙ্গুর যে একটা রং বা কাপড়ের টুকরো একজন ব্যক্তির পুরুষত্ব দুমড়েমুচড়ে ফেলতে পারে নিমিষেই? ”

মেয়ে হ‌ওয়া লজ্জাজনক, মেয়েরা যা করে যা পরে অবশ্য‌ই তা পরলে একজন সম্মানিত পুরুষের কোনো সম্মান বাকি থাকে না”, এ কারণেই ছেলেদের পোশাকেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। ঘুরেফিরে দোষের আঙ্গুল নারীর দিকেই তাক করা হয় তাই। কে হিজাব পরলো, কে শাড়ি পরলো, কে জিন্স পরলো, কে বোরখা পরলো বা কে ক্রপটপ পরলো তা ঠিক করে দেবার আমরা কেউ ন‌ই, চাপিয়ে দেবার‌ও কেউ ন‌ই; যার যেটায় সাচ্ছন্দ্য, যার যেটায় প্রাউড ফিল হয়, যে পোশাক পরে সে নিজেকে প্রকাশ করতে পছন্দ করে তা সে নিজেই বেছে নেবে। কেউ হিজাব পরতে চাইলে তা টেনে খুলে দেয়া সম্ভব না, কেউ হিজাব পরতে না চাইলে তাকে জোর করে পরানো সম্ভব না। যার যে পোশাকে সাচ্ছন্দ্যবোধ হবে সে সেই পোশাক পরবে, পোশাকের কোনো জেন্ডার নেই, কোনো ধর্ম নেই।

 

(উইমেন চ্যাপ্টারে প্রকাশিত সব লেখাই লেখকের অভিমত বা মতামত)

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.