শোককে ‘রিয়েলিটি শো’ নাইবা বানালেন!

স্বাতী ব্যানার্জ্জী:

ভারতীয় উপমহাদেশে সব থেকে সমারোহে পালিত হয় শোক। আরো প্রাঞ্জলভাবে বললে আমরা বিখ্যাত মৃত্যুকে উদযাপন করি। এই বিষয়ে আমরা কখনও পিছিয়ে থাকিনি। শেষযাত্রায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের চুল-দাড়ি উপড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল ভক্তরা শুনেছি। সত্যজিত রায় মারা যাওয়ার পর জানতে পারলাম অধিকাংশ মানুষ নাকি তাকে মানিকদা বলেই ডাকতেন। মাদার টেরেসার মৃত্যুর পর জেনেছি কত মানুষ তার স্নেহধন্য ছিলেন। এইভাবে বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের মৃত্যুকে পুঁজি করে আমরা শোককে উৎসবে পরিণত করেছি। তখন সোশ্যাল মিডিয়ার এতো সহজলভ্যতা ছিল না, তাই পত্রপত্রিকায় লেখা আর রকের আড্ডার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এই শোক।

পরবর্তীকালে ফেসবুক – ইনস্টা – টুইটার শোকপালনকে বৃহত্তর মঞ্চ দিয়েছে, দিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অভিমুখ‌ও। শোক এখন দুর্গা পুজোর মত‌ই মহালয়া থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত বিস্তারিত। সাধারণ নেট নাগরিক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে আকুলি-বিকুলি শোক পালন করে, যেন তার আত্মার আত্মীয়, স্বজন মারা গেছেন। খুঁড়ে খুঁড়ে আনে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ। মঞ্চে দুমিনিট নীরবতা পালনের পর অক্টো বা ন্যানোজেনেরিয়ানের মৃত্যুতে কেউকেটা রুমালে শুকনো চোখ মুছে বলে, “দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলো।”

মধ্যে মধ্যে মনে হয় জিজ্ঞেস করি, বিখ্যাত শিল্পীদের কাছে তারা কী প্রত্যাশা করেন? অমরত্ব !!! তারা যে কাজ করে গেছেন, চর্চা করার জন্য সেটুকু কি যথেষ্ট নয়? নারায়ণ দেবনাথ আরও দেড়শো বছর বাঁচলেও কি এক‌ইভাবে আপনার আমার শৈশবকে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে কোটি কোটি বাঁটুল, নন্টেফন্টে আঁকতেন? এঁকেই যেতেন? লতা মঙ্গেশকর কি আগে আপনাকে বাড়িতে এসে গান শুনিয়ে যেতেন? আগেও রেকর্ড শুনতেন, আগামী দুশো বছরে সব ভারতীয় সেই রেকর্ড‌ই শুনবে। কেন একজন শিল্পীর মৃত্যুর পর তাকে সুষ্ঠু বিদায় আমরা জানাতে পারি না? গ্যাসে দুধ বসিয়ে একমিনিটের জন্য ঘাড় ঘোরালে যেমন দুধ উথলে ওঠে, আমাদের‌ও তেমন‌ই শোক ওথলায়। আক্ষরিক অর্থে দেওয়ালে দেওয়ালে শোকজ্ঞাপনের ঘুঁটে পড়ে।

আরেকদল অনন্য সাধারণ। তারা মৃত ব্যক্তির আজীবনের নেতিবাচকতা তুলে এনে বলে, ওনার মৃত্যুতে শোক পালন করবো? ছিঃ!! শিল্পীও যে মানুষ, তিনি যে রোবট নন, তার‌ও যে ঈর্ষা, লোভ বা অন্যান্য রিপু থাকতে পারে, তা আমরা মেনে নিতে পারি না। বিখ্যাত ব্যক্তির স্বভাব চরিত্র আচরণ হবে টাইড ডিটারজেন্টে পরিষ্কৃত চকচকে শুভ্র।

এরপর তো রাজনৈতিক কোন্দল আছেই। আমার বিরুদ্ধ ক্যাম্পের লোক ? মরেছে ? বেশ হয়েছে! শাঁওলি মিত্র মরুক বা আর কেউ, আমার কী! ভাইরে, নিজেরা জীবনে কতদূর সাদা কালো থাকতে পেরেছো হে যে মানুষের মৃত্যুর পরেও তার জীবনের আবছায়া খুঁজে ফুটেজ খাও?

তৃতীয় দল মীমমেকার বা গল্পকার। স্বর্গে সত্যজিৎ রায় বাঁটুলকে সংবর্ধনা জানাচ্ছেন, শাঁওলি মিত্র ইরফান খানের সাথে নাটক করছেন, এইসব অবাস্তব ছবি, কাল্পনিক কথোপকথন তারা আঁকেন, লেখেন। মানুষ সেখানে ‘ভিজে গেলাম ভাই’ বা ‘মুগ্ধতাবাসা’ জানিয়ে আসেন। সত্যি করে ভেবে দেখলে যেসব মানুষ মা/বাবা/ জীবনসঙ্গী/সন্তান বা অন্য প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তার বা তাদের শোকের পাশে এসব দেখনদারি এতো কৃত্রিম, রুচিহীন, এতো খেলো লাগে যে বলার নয়।

শোক বড় অন্তরের অনুভূতি। তাকে প্রকাশ করতে নেই। আর যদি করতেই হয় তবে তা রুচিশীল হোক। চ্যানেলে গায়ক-গায়িকাদের এনে লতার গানের দুই কলি গাইয়ে মানুষের আবেগে সুড়সুড়ি দেওয়া যায়, শোকপ্রকাশ হয় না। শোক প্রকাশের এই ন্যাকামিগুলো অসহ্য। খুব আপনজনের মৃত্যুর শোকপ্রকাশ মানুষ কষ্টে করে, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে করে। তখন তাদের আদর করে ভালোবেসে বলতে হয়, “যে গেল সে তো রেখে গেল স্মৃতির ভাণ্ডার, এই যথেষ্ট , সামলে ওঠো।”

বিখ্যাত ব্যক্তির মৃত্যুতে মনখারাপ হয়, পুরনো কথা, তার কাজ মনে পড়ে কিন্তু ওইটুকুই, ব্যস। আপনজন হারানোর বেদনা তাতে থাকে না। শোককে রিয়েলিটি শো নাইবা বানালেন। এতে করে বিখ্যাত শিল্পীদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন যেমন হয় না, তেমন‌ই আপনাদের নেতিবাচকতায় সেই মৃত ব্যক্তিটির কিচ্ছুটি আসে যায় না, হাইপ্রোফাইল শোকজ্ঞাপনের ভীড়ে হারিয়ে যায় শুধু অতিসাধারণ মানুষগুলির আপনজন হারানোর একান্ত ব্যক্তিগত শোকজ্ঞাপন, যারা কোনমতে সোশ্যাল মিডিয়ায় সামান্য প্রাণ খুলে কথা বলে নতুন করে শোক কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

একটু আবেগ সামলান মশাইরা, একটু চুপ করে থাকতে শিখুন, এতো মেকি শোকজ্ঞাপন করে সাধারণের আরও সাধারণ শোককে খেলো নাই বা করলেন।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.