সাজু বিশ্বাস:
মানুষের আয়ু খুব বেশি দিনের কিন্তু না। আশি নব্বই থেকে টেনেটুনে একশোর কাছাকাছি। এই বিরাট মহাবিশ্ব যখন কোটি কোটি বছরের বিষয় তখন একশো বছর কী এমন বেশি! অথচ পঞ্চাশ ষাট বছর পার হলেই মানুষ বুড়ো হয়ে যেতে থাকে। শুধু শরীরে নয়… ভেতরে ভেতরে মানুষের মনও নুইয়ে পড়তে থাকে। মন কুঁচকে যেতে থাকে শরীরের চামড়ার মতন! সেই সাথে ছোট হয়ে আসতে থাকে নিজের চিন্তার জগতও! বাহাত্তরে পৌঁছোতে পৌঁছতেই আশাপাশের মানুষ তাই বলা শুরু করে দেয় — বাহাত্তুরে…! খুব কম মানুষ নিজেকে নিজের জায়গায় ধরে রাখতে পারেন তখন।
দিনের চব্বিশ ঘণ্টা নিজের কোথায় কোন এঙ্গেলে কতটুকু গ্ল্যামার এখনো অবশিষ্ট আছে বা আগে ছিল সেই ছবিগুলো তুলে তুলে শেয়ার করেন আর মেয়েদের কোথায় কোন অধিকার কম হচ্ছে সেসব নিয়ে ইস্যু তৈরি করেন তিনি। আপাতঃ শুনলে মনে হবে সারোগেসি নিয়ে বিরাট আন্দোলন শুরু করে দিয়েছেন তিনি। এখনকার দিনে সারোগেসি কিন্তু বেশ মচমচে, কুড়মুড়ে ইস্যু! কারা করে এটা? রহিমা করিমনরা তো আর না! সহজ কথায় একজন মেয়ের গর্ভ ভাড়া করে নিয়ে নিজের বাচ্চা পয়দা করা। অনেক বেশি টাকা আর নিজের শরীর যাদের কাছে খুবই মূল্যবান, তারাই রহিমা, করিমনদের ভাড়া নিয়ে কাজটা করেন। বলিউডের নামি-দামি পরিচালক আর অভিনেতারা এই সুবিধার খরিদ্দার বেশি। প্রথমে নাসরিন এই ধাক্কাটা খেয়াল করেননি। তিনি বেশ জোরেশোরেই শুরু করতে চেয়েছিলেন… গরিবীর সুযোগ নিয়ে একটা মেয়ের গর্ভ ভাড়া নেওয়া অন্যায়! তার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা… এইবার সারোগেসি যখন নিক- প্রিয়াঙ্কা নামক ইন্টারন্যাশনাল জুটিতে গিয়ে ঠেকলো… তখনই তিনি সুর পাল্টাতে শুরু করলেন।
যাই হোক না কেন তাঁকে ইন্ডিয়াতেই তো থাকতে হবে।
নিজের জন্মভূমির মায়া এখনও প্রতিদিন অনুভব করেন তিনি। বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ি… ছোটবেলার কাজের বুয়া… বাংলা খাবার… বাঙালি আড্ডা, সব মিস করেন তিনি। পাশের দেশ ছাড়া কাছাকাছি সেই জীবনের আস্বাদ আর কোথায় আছে পৃথিবীর! কোথাও না। কলকাতা তো এমনিতেই তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে, বাকি দিল্লী, মুম্বাই। নিজেকে নাস্তিক সেক্যুলার এবং নারীবাদী বলেন তিনি। কিন্তু মোদীজীকে সাপোর্ট করতে ভোলেন না। প্রিয়াঙ্কা প্রশ্নেও তাই তিনি তাড়াতাড়ি বড় আন্দোলনের সুর গুটিয়ে ফেলেন। না, না আমি গর্ভ ভাড়া নিয়ে আন্দোলন করছি ঠিক আছে, কিন্তু প্রিয়াঙ্কার বাচ্চা হওয়া নিয়ে আমি কিছু বলিনি! এই দেখো প্রিয়াঙ্কার সাথে আমার কী ভালো সম্পর্ক! … বলেই কয়েক বছরের পুরনো টুইট কপি করে ফেসবুকে টাঙিয়ে রাখেন। তাতে প্রিয়াঙ্কা বলছে, তসলিমা ভালো রাইটার, তসলিমা বলছেন- প্রিয়াঙ্কা অন্যদের মতো কনজারভেটিভ অভিনেত্রী নন… শী ইজ ডিফারেন্ট— ব্যস্! খেল খতম! তাইলে সারোগেসি আন্দোলন কই গেল? প্রিয়াঙ্কার টাকা আছে, শরীর দরকার… শিল্পার টাকা আছে, শরীর এবং বাচ্চা দরকার… শাহরুখ… করণ জোহর… কয় কয় জনের নামে সুপারিশ লিখবেন তসলিমা নাসরিন! অতএব গরীব মেয়ের গর্ভভাড়া আন্দোলন বাতিল।
এইবার লুঙ্গি আন্দোলন কয়দিন চললো…
এমন মনে হতে লাগলো লুঙ্গি কেবল বাঙালি পুরুষদের নিম্নাঙ্গ চুলকানিতে বিশেষ সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছে! আদতে তা না কিন্তু। মোটেই তা না। মানুষ প্রথম যখন নিজেকে আচ্ছাদন করার চেষ্টা করা শুরু করলো তখন বিশেষ গুরুত্ব বুঝে শরীরে নীচের অংশ ঢাকা শুরু করলো। সে কী নারী, কী পুরুষ! তা সেই গাছের বাঁকল কিম্বা পশুর চামড়া পরার সময়ই ধরেন, আর গ্রিক কিম্বা রোমান সভ্যতার সময়ই ধরেন। দুটো আলাদা টুকরো কাপড় একখণ্ড উপরে জড়ানো, আরেক খণ্ড নিচে জড়ানো… এই হলো দর্জিবিহীন সবচেয়ে সহজ পোশাক। দর্জি শব্দটার সাথে মনে এলো লুঙ্গি কিন্তু বাঙাল শব্দ নয়। বার্মিজ শব্দ। মিয়ানমারের জাতীয় পোশাক লুঙ্গি। যদি বাঙালিই ধরেন, ধুতি মালকোঁচা কাছা… এইগুলো ছিল বাঙালির। কিন্তু কাজের কাজ কী হল! তসলিমা ম্যাডামের কাছে লুঙ্গির দায়ে গালাগালি খেয়ে গেল বাঙালি পুরুষরা।
এতে অবশ্য তেমন কিছু বড় অসুবিধে হয়ওনি। বাঙালি পুরুষেররা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই লুঙ্গি তৎক্ষণাৎ পুনরুদ্ধার করে নিয়েছেন বলা যায়।
কিন্তু তসলিমা নাসরিন ঘুরপাক খেতে খেতে আটকে গেছেন অন্য জায়গায়। মৌলভীবাজারের এক মেয়ে আমেরিকায় গিয়ে শার্ট-প্যান্ট পরেছেন বলে তার পরিবারকে একঘরে করতে চেয়েছিল স্থানীয় লোকজন। তসলিমা বরারবের মতন অশিক্ষা আর ধর্মান্ধতা নিয়ে বলছিলেন। ছোট্ট একটা কথা বলি, — ধর্মান্ধতা আর মৌলবাদ শব্দ দুটি কিন্তু ভালো বৈশ্বিক বাজারজাতকরণ পণ্য হয়ে উঠেছে। তো, সেই কথা বলতে বলতে ম্যাডাম সটান খালে গিয়ে পড়লেন! মাত্র কয়েকদিন আগে তেইশ চব্বিশ বছরের একটি তরুণী মেয়ের ছবি ঝড় তুলেছিল মানুষের মনে। সেই সাথে একটি ছোট্ট অডিও রেকর্ড। তসলিমা নাসরিন কি তাহলে সেই অডিও রেকর্ডের গালাগালিটি শুনতে পাননি! সাধারণত মেয়েদের জন্য যেসব গালি পুরো সমাজ রেডি করে রাখে… সেইসব গালাগালিই লোকটি করছিলেন ঐ মেয়েটিকে। মেয়েটি টাকা এবং ক্ষমতার সামনে দিশে বিশে না পেয়ে আত্মহত্যা করে নিয়েছিল। কয়েকদিন যেতে না যেতেই খবরে বলতে লাগলো পরীমনির দুবাইয়ের ছবিতে পাশে বসা লোকটি তিনিই। লোকটির বউ এইবার ঊর্ধ্বশ্বাসে দুবাই ছুটলেন। এদিকে পরীমনি আবার আমাদের জাতীয় মানবাধিকারের প্রতীক!
যাহোক, মেয়েদের পোশাকের স্বাধীনতা নিয়ে বলতে বলতে মৃত সেই মেয়েটির মুখটা একদম ভুলে গেলেন তসলিমা নাসরিন। এবং দেশের শিক্ষিত ধনবান হৃদয়বান মানুষের উদাহরণ হিসেবে সেই লোকটিকে এতো দারুণভাবে উপস্থাপন করে ফেললেন। এত্তো বড়লোক একজন মানুষ! তিনি তার জন্মদিনে পরিবার পরিজন বাদ দিয়ে এতিমদের সাথে বসে খাবার খেয়েছেন। রাজারা তাই করেন আর কী! রাজারা আরো একটা কাজ করেন, — সৈন্য অমাত্য ভাঁড় এগুলো পোষার পাশাপাশি কবি শিল্পী লেখকও পোষেন। তা না হলে রাজা যে একদা রাজা ছিলেন এই কথা কালে কালে মানুষ জানতো কেমনে! জানবে কেমনে! আপনি এক কাজ করেন না কেন, — বয়স হয়েছে, এখন অধিকার আদায়ের ইস্যু থেকে অবসর নেন। তার চেয়ে বরং রাজাদের পালিত লেখক হন এখন। বেশ ভালো নিরাপদ জায়গা ওটা।