মহসিন সাহেবের মৃত্যুর দায় কার?

দিনা ফেরদৌস:

সমাজের মানুষ হিসেবে পরিবারের বাইরেও সমাজের প্রতি আমাদের কিছু দায়-দায়িত্ব আছে, তেমনি আছে নিজের প্রতিও। নিজে ভালো থাকলে, পরিবারকে ভালো রাখা যায়। পরিবারকে নিয়ে ভালো থাকলে সমাজকেও ভালো রাখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পরিবারে অসুখী ব্যক্তিরাই সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তাই সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

আজকাল প্রায়ই দেখা যায় সন্তানদের কোন ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটলেই আমরা বলি, মা-বাবা সন্তানদের সময় দেয়নি, বা সঠিক শিক্ষা দেয়নি, ঠিক তেমনি বৃদ্ধ মা-বাবার কিছু ঘটলেও আমরা বলি সন্তানরা সঠিক যত্ন নেয়নি। অন্যদের ব্যাপারে জাজমেন্টাল হওয়ার আগে আমাদের বুঝতে হবে প্রতিটি মানুষেরই কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক মা-বাবা দুজনের আয়ে একটি সংসার চলে। বাইরে কাজ করতে গিয়ে অনেক মা-বাবা বাচ্চাদের সময় খুব একটা দিতে পারেন না। যাদের বাসায় দাদী, নানী নেই কিংবা বাচ্চাদের দেখার মতো আলাদা কেউ নেই, তারা বাচ্চাদের ডে কেয়ার কিংবা এক্সটেন্ডেড ডে কেয়ারে রাখেন বাধ্য হয়ে। আমরা দূর থেকে বিশেষ করে মায়েদের দোষারোপ করে বলি, বাচ্চার থেকে কী চাকরি বড় হয়ে গেল যে বাচ্চাকে অন্যের কাছে রেখে চাকরি করতে হয়! যাদের বাস্তবতা সম্পর্কে আমরা জানি না। বাড়তি আয়ে বাচ্চা যখন ভালো কোচিংয়ে যায়, ইচ্ছেমতো খেলনা বা শখের জিনিস কিনে, ভালো ভালো খায় এবং গর্ব করে বলে আমার মা চাকুরিজীবী, তখনও কিছু বাচ্চা আফসোস করে, কিছু মায়েরা আফসোস করেন (সবার কথা বলছি না)। ঘটনা দুর্ঘটনা হতেই পারে যে কারো বাচ্চার সাথে। ডে- কেয়ারে না গিয়েও মা-বাবা সারাক্ষণ খেয়াল রাখার পরেও স্কুলে গিয়ে দেখা গেলো, বুলিং এর কারণে বাচ্চাটা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অথবা পরিবার থেকেও হয়। তাই বলে সারাক্ষণ বাচ্চার পিছনে সময় দিতে গিয়ে নিজের জীবনের স্বাদ আহ্লাদ ভুলে গেলে চলবে না কোনো মা-বাবার। মা-বাবা হওয়ার বাইরেও তারা আলাদা মানুষ।

কোনকিছু নিয়েই অতিরিক্ত চাপ নেয়া উচিত না কারোই। সন্তান হোক বা পিতামাতা তাদের প্রতি দায়-দায়িত্বের বাইরেও ব্যক্তির নিজের প্রতিও নিজেকে ভালো রাখার কিছু দায়িত্ব আছে। অনেক মা-বাবাকেই বলতে দেখা যায়, তোদের দিকে খেয়াল করতে গিয়ে যৌবন, জীবন, অর্থ, সময় সবই শেষ করেছি, নিজের দিকে তাকানোর সময় পাইনি। কথাটি সত্য। বেশিরভাগ মা-বাবাই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি নিজেরা উপভোগ না করে বাচ্চাদের পিছনে খরচ করেন। যার ফলে সন্তানদের উপরে প্রত্যাশা দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

কেউ কেউ কঠিন অত্যাচারও করেন বাচ্চাদের উপর। মা-বাবার পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়তে হবে, মা-বাবার পছন্দের পাত্র-পাত্রীকে বিয়ে করতে হবে। এমনকি ছেলে বিয়ে করানোর পর দেখা যায়, সারাজীবন নিজে চা করে খেয়েছেন, কিন্তু ছেলে বউ যদি একবার চা করে না দেয় তো দুনিয়া শুদ্ধ লোক জানে ছেলেবউ শ্বশুর শাশুড়ির যত্ন নেয় না। কিন্তু ঘরে ছেলের বউয়ের বয়সী নিজের মেয়ে থাকলে দেখা যায়, ওরে গ্লাসে পানি ঢেলে দিচ্ছেন সেই মা’ই। নিজের মেয়ে রান্না না পারলে সমস্যা নেই, কিন্তু ছেলেবউ না পারলে তার বাপের বাড়ির চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করা হয়। ছেলে পড়াশোনার জন্যে বা চাকরি করতে অন্য শহরে বা দেশের বাইরে গেলেও সমস্যা হয় না। কিন্তু বিয়ে করে আলাদা থাকতে চাইলেই সমস্যা দেখা দেয়। পরিবারে বউ শাশুড়ির যুদ্ধ থেকে বাঁচতে নিরীহ ছেলে যখন বউ নিয়ে আলাদা হতে চায়, তখন বলা হয়, বউ ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে। ছেলেমেয়ে দূরে গেলে মা-বাবার কষ্ট লাগতেই পারে, কিন্তু অত্যধিক লাগার কারণ হচ্ছে অত্যধিক প্রত্যাশা।

অনেকে বলবেন যৌথ পরিবার ভালো, এতে করে বাচ্চারা পরিবারে দাদা-দাদীর সঙ্গ পায়। বলবো এই যুগে এই চিন্তা করাটাই ভুল। এখনকার ছেলেমেয়েরা সারাদিন গেইম, মোবাইল/ট্যাব, ভিডিও বানানো এইসব নিয়েই থাকতে বেশি পছন্দ করে। আর তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে, একটা বাচ্চা অন্য বাচ্চাদের সঙ্গ যতোটা উপভোগ করে, দাদী-নানীদের সাথে ততোটা সম্ভব না। প্রতিটি বয়সের কিছু চিন্তা-ভাবনা আছে, সমস্যা আছে, গল্প বা মজা করার আলাদা বিষয় আছে, যা অন্য বয়সের মানুষের পক্ষে বুঝতে পারা কঠিন। বাচ্চারা হইহট্টগোল করে যে মজা পায়, ষাট, সত্তর বছরের দাদা-দাদীর কাছে তা ভালো নাও লাগতে পারে। আবার দাদী-নানীদের মুরুব্বীয়ানা কথায় বাচ্চাদেরও বিরক্ত লাগতে পারে। তাই বাচ্চারা বাচ্চাদের সঙ্গই বেশি উপভোগ করে, যেমন করে টিনেজার’রা উপভোগ করে অন্য টিনেজার’দের সঙ্গ। একইভাবে বয়স্করাও ভালো বুঝে অন্য বয়স্কদের সমস্যা বা ভালোলাগা।

কিছু কথা আছে প্রয়োজনে বলতে হয়, আর কিছু কথা আছে, বললে নিজেকে হালকা লাগে। দুই পক্ষের সমস্যা বোঝার জন্যে কিছু বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান থাকা চাই। সাত বছরের একটা বাচ্চা যেমন চৌদ্দ বছরের টিনএজ এর সমস্যা বা মজা বুঝবে না, তেমনি ৩০/৩৫ বছরের ছেলে-মেয়েও ৬০-৭০ বছরের মা-বাবার সমস্যা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও পুরোটা আন্দাজ করা কঠিন। আর অবসর জীবনে অফুরন্ত সময় থাকলেও ৩০/৪০ চল্লিশ বছরের ছেলে-মেয়ে বা টিনএজ নাতি-নাতনিদের হাতে এতোটা অফুরন্ত সময় নেই, সেটাও বুঝতে হবে। তাদের কাজ করতে হয়, ঘরে অথবা বাইরে। এক কথায় এই ব্যস্ততার কারণেই এই দুই দলের জীবন যাপন আলাদা। খাওয়া-দাওয়া, শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনার বাইরে, বয়স্কদের সাথে আলাপ জমানোও সম্ভব না। আর বেড়াতেও তো প্রতিদিন নিয়ে যাওয়া সম্ভব না, কারণ কাজ করে তারাও ক্লান্ত হয়, এক সময় যেমন ক্লান্ত থাকতেন মা-বাবারা।

যার জন্যে প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব কিছু কাজ থাকা প্রয়োজন। এজন্যে সবাইকে যে খুব উচ্চ শিক্ষিত হবে তা নয়, মানুষের জন্যে বা সমাজের জন্যে কিছু করতে চাইলে ভলান্টিয়ার হিসেবেও কিছু কাজ করা যায়। এখন বলবেন, বৃদ্ধ মানুষের কী কাজ! কাজ করতে চাইলে কাজ আছে, আর না করতে চাইলে ছেলের বউয়ের পিছনে, পাশের বাড়ির মেয়ের পিছনে, মেয়ের সংসার নিয়ে নাক গলানোই যায়। আর কিছু না থাকলে কারো সঙ্গ না পেলে ওল্ড হোমে যাওয়াই যায়। ওইখানে ভালো নার্সিং পাওয়া যায়, সারাক্ষণ কেউ না কেউ খোঁজ নেবে, নিজের বয়সী অসংখ্য বেকার আছে অফুরন্ত সময় নিয়ে, তাদের সাথে চাইলে গল্পও করার সুযোগ আছে । একা ঘরে মরে পড়ে থাকার ভয়ও থাকবে না। কিন্তু এইটা আবার পছন্দ না। বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্যে ডে কেয়ারে দিতে পারলে বৃদ্ধ মা-বাবাকে নয় কেন?

সন্তান জন্মের উদ্দেশ্যই যদি হয় মা-বাবাকে দেখাশোনা করা তো বলার কিছু নেই। অনেক মেয়েকে দেখেছি মা-বাবাকে দেখার কেউ নাই, বলে বিয়ে করছে না। অনেক ছেলেকেও দেখেছি তার মা-বাবাকে যত্ন করছে না বলে বউ ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু নিজের বোন, মানে মেয়ে বাপ -মাকে নিজের কাছে রাখতে পারছে না, নিজের শ্বশুর শাশুড়ির ভয়ে। এতে কি মা-বাবার খুব ভালো লাগে?

আমাদের সমাজ মনে করে বাচ্চা জন্ম দিয়ে বাচ্চাকে উদ্ধার করে ফেলছেন এখন মা-বাবারা। এখন সেই বাচ্চার জীবন উৎসর্গ করতে হবে মা-বাবার জন্যে। কিন্তু আসল ঘটনা হচ্ছে, উল্টো মা-বাবাই উদ্ধার হোন বাচ্চা জন্ম দিয়ে। একটা বাচ্চার জন্যে দুনিয়া উলট-পালট করে দেন। ডাক্তারের উপরে ডাক্তার, দেশ -বিদেশ কোথাও বাকি থাকে না। টাকা থাকলে টেস্ট টিউব বেবি থেকে শুরু করে সারোগেসি পদ্ধতিতে পর্যন্ত বাচ্চা জন্ম দিচ্ছেন। আর বাচ্চা না হলে সেই সমাজের মানুষই কথা বলতে ছাড়ে না।

তাই আমার মেসেজ হচ্ছে, বাচ্চা জন্ম দিন। বাচ্চার যত্ন নেয়ার পাশাপাশি নিজেদেরও শারীরিক, মানসিক যত্ন নিন। একবেলা বাচ্চা কম খেলে দুনিয়া উল্টে যাবে না। পাশের বাসার ভাবির সাথে কম্পিটিশন করে পাঁচ হাজার টাকার জামা না দিয়ে, পনেরশো টাকা দিয়ে জামা দিন। আর তার থেকে বাঁচিয়ে কিছু টাকাকড়ি নিজেদের জন্যেও আলাদা করে রাখুন। বাচ্চা মানুষ করুন, রোজগারি বানান, পাঁচ হাজার টাকার ব্রান্ডের জামা যেন নিজের রোজগারে কেনার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। জীবনটা খুব ছোট, তাছাড়া শরীর স্বাস্থ্যও সবসময় একই রকম যাবে না। তাই বাচ্চাদের জন্যে টাকার পিছনে না দৌড়ে নিজেদের কিছু আলাদা সময় দিন। নিজের ভালো লাগার জন্যে কিছু করুন।

মহসিন সাহেব আলাদা একজন মানুষ। আটান্ন বছর বয়স খুব একটা বেশি না, কিন্তু তিনি অসুস্থ ছিলেন। শারীরিক/মানসিক দুইভাবেই অসুস্থ ছিলেন, কিন্তু অচল ছিলেন না। ভলান্টিয়ারি বলেও কিছু কাজ আছে আমাদের সমাজে, তিনি চাইলে সমাজসেবামূলক বহু কাজ করতে পারতেন। টাকা পয়সা আছে, চাইলে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারতেন। বহু মানুষ দিনের পর দিন বিছানায় পড়ে থেকেও বাঁচতে চায়, হাত -পা হারিয়ে, পোড়া শরীর নিয়েও বাঁচতে চায়। কামড় খেয়ে বেঁচে থাকতে দম লাগে।

অনেকেই বলেন মরতে সাহস লাগে, আমি বলি পালিয়ে বেড়াতে সাহস নয়, কাপুরুষতা লাগে। মহসিন সাহেবের মৃত্যুতে অনেকেই নায়ক রিয়াজকে দোষারোপ করছেন। কিন্তু নায়ক রিয়াজের কিইবা করার ছিল। সে তো কাজ করে খায়। যারা তাকে দোষারোপ করছেন, তাদের ক’জন সারাক্ষণ নিজের মা-বাবার পাশেই বসে থাকেন? আর মেয়ে সেও তো সংসার করে। অনেকে বউকে দোষারোপ করছেন। তারা কি জানেন বউয়ের সাথে মহসিন সাহেবের দাম্পত্য জীবন কেমন ছিল? অন্যের সংসারের বিষয় নিয়ে কথা বলা উচিৎ না, সঠিক কিছু না জেনে। তবে মহসিন সাহেবের সমস্যা শুধু একাকিত্বও নয় বরং বাইরে অনেকবার টাকা পয়সা নিয়ে অনেকের কাছে ধোঁকা খেয়েছেন বলেও জানা যায়। হয়তো এমনও হতে পারে পরিবারের লোকজন আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন, বাইরের লোকজনদের বিশ্বাস না করতে, মহসিন সাহেব বিশ্বাস করে বার বার লস খেয়েছেন দেখে, পরিবারের লোকজনেরও তার উপর অভিমান থাকতে পারে। হতে পারে তাকে বার বার না করার পরও তিনি কারও কথা না শুনে নিজের মতো চলতে চাইতেন। আর নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার কিছু দায় তো আছেই নিজের। সবই অনুমান, কারণ আমরা জানি না কিছুই। তাই না জেনে কারও বিষয়ে মন্তব্য কিংবা কাউকে দোষারোপ করার অধিকার আমাদের কারও নেই।

তাই আমাদের উচিৎ বুঝে শুনে কথা বলা। আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়, বরং এতে পুরো সমাজে বিরূপ প্রভাব পড়ে। আমাদের দায়িত্ব আশেপাশের মানুষকে বেঁচে থাকার জন্যে উৎসাহিত করা। মানুষের বিপদে পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। বেশিরভাগ মানুষই প্রতিদিন বহু কষ্ট করে জীবন যাপন করছে বেঁচে থাকার আশায়, আত্মহত্যা তাদের বেঁচে থাকাকে নিরুৎসাহিত করে।

আর যারা আত্মহত্যা হলেই বড় বড় কথা বলেন, তারা কয়জন আশেপাশের কষ্টে থাকা লোকজনের খবর জানেন, জানলে পাশে গিয়ে দাঁড়ান? নিজের দৈনন্দিন কাজ ফেলে গিয়ে পাহারা দেন? কিছু একটা হলে, কার দাঁড়ানো উচিৎ ছিল, তাই নিয়ে কটুক্তি করে দায় ঝেড়ে ফেলেন। আর এইভাবে পরিবারকে দোষারোপের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে আত্মহত্যাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কারও পরিবারের প্রতি ক্ষোভ থাকলে, সমাজের প্রতি রাগ থাকলে, আত্মহত্যা করে সমাজের চোখে পরিবারকে দোষী বানিয়ে, পুরো সমাজকে প্রশ্নবোধক করে শান্তি দিয়ে যাবে সারা জীবনের জন্যে। বরং আত্মহত্যার প্রবণতা থাকলে, তাদের মানসিক চিকিৎসার প্র‍য়োজন। আর তার দায়িত্ব পরিবার, সমাজ আমাদের সবার, যারা বিষয়টি কোন না কোনভাবে জানতে পারি। মহসিন সাহেবের পরিবারের প্রতি সমবেদনা রইলো। মহসিন সাহেবের প্রতিও দোয়া রইলো।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.