কনসিলার

নাজনীন পারভীন:

ঘুমের মধ্যে কেমন একটা দম বন্ধ লাগতে লাগলো জয়িতার। মনে হচ্ছে কেউ তার গলা টিপে ধরেছে। এটা কি স্বপ্ন দেখছে জয়িতা? দমবন্ধ ভাবটা আরো বেড়ে গেলে ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলে দেখলো, না সে কোন স্বপ্ন দেখছে না। তার স্বামী আসিফ তার গায়ের উপর চড়ে বসে গলা টিপে ধরেছে। জয়িতা ঢুলঢুলে চোখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কয়েক মুহূর্ত। গলায় চাপের পরিমাণ বাড়তে থাকায় তন্দ্রাভাব উবে গেল নিমিষেই। বাঁচার তাগিতে আসিফকে ধাক্কা দিল। একটা ছেলে মানুষের শক্তির সাথে পারা অতটাও সহজ নয়। প্রথম ধাক্কায় একচুলও নাড়াতে পারলো না আসিফকে। এরপর জয়িতা সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিলে আসিফ শরীরের উপর থেকে গড়িয়ে বিছানায় পড়লো। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে নাইট গাউনে পা বেঁধে মেঝেতে পড়ে গেল জয়িতা।

আসিফ এবার বিছানা থেকে নেমে এসে মেঝেতে বসে মেঝেতে পড়ে থাকা জয়িতাকে এলোপাতাড়ি মারতে লাগলো। আসিফের আক্রমণ থেকে বাদ গেল না জয়িতার চোখ-মুখ কোনকিছু। একসময় ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিল জয়িতাকে। জয়িতার চোখে তখনও বিস্ময় আর আতংকের ছাপ। বিস্ময়ের কারণ আসিফের এই নতুন রুপ আর আতংকিত তার সহিংসতার মাত্রা দেখে। বিশ বছরের সংসার জীবনে অনেকবার অনেককিছু নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। ঝগড়া-ঝাঁটি দিয়ে শেষ হয়েছে কখনও, কখনও জয়িতার বাবা-মার হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়েছে, কখনো বা মিল হয়েছে আসিফের বোন-দুলাভাইয়ের সহায়তায়। বেশ কয়েকবার বাসা থেকে বের হয়ে অন্য জায়গায় থেকেছেও আসিফ কিছুদিনের জন্য। আবার রাগ পড়ে গেলে জয়িতার কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু কখনও গায়ে হাত তোলেনি। কিন্তু আজ তো সে মনে হচ্ছিল মেরেই ফেলবে জয়িতাকে।

কী হয়েছে আসিফের? গতকাল রাতে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত তো সব ঠিকই ছিল। নতুন কোন কিছু নিয়ে ঝমেলা নেই, যে যার চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। তবে কেন এতো হিংস্র হয়ে উঠলো আসিফ? জয়িতার মনের ভাব বুঝতে পেরেই কিনা তবে আসিফ গজগজ করে বলতে শুরু করলো:
আমাকে আর ভালো লাগে না, তাই না? মনের সব দুঃখ-কষ্ট কার জন্য ডায়েরিতে লিখে রাখা হচ্ছে? আর এই যে অসংখ্য ভালোবাসার কবিতা এগুলোই বা কার জন্য? দুবছর আগের সেই নাগর ফিরে এসেছে? নাকি ইনি নতুন সংযোজন?

এরকম আরো অজস্র বাজে কথা বলে চললো আসিফ। এবার একটু একটু করে বোধগম্য হচ্ছে জয়িতার। নিশ্চয়ই আসিফ কাল রাতে জয়িতার ডায়েরি খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু সেটা তো বেশ গোপন জায়গায় রাখে জয়িতা। সেটার সন্ধান পেল কীভাবে আসিফ? ডায়েরিতে অনেক না পাওয়ার কথা লেখা আছে, সেটা হয়তো ভালো লাগেনি আসিফের। বেশিরভাগ পুরুষরাই তো ভাবে মেয়েদের বাড়িতে এনে দুমুঠো ভাত আর কাপড়-চোপর দিলেই তার দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল। কিন্তু আসিফ তো একজীবনে সেটুকু দায়িত্বও পালন করেনি। বাচ্চাদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের টিউশন ফিস কত সেটা জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারবে না সে। বাড়ির বাজার থেকে শুরু করে প্লাম্বার পর্যন্ত জয়িতার মাথাব্যথা। আসিফ হলো এ বাড়ির তথাকথিত হেড, জয়িতার ছেলেদের বাবা আর জয়িতার জন্য একটা সাইনবোর্ড। যার নিজের জীবন চলে নিজের ইচ্ছেয়। সারাদিন অফিস শেষ করে বাসায় এসে হয় মোবাইল, নয়তো টেলিভিশন। বড় জোর মাসে একবার কী দুবার বউ-বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে ঘুরতে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া আর শপিং। কিন্তু জয়িতাদের রোজকার জীবনে আসিফের ভূমিকা বড়ই নগণ্য।

আসিফ নিজের জীবনেও যে খুব স্থির, তাও না। প্রাইভেট মেডিক্যাল থেকে পাশ করে ডাক্তারি না করে এনজিওতে কাজ করে। সেটাও এক জায়গায় বেশিদিন নয়। আবার বছরের অনেকটা সময় কোন কাজই করে না। নিজের গাড়ি নিয়ে ঘুড়ে বেড়ায় তখন বিভিন্ন জায়গায়। সেই আসিফ মাঝ রাতে জয়িতাকে মেরে তার স্বামীত্ব ফলানোর চেষ্টা করছে। জয়িতা নিজেই নিজের সাথে কথা বলে উঠলো:

অনেক তো হলো জয়িতা, এবার নিজের দিকে ফিরে তাকাও। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, এখনও যদি নিজের মতো করে না বাঁচো তবে আর কবে? এই অসংখ্য না পাওয়া নিয়ে কবরে যাবার কী মানে? তবে কীসের জন্য প্রতিক্ষা করছে সে? সেই প্রথম জীবনের আসিফের? নাকি অন্য কাউকে যে জয়িতার মনের কথা বুঝবে?

বেশ কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো জয়িতা। নিজের চেহারা দেখে চমকে উঠলো সে। চোখের উপরে, পাশে, চিবুকের হাড়ের উপর কেটে- ফুলে বীভৎস দেখাচ্ছে জয়িতাকে। আয়নার মধ্য দিয়ে আসিফের দিকে তাকালো জয়িতা। তাকে ঠিক মানুষ মনে হলো না জয়িতার কাছে, মনে হলো হিংস্র কোন পশুর মতো। যে এখনও তাকিয়ে আছে তার শিকারের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। এই কি সেই আসিফ যে জয়িতার মুখ এক মুহূর্ত দেখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুর রহমান হলের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতো? আজ সেই চেহারা কী অবলীলায় নষ্ট করার উল্লাসে মত্ত।

সময়টা ছিল বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, তখন সবেমাত্র মোবাইল ফোন সাধারণ মানুষের হাতে আসতে শুরু করেছিল। জয়িতার বাবা কিনে দিয়েছিল মেয়ে দূরে থাকে বলে। তখনও আসিফের কোন ফোন ছিল না। একবার যে কণ্ঠস্বর শোনার জন্য দীর্ঘ সময় রাস্তায় অথবা কলেজের টেলিফোন বুথের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো, আজ সেই একই কণ্ঠ চিরতরে রোধ করতে একটুও হাত কাঁপলো না আসিফের। ভালোবাসা কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে, জয়িতা তা আগেই বুঝতে পেরেছিল। তবে ভালোবাসা যে কখন ঘৃণায় পরিণত হয়েছে যেটা বুঝতে পারেনি।

এই কি সেই আসিফ যার জন্য জয়িতা একসময় সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়েছিল? আসিফের পরিবার ভালো হলেও সমাজে প্রভাবশালী পিতা তার মেয়েকে প্রাইভেট মেডিক্যাল থেকে পাশ করা ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চায়নি। জীবন কি এমনই হয়? যার জন্য একসময় পৃথিবী ছেড়ে দেয়া যায়, অন্য একসময় সেই একই মানুষ অপরজনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে দ্বিধা করে না? অনেকবার জয়িতা ভেবেছে অসিফকে নিয়ে তার ফয়সালা করার সময় এসেছে, আবার তা বাদ দিয়েছে ছেলে দুটোর কথা ভেবে। হাজার হোক আসিফ তো ওদের বাবা। আর জয়িতার তো এতোকিছুর পরও আসিফের প্রতি ভালোবাসা কোথাও না কোথাও থেকে গেছে। কিন্তু আজকের আসিফের এই হিংস্রতা তাকে হয়তো সত্যি কোন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে। তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুরের মতো চোখ হারানোর আগে, কিংবা সাংবাদিকতা বিষয়ের ছাত্রী সুতপার মতো জীবন চলে যাবার আগে।

আয়নার ভেতর দিয়ে আসিফের দিকে তাকালো জয়িতা। আসিফের চোখ থেকে তখনও যেন আগুন ঝরছে। সেখানে ভালোবাসার কোন সিটে ফোঁটাও দেখতে পেল না জয়িতা। ঘরের মধ্যে কেমন অক্সিজেনের অভাব অনূভব করলো জয়িতা। ভাবলো কিছু সময়ের জন্য একটু ছাদে গিয়ে দাঁড়াবে। নিজের সাথে অনেক বোঝাপড়া আছে তার। দরজা খুলতেই আর একটা ধাক্কা খেল জয়িতা। সেদিনের জন্য আরও চমক বাকি ছিল তখনও। জয়িতার বড় ছেলে দরজার সামনে দাঁড়ানো, তার গালে তখনও চোখের পানির দাগ লেগে আছে। জয়িতার ছেলের জন্য বুকের ভেতর হা-হা করে উঠলো। ছেলেটার এসএসসি পরীক্ষা চলছে, কাল সকালে যার অংক পরীক্ষা, আর সে মধ্যরাতে বাবা-মার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। জয়িতার মুখের দিকে তাকিয়ে চট করে চোখ নামিয়ে নিলো তার ছেলে। হয়তো মায়ের এই বীভৎস চেহারা দেখার সাহস তার নেই। কিংবা সে হয়তো ভাবছে এই পরিস্থিতির জন্য সেও কিছুটা দায়ী! কারণ আসিফ যখন রাগ করে দিনের পর দিন বাইরে থাকে, তখন জয়িতা কোন এক সময় বলেছিল, কী হবে যদি আসিফ আর না আসে! তখন তাদের বড় ছেলে অনুরোধ করেছিল জয়িতাকে, যেন তাদের সম্পর্ক যাই হোক না কেন তারা যেন এক ছাদের নিচে থাকে তাদের ছেলেদের কথা ভেবে। ছেলেকে কিছু না বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল জয়িতা ছাদে যাবার জন্য। ছাদের মাঝখানে বসার একটা দোলনা আছে, সেখানে গিয়ে বসলো সে। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিল কয়েকবার। ধীরে ধীরে নি:শ্বাসের কষ্টটা কমে এলো। রাতের মৃদু বাতাস মুখের কাটা জায়গাগুলোতে জ্বালা করতে লাগলো। তবে তার এই শারীরিক কষ্টকে ছাপিয়ে তার মানসিক কষ্টটা প্রকট হতে লাগলো।

নাজনীন পারভীন

ভালোবাসা আসলে কী? ভালোবাসা হলো মায়া আর মোহের মেলবন্ধন। এর নির্দিষ্ট কোন অনুপাত নেই। কোথাও মায়ার পরিমাণ বেশি, আবার কোথাও মোহের পরিমাণ। যে সম্পর্কে মায়ার ভাগ বেশি থাকে সেই সম্পর্ক হয় মজবুত। সময়ের সাথে তা আরও অটুট হতে থাকে। আর যেখানে মোহের পরিমাণ বেশি, সেই মোহ দ্রুত শেষ হয়ে যায়। আর অল্প বিস্তর মায়া দিয়ে সেই সম্পর্ক টেনে নিয়ে যাওয়া দুস্কর হয়ে পড়ে। তবে কি আসিফের ভালবাসায় মোহের পরিমাণই বেশি ছিল? মায়া কম থাকায় সময়ের সাথে সাথে শেষ হয়ে গেছে? আর সে কারণেই এই সম্পর্ক আজ টানা-পোড়েনের শেষ সীমানায় উপস্থিত! একটু টানেই ছিঁড়ে যাবে? আর এই শেষ টানটা হয়তো জয়িতাই দেবে। পায়ের শব্দে ছাদের দরজার দিকে তাকালো জয়িতা। সেখানে আসিফ দাঁড়িয়ে, এগিয়ে এলো জয়িতার দিকে। প্রচণ্ড রাগ আর ঘৃণা নিয়ে বলতে লাগলো:

তোমার বড় ছেলে আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আজকাল। সে আমাকে জানিয়ে দিল যে আমাকে আর তোমাদের জীবনে প্রয়োজন নেই। এতোদিন তারা তোমাকে অনুরোধ করেছিল তাদের দুই ভাইয়ের জন্য আমাদের একসাথে থাকতে। কিন্তু এখন তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। তোমরা নাকি আমাকে ছাড়া ভালোই থাকবে। বাড়িতে যত অশান্তির কারণ নাকি আমি। এসব নিশ্চয় তুমি শিখিয়ে দিয়েছো। নাহলে এতোটুকু ছেলে এসবের কী বোঝে? তুমি শেষপর্যন্ত ছেলেদেরকে আমার বিরুদ্ধে লাগাচ্ছো? এতোটা নিচে নেমে গেছো তুমি? আজ আমি চলে যাচ্ছি, তবে আমি আবার আসবো, আমি তোমাকে এতো সহজে ছাড়বো না। মাইন্ড ইট।

জয়িতা একটা কথাও বললো না। আসিফকে জানানোর প্রয়োজন অনুভব করলো না যে আজকের এই অবস্থার জন্য জয়িতা না, আসিফ নিজেই দায়ী। ছেলেদের সাথে আসিফের না আঝে জাগতিক কোন বিষয়ের সম্পর্ক, না কোন আত্মিক যোগাযোগ। তাহলে কীসের জোরে এই সম্পর্ক টিকে থাকবে? শুধুমাত্র জিনের অধিকার আর কতই বা থাকতে পারে? জয়িতা কোথাও একটা পড়েছিল যে সম্পর্কেরও যত্নের প্রয়োজন আছে চারা গাছের মতো। গাছ যেমন পানি বা আলোর অভাবে নেতিয়ে যায়, সম্পর্কও তেমনি যত্নের অভাবে মলিন হতে থাকে। শুধুমাত্র রক্তের সম্পর্ক বা বৈবাহিক সম্পর্কের জোরে বেশিদিন সুসম্পর্ক এগিয়ে নেয়া যায় না।

আসিফ নেমে গেল ছাদ থেকে। চলে যাবে বাড়ি থেকে, এটা তার জন্য নতুন কিছু নয়। প্রতিবার তো যায় নিজের ইচ্ছায় আর আজ যাচ্ছে ছেলের কথায়। এই রাগ সে পুষে রাখবে। যাক, এসব নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাতে ভালো লাগছে না। হাসপাতালের কথা মনে পড়ে গেল জয়িতার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাইকোলজি নিয়ে পড়াশুনা করে আজ একটা বেসরকারি হাসপাতালের কাউন্সেলিং এর কাজ করে জয়িতা। মানুষের মনোজগতে তার বিচরণ, কাজটাকে সে খুব ভালোবাসে। কাউন্সেলিং পেশা হিসাবে নেয়ার স্বপ্ন নিয়ে জয়িতা পাশ করে দেখলো বেশিরভাগ হাসপাতালেই এই বিষয় নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই। বিশ বছর আগে সে যখন একটা হাসপাতালে জয়েন করে, তার কাছে মানুষ আসতো হাতে গোনা। সময়ের সাথে সাথে এই দৃশ্যের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এখন তার কাছে আসার সিরিয়াল পেতে সপ্তাহখানেক লাগে। অবস্থাভেদে কখনো বা মাসখানেকও সময় লাগে।

এখন অনেক হাসপাতালে কাউন্সিলার আছে, প্রচুর মানুষ প্রাইভেট প্রাকটিস করছে। তারপরও কাউন্সেলিংয়ের চাহিদা বেড়েই যাচ্ছে। প্রতিদিন প্রচুর মানুষের মনের কষ্টের কথা শুনতে হয় তাকে। নানা ধরনের প্রতিকারের ব্যবস্থার কথা বলে জয়িতা। আজ জয়িতার অবস্থান তার টেবিলের অপর পাশের কথা বলতে আসা মানুষের মতো। রোজ যেসব বলে অন্য সবাইকে যে নতুনভাবে পথ চলার জন্য অনুপ্রেরণা দেয়, সেইসব ভাবার চেষ্টা করলো জয়িতা। তার মনে হলো অন্যকে উপদেশ বা পরামর্শ দেয়াটা বেশ সহজ কাজ। কিন্তু সেই একই কথা নিজের জন্য মানা অতটাও সহজ নয়, যতটা এতোদিন জয়িতা ভাবতো। শরীরের ক্ষত শুকাতে বেশি সময় লাগে না। বাইরের আলো বাতাসে প্রাকৃতিক নিয়মে ক্ষত ভালো যায় সময়ের সাথে সাথে। কিন্তু মনের ক্ষত? সেখানে আলো বাতাসের কী ব্যবস্থা? অনেকের ক্ষেত্রেই ক্ষত শুকানোর বদলে আরো গভীর হতে থাকে। জয়িতা আপ্রাণ চেষ্টা করতো সেই সব মানুষের কষ্ট কমানোর। নিজের বেলায় এসে বুঝতে পারলো কেন অনেকেই এর মধ্য থেকে বের হতে না বা বের হতে অনেক সময় নেয়। কাছের মানুষের বদলে যাওয়া বা কাছের মানুষের দেয়া কিছু আঘাত মেনে নিতে অনেক মানসিক শক্তি লাগে। সবার হয়তো সেই মানসিক জোর থাকে না।

শরীরের ক্ষতের কথায় হঠাৎ জয়িতার তার কাজের মেয়েটার কথা মনে পড়লো। গত সপ্তাহে শেফালি কাজে করতে পারেনি। শেফালির স্বামী নেশার টাকা না পেয়ে তাকে প্রচণ্ড মেরেছে। শেষে টাকার জন্য কানের দুল কেড়ে নেবার সময় কানটা প্রায় ছিঁড়ে গেছে। জয়িতা তাকে ডাক্তার দেখানোর টাকা দিয়ে এক সপ্তাহের ছুটি দিয়ে দিয়েছে। আজ শেফালির সাথে নিজের পার্থক্য করতে পারলো না। সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থানের অনেক পার্থক্য করা যাবে সহজে। কিন্তু মানুষ হিসাবে স্বামীর কাছে অবস্থানের পার্থক্য আছে কি? শেফালিও তো সংসারের সব খরচ বহন করে জয়িতার মতো। হতে পারে জয়িতার হাত খরচ শেফালির পুরো সংসার খরচের চেয়ে বেশি। শেফালির সংসারেও তার রিক্সাওয়ালা স্বামী শেফালির জন্য একটা ছাতা মাত্র। যার কারণে বস্তির অন্য ছেলেরা তাকে ঘাঁটাবে না। সামাজিক-অর্থনৈতিক-শিক্ষা সব স্তরে বিস্তর ব্যবধানের পরও মেয়ে হিসাবে আজ তারা একই কাতারে দাঁড়ানো। কিছু বিষয়ে শেফালি জয়িতার চেয়ে এগিয়ে। শেফালি সহজেই জয়িতাকে সমস্ত ঘটনাটা বলতে পেরেছে, জয়িতা তাকে সাহয্য করেছে, এমনকি ছুটিও দিয়েছে। কিন্তু জয়িতা কাল অফিস গিয়ে কাউকে বলতে পারবে আজকের ঘটনাটা? জয়িতাকে তো এই চেহারা নিয়েই হাসপাতালে কিংবা ছেলের পরীক্ষার হলে যেতে হবে। তবে তার আগে কনসিলার দিয়ে সমস্ত মুখ ঢেকে, নিজের মুখের উপর আর একটা মুখোশ দিয়ে যেতে হবে লোক সমাজে।
মেকাপের এই ম্যাজিক উপকরণ আজ জয়িতার মতো উচ্চ পদস্থ মানুষের মুখের ক্ষতের দাগ লুকাতেও দারুণ ভূমিকা রাখছে। জয়িতার মনে হলো কনসিলারের মতো এমন কিছু থাকতো যা মনের দাগও লুকিয়ে ফেলতো নিমিষে! রাত প্রায় শেষের দিকে, কিছুক্ষণের জন্য হলেও ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে। ছেলের পরীক্ষার জন্য কাল হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়েছে জয়িতা। কিন্তু ছেলেকে পরীক্ষার হলে তো নিয়ে যেতে হবে। ছাদ থেকে নেমে এলো জয়িতা, ছেলের ঘরের সামনে গিয়ে আবার ফিরে এলো। ঘরের আলো নেভানো, হয়তো সেও জয়িতার মতো একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছে।

সকালে খাবার টেবিলে বড় ছেলের খাবার দিয়ে নিজে এক কাপ চা খেলো। ছোট ছেলে তখনও ঘুমে, গতকালের ঘটনাটা সে কিছুই জানে না। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, দশ বছরের একটা বাচ্চার এই সব বাস্তবতার মুখোমুখি করে কী লাভ! বড় ছেলে মাথা নিচু করে খাবার খেতে লাগলো। ওর জন্য খুব মায়া হলো জয়িতার। ছেলেটা বাবার কৃতকর্মের জন্য অপরাধবোধে ভুগছে। ওকে খাবার শেষ করে ড্রেস পরতে বলে নিজের ঘরে চলে এলো তৈরি হতে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চেহারার দিকে তাকালো জয়িতা। মুখের ফোলা ভাবটা ততক্ষণে অনেকটা কমে গেছে, রয়ে গেছে কাটা কয়েকটা দাগ। কনসিলার দিয়ে ভালোভাবে দাগগুলো ঢেকে মাস্ক আর সানগ্লাস পরে বাসা থেকে বের হলো। বড় ছেলে ইতিমধ্যে গাড়িতে উঠে গেছে। জয়িতা গাড়িতে বসলে ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করলো। সকাল তখনও আটটা বাজেনি। পরীক্ষা দশটায় হলেও ঢাকা শহরের জ্যামের কারণে এতো আগে রওনা দেয়া।

বাসা থেকে বের হতেই গলির মুখে একটা সিগন্যালে পড়লো জয়িতাদের গাড়ি। কাছেই কোন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে। অসংখ্য গার্মেন্টস কর্মী রাস্তা পার হচ্ছে, এদের বেশিরভাগই মেয়ে। সবাই যেন ছুটছে, কারণ আটটা পার হলেই লেট কাউন্ট করা হবে। হঠাৎ একটা মেয়ের দিকে চোখ আটকে গেল জয়িতার। মেয়েটার চোখের কোনা ফোলা আর কাটা। মেয়েটা যদিও মাথায় কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে। কী হয়েছিল মেয়েটার? হতে পারে মেয়েটা পড়ে গিয়েছিল ওয়াশরুমে বা অন্য কোথাও! হতে পারে ওর উপরও কেউ গতরাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পশুর মতো! মেয়েটা কনসিলার কী জিনিস হয়তো জানেও না। জানলে জয়িতার মতো সেও ক্ষতগুলো ঢেকে রাস্তায় নামতো। যারা রাস্তা পার হয়ে ছুটছে পোশাক তৈরির কারখানার দিকে তারা বেশিরভাগই ঢাকা শহরের বাইরের মানুষ। নিজে উপার্জন করে ভাগ্য পরিবর্তন করার লক্ষ্যে নিজের বাড়ি ছেড়ে কোন একটা বস্তিতে জায়গা নেয়। অর্থনৈতিক মুক্তি হয়তো কিছুটা মিলেছে, কিন্তু মানুষ হিসাবে সামাজিক স্বীকৃতি মিলেছে কি? সিগন্যাল ছেড়ে দিলে গাড়ি আবার চলতে শুরু করে। মেয়েটা হারিয়ে গেল পথের বাঁকে। জয়িতার নিজেকে এই ভীড়ের একজন বলে মনে হলো, যাকে আলাদা করে চেনা সত্যিই খুব কঠিন।

ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে একটা নামকরা কফি শপে গিয়ে বসলো। পরীক্ষা শেষ হতে দুই ঘন্টা লাগবে, এই সময়টুকু সে এখানেই কাটিয়ে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে। এই কফি শপে আসিফ আর জয়িতা মাঝে মাঝেই আসে, আর সকালে তেমন ভীড় না থাকায় জয়িতার সময় কাটাতে তেমন অসুবিধা হয় না। কফি শপের একটা ছেলে এসে বললো-
ম্যাম, উড ইউ লাইক টু হ্যাব ইওর ফ্যবারেট ক্যাপুচিনো?

এটা তার কখনোই পছন্দের ছিল না। কিন্তু আসিফ কখনো জয়িতাকে জিজ্ঞাসাই করতো না যে সে কী খেতে চায়। কফিশপে ঢুকেই অর্ডার করে দিতো নিজের পছন্দ মতো। সে বললো,
নো, রেগুলার কফি উইথ সুগার এন্ড ক্রিম।

নতুন করে পথ চলার শুরুটা না হয় হোক তার পছন্দের কফি দিয়েই।

নাজনীন পারভীন
সহকারী রেজিস্ট্রার
ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন: