পাহাড়ি জাতীয়তাবাদ ও নারী প্রশ্ন

ডালিয়া চাকমা:

এই লেখাটা সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের ফেসবুকবাসীদের চায়ের কাপে ঝড় তোলা ইস্যুটা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অবজারভেশন।
পাঁচটা কেইস দিয়ে আমার কথাগুলো শুরু করতে চাই।

কেইস ১: এক চাকমা নারী স্বেচ্ছায় এক বাঙালী পুরুষ বিয়ে করার পর ত্যাজ্য হন (ভুড়ি ভুরি এহেন উদাহরণ)। কারণ, নারী হিসাবে তাকে এই পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক ও পারিবারিক পরিচয় ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় নিজের ধর্ম পরিবর্তন করে তার স্বামীর পরিচয় ও উপাধি ধারণ করতে হয়। স্বামীটি উদার মানসিকতার লোক হিসাবে যদি স্ত্রীর নাম পরিচয় পরিবর্তন নাও করান, তারপরও আদিবাসী সমাজ তা মানতে নারাজ। তাহলে, মোটাদাগে এখানে সমস্যা আদিবাসী বনাম বাঙালী আইডেন্টিটি, যার একটা রাজনৈতিক ইতিহাস এবং বর্তমানতা আছে। এই কনফ্লিক্ট বা সংঘর্ষ রাষ্ট্র কর্তৃক প্রবর্তিত, প্ররোচিত ও প্রণোদিত হলেও তার মাশুল মূলত এই জাতিগত দ্বন্দ্বে উপনীত ও চলমান, যা দিনকে দিন জটিল হতে জটিলতর হচ্ছে।

কেইস ২: এক চাকমা পুরুষ এক বাঙালী নারী বিয়ে করে প্রশংসা ও সাধুবাদে ভেসে যাচ্ছেন। কারণটা ওই উপরোক্ত কেইসের মতোই। ওই বাঙালী নারীকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা অনুযায়ী স্বামীর পরিচয় ধারণ করতে হবে, অর্থাৎ ওই নারীটি এবার থেকে ‘চাকমা’ হবেন। আর তাদের সন্তান অবশ্যই চাকমা পরিচয় বহন করবে নামের পেছনে। অতএব যত বাঙালী নারী বিয়ে করা যায় ততই উত্তম, এতে চাকমাদের সংখ্যা বাড়বে। না, এই অভিব্যক্তি সকলে ধারণ করছেন না। কেউ কেউ মনে করছেন ওই বাঙালী নারী চাকমা হয়ে গেলেও বা কী, তাদের সন্তান তো আর ‘পিওর ব্লাড’ বহন করবে না। অতএব তাদের সন্তান তো চাকমা হলো না ওই অর্থে। অনেকেই মনে করেন ‘পিওর ব্লাড’ এর জন্য ‘ব্লাড পিউরিফিকেশন’ এর দরকার পড়ে। এই কথাটার মানে বলতে গেলে লেখা আরো লম্বা হয়ে যাবে বলে তা আপাতত এটুকুই রাখছি।

কেইস ৩: প্রবাসে বেড়ে উঠা ও সেখানেই স্থায়ী হওয়া এক চাকমা নারী একজন ইন্ডিয়ান পুরুষকে বিয়ে করেছেন। জামাই ইন্ডিয়ান হলেও বেড়ে উঠা বৈদেশেই। এই বিয়েতে অধিকাংশই হায় হায় করে উঠলেন। আশীর্বাদের জায়গায় হতে লাগলো অভিসম্পাতের বর্ষণ। কেনো? কারণ এহেন মেধাবী মেয়েকে এতো বড় ‘শিক্ষিত বাবা মা’ কোনো জাতিগত শিক্ষা দিতে পারেননি। তাই সে বেজাতি বিয়ে করার স্পর্ধা দেখালো। আদিবাসী মেয়েরা বেশি শিক্ষিত হলে এই সমস্যা, তারা আর তখন নিজ জাতির ছেলে বিয়ে করে না। তারা বেজাতিকে বিয়ে করে। এরকম চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আদিবাসী সমাজ লুপ্ত হয়ে যাবে। অতএব, কেউ কেউ ফতোয়া টানলেন, সমাজের স্বার্থে নারীদের বেশি শিক্ষিত না করাই ভালো। আর সেই নারীর বাবা মাকে শ্রাব্য অশ্রাব্য নানান গালিগালাজে ভূষিত করলেন এই ‘দারুণ, নারীবান্ধব, সহজ সরল’ আদিবাসী ভাই বেরাদররা।

কেইস ৪: প্রবাসে বসবাসরত এক চাকমা নারী এক সাদা চামড়ার পুরুষকে বিয়ে করেছেন। সকলেই বেজায় দিলখুশ। সেখানে যে আদিবাসী কম্যুনিটি আছে তারা সকলেই জামাইকে অভ্যর্থনা জানায়। জামাইকে চাকমা ট্র‍্যাডিশনাল পোশাক পড়ে সেইসব অভ্যর্থনা নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে হয়। কেউই এই সাদা চামড়ার ভদ্রলোকটির ‘নিজের জাতির সংস্কৃতি’ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয়। সবার এহেন উল্লাস দেখে মনে হচ্ছে ‘গরীবের বাড়িতে হাতির পা পড়েছে’। আমি শুনেছি আদিবাসী সমাজে নাকি বর্ণ বৈষম্য নাই। কিন্তু ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত জামাই আর হোয়াইট জামাইয়ের ক্ষেত্রে যে বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো তাকে ব্যাখ্যা করা যায় কোন হিসাবে?

কেইস ৫: গত বছর এক মারমা নারী এক চাকমা নর মানে পুরুষকে বিয়ে করলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। মারমা পুরুষরা হায়হায় করে উঠলেন মারমা জাতির এহেন ভিন জাতি বিয়েতে। কারণ, এহেন কর্মকান্ডে অন্য মারমা নারীরা উৎসাহ পেতে পারে, এবং এভাবে মারমা জাতির সংখ্যা লোপ পাবে সুদূরেই। পাহাড়ের সবাই আদিবাসী হিসাবে মেইনস্ট্রীমে পরিচিত হলেও বা কী, নিজেদের মধ্যে তো অন্তত এই ‘জাতির ভেতর জাতি’ জিনিসটা মানতে হবে তো নাকি? সেইসব জাতির পিউর ব্লাড মেইনটেইন বজায় রাখা জাতিগত কর্তব্য। কিন্তু অন্যদিকে চাকমারা বলছেন, যেভাবে রসুনের কোয়ার পশ্চাত সব এক জায়গায়, সেভাবেই পাহাড়ে বাঙালী বাদে আমরা সবাই ভাই ভাই। অর্থাৎ পাহাড়ি জাতীয়তাবাদ আসলে কিছুদূর গিয়ে আরো অনেক জাতিগত জাতীয়তাবাদে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে।

এই যে পাঁচটা কেইস, বাংলাদেশের এথনিক ন্যাশনালিজমের ইউনিক ডিফারেন্ট কেইস, এগুলো থেকে কিছু সিদ্ধান্তে উন্নীত হওয়া যাচ্ছে। সেগুলো হচ্ছে,

১. নারী সন্তান উৎপাদক ছাড়া কিছু নয়। সে জাস্ট একটা ভেসেল বা ইনকিউবেটর যেখানে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উৎপাদিত হয়।
২. সে কাকে বিয়ে করবে, কাকে করবে না তা ঠিক করার অধিকার তার নেই। তা ঠিক করবে পুরুষরা।
৩. পুরুষরা জাতীয়তাবাদের রক্ষক ও জাতির নিরাপত্তাদানকারী, অর্থাৎ নারী ও শিশুদের রক্ষা করার দায়িত্ব তাদের।
৪. আদিবাসী নারীর এজেন্সী যেকোনোভাবে সাপ্রেস বা দমন করতে হবে।

কোনো রিজিয়নে বহুজাতির পাশাপাশি অবস্থানের ঐতিহাসিকতা থাকলে সেক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ বহুজাতির সম্পর্কের ফলাফল হিসাবে ‘মিশ্র বিয়ে’ একটি খুব স্বাভাবিক প্রকাশ। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র কোনোভাবেই সেই শান্তিপূর্ণ অবস্থান রাখেনি। ৪৭ এ দেশভাগ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি যত রুলস এন্ড রেগুলেশনস প্রোমোট করা হয়েছে এই পার্বত্য চট্টগ্রামে, তার সবগুলোই আদিবাসীদের উপর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ নির্যাতন হিসাবে হাজির হয়েছে। আর চলমান ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ কৌশল তো আছেই, সেইসাথে মিলিটারাইজেশন, উন্নয়ন, ট্যুরিজম এর মধ্য দিয়ে ইথনিক ক্লিনজিং চলছে চোখের সামনেই, তাই এখানে এইরূপ মিশ্র বিয়ের সম্ভাবনাকে যেকোনো প্রকারে দমন করার তাগাদা দেখা যায় আদিবাসীদের মধ্যে। কনফ্লিক্ট বা সংঘাতপূর্ণ এরিয়া সবসময়ই এমন হয়ে থাকে। যেমন, সার্বিয়ার কথা বলা যেতে পারে। একটা সময় সার্বিয়া যখন যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিলো, তখন মিক্সড ম্যারিজ ছিলো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রায় বিশ লাখ লোক মিক্সড ম্যারিজের বংশগত ছিলো। একসময় তারা সংখ্যায় আলবেনিয়ান, মন্টোনিগ্রিন, স্লোভেনস, ম্যাসিডোনিয়ানদেরও ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংকট বাড়তে থাকলে এই জাতিগুলোর মধ্যকার বিদ্বেষও বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে সার্বিয়া মিশ্র বিয়েকে ‘বাস্টার্ড ফ্যাক্টরি’ বলে ঘোষণা করে।

বাংলাদেশে আদিবাসী সমাজেও এটাই হচ্ছে। প্রবল বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে টিকে থাকার জন্য প্রবল পাহাড়ি জাতীয়তাবাদ দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশ নামক একটা ছোট্ট রাষ্ট্রে এই যে এতো এতো জাতি, এটা হতে পারতো বহুজাতির একটা দারুণ সন্নিবেশিত রাষ্ট্র। রাষ্ট্র পারতো আদিবাসী জুম্ম সমাজের সমাজতান্ত্রিক সামাজিক ব্যবস্থাপনাকে সরাসরি মার্কেট ইকোনোমিতে না নিয়ে এসে আগে তাদের ভূমি, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, নাগরিকত্ব, বাজারে মুক্ত বিনিয়োগ, সুস্থ রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা, এসবের স্বাভাবিক অধিকারকে আদিবাসীদের কাছে ন্যস্ত করা। এই ন্যায্য হিস্যাটা হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা সারাদেশের আদিবাসীদের অবস্থা আজ এমন দুর্দশাগ্রস্থ হতো না। কিন্তু তা না করে জোর দেয়া হলো রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বে, আর এর জন্য বেছে নেয়া হলো দমন পীড়ন পদ্ধতি। ফলতঃ ‘বহুজাতির রাষ্ট্র’ হওয়ার চেয়ে বরং বহু জাতীয়তাবাদী ধারণা ও প্রজেক্টের জন্ম এবং তার জয়জয়কার হলো।

এই যে ছোট্ট একটা রাষ্ট্রে এতো এতো জাতীয়তাবাদী ধারণা, এর শেষটা কোথায়? জাতীয়তাবাদ মাত্রই লিঙ্গভিত্তিক একটা বৈষম্যবাদ, শাঁখের করাতের মতো যা নারীকে দুইদিকেই কাটে। নারী তার প্রজনন ক্ষমতার জন্য যেমন পূজিত, তেমনি নিপীড়িত। এই উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রক্রিয়ায় নারী তার জরায়ুর বাইরে কিছু নয়। তার মাথা নেই, তার হাত নেই, তার মন নেই। আছে শুধু একটা জরায়ু, যেখানে তার জাতির ভবিষ্যত প্রজন্ম উৎপাদিত হচ্ছে। সে একটা কারখানা মাত্র, যেখানে পুরুষ সেই কারখানার স্বত্ত্বাধিকারী। পুরুষ ঠিক করবে কী উৎপাদন হবে। নারী তার মেধা,পরিশ্রম দিয়ে স্বজাতির জন্য কাজ করলেও হবে না। তাকে জরায়ু দিয়েই সেবা করতে হবে। দরকারে জাতির জন্য মেধা অথবা পরিশ্রম না দিলেও চলবে, এর জন্য তো পুরুষরা আছেই। এই জায়গায় কল্পনা চাকমার কথা না বলে পারছিনা। কল্পনা চাকমা আজ নেই বলেই আছেন। কথাটা উদ্ভট শোনালেও সত্য। কল্পনা চাকমা জীবিতকালে তার পুরুষ কমরেডদের কাছে খুব একটা জনপ্রিয় ছিলেন না। কারণ, তার প্রতিবাদী স্বভাব। তিনি শুধু আদিবাসিদের অধিকারের কথা বলেননি, তিনি নারী অধিকারের কথাও বলতেন। তাই জীবিতকালে স্বজাতিতে তার নিন্দুকের অভাব ছিলো না। এজন্যই বলছি, কল্পনা চাকমা নেই বলেই আছেন এবং আদিবাসী পুরুষদের কাছে ‘নিখোঁজ কল্পনা’ বেশি আরামদায়ক।

এই যে নারীকে সন্তান উৎপাদনের কারখানা বানায়ে রাখা এরূপ জাতীয়তাবাদ, সেটা হোক বাঙালী জাতীয়তাবাদ কিংবা আদিবাসী জাতীয়তাবাদ, এইসব এথনিক ন্যাশনালিজম সবসময় একটা আদর্শ অতীতের কথা বলে। যেমন, অমুক একটা সময়ে আমরা এই… তমুক শতকে আমরা ওই…। এটা কেনো করে? কারণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের সময় এই ধরনের আইডিয়ালাইজেশন এক প্রকার সেন্স অব সিকিউরিটি প্রদান করে। তারা এতোসব সংকটের বিপরীতে সামাজিক স্থিতিশীলতা আনার জন্য অতীতের সেই কল্পিত সময়ানুযায়ী ধর্ম, ঐতিহ্য, পিওর ব্লাড, স্বজাতির ধারণা প্রোমোট করে। আর এই ধারণাগুলোর অথেনটিসিটি বা অকৃত্রিমতা বজায় রাখার দায়িত্ব এসে পড়ে নারীদের উপর। আর পুরুষ পায় একক কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা। সে নারী ও শিশুর প্রোটেক্টর, দেশ ও জাতির রক্ষক।

এই সিস্টেমে পুরুষ যেহেতু কর্তৃত্ব ধারণ করে, তাই সে দণ্ডও দিতে পারে। সে খুব সহজে বলতে পারে, নারীকে বেশি পড়ানো যাবে না, কারণ এতে নারীর বেলাইনে যাওয়ার আশংকা থাকে। নারীকে এরকম পোশাক পড়তে হবে, নাহলে তার আদিবাসীত্ব ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। আর এরকম অথেনটিক, এপ্রোপ্রিয়েট এথনিক হিস্টোরিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডে যারা আনুগত্য শো করে না, তারা থ্রেট বা হুমকি হিসাবে চিহ্নিত হয়। আবার, যারা বেজাতি বিয়ে করে, কিংবা বেজাতির সাথে বন্ধুত্ব তৈরী করে সেই সীমানা ক্রস করেন, তারা নানান ব্লেমিং ও শেইমিং-এর ভিক্টিম হন। আমরা, ‘মেহেরজান’ সিনেমায় তার একটা নজির পেয়েছি, ‘খামোশ পানি’ নামক একটা পাকিস্তানি সিনেমাতেও এই বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। আবার আমার উক্ত কেইস ১ এর ক্ষেত্রেও তাই দেখা যায়। বেজাতি বিয়ে করা নারীদের নাম ও ঠিকানার লিস্ট ফেসবুকের পেইজে পেইজে ঘোরে, ওই একই উদ্দেশ্যে।

এই অংশে আদিবাসী সমাজে চলমান প্রবাদগুলো থেকেই একটু উদাহরণ দেই। যেমন, বলা হয় যে, আদিবাসী নারীরা বেশি শিক্ষিত হলে যোগ্য পুরুষ পায় না। ব্যাপারটা আমি একটু ব্যাখ্যা করি। লম্বা হলেও পড়লে বাস্তবতা বুঝা যাবে বৈকি। ভার্সিটি কিংবা সমমানের প্রতিষ্ঠানে যখন আদিবাসীরা যায়, দেখা যায় যে আদিবাসী পুরুষদের তুলনায় আদিবাসী নারীদের মধ্যে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবার প্রবণতা কাজ করে বেশি। আর দেশটা যেহেতু বাঙালী মেজরিটির দেশ, তাই ওই আদিবাসী নারীকে বাঙালী বন্ধু সহযোগীদের সাথেই কাজ করতে হয়। আর আদিবাসী ছাত্ররা এটা এপ্রেশিয়েট করা দূরে থাক, বরং ওই ছাত্রী সম্পর্কে নানানরকম মুখোরোচক কাহিনী ছড়াতে থাকে। বাঙালীদের সাথে তার বন্ধুত্বের কারণে তাকে মানসিকভাবে হেনস্থা করা হয়। তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে হয়তো ওই নারীকে কিছু করতে পারে না, ক্ষমতাগত কারণে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজেদের দাপটের জায়গায় যদি কদাচিৎ কোনো আদিবাসী নারীকে বাঙালী বন্ধুসমেত দেখা যায়, তাহলে ব্যস, তাকে পথরোধ করে তুলে নেয়া, বাবা মায়ের কাছে নালিশ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওই মেয়েকে মারধর করা হয়। একটাবার ভাবি, যে মেয়েটা আসলেই বেজাতির কারো সাথে প্রেম করছে না, কিন্তু এ ধরনের হেনস্থা ও সারভেইলেন্সের শিকার হয়, ‘স্বজাতি’র প্রতি তার কেমন ধারণা হয়?

সংখ্যায় কম হলেও এমনো ঘটনার নজির আছে যে, বাঙালী বন্ধুর সাথে ঘুরছে বলে আদিবাসী নারীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মুরুব্বীদের কাছে সালিশের জন্য এবং পথমধ্যেই আদিবাসী ছেলেগুলোর কেউ ওই নারীকে ধর্ষণ করে। আদিবাসী ভাষায় ‘ধর্ষণ’ শব্দটা নেই বলে আদিবাসী পুরুষরা ধর্ষণ করে না, প্লিজ এই ফালতু কথাটা বলা বন্ধ করেন। আমি আদিবাসী-বান্ধব বাঙালী বন্ধুদের বলবো, ভাই, আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার কথা বলতে গিয়ে আমাদের নোবল স্যাভেজ বানাবেন না প্লিজ। আপনার কল্পনার ইউটোপিয়া আদিবাসী সমাজ দিয়ে দেখার চেষ্টা করবেন না। এতে আপনি ক্ষতি ছাড়া ভালো করছেন না।

মেজরিটির ইনফ্লুয়েন্স বলতে একটা ব্যাপার আছে। আদিবাসী সমাজ নানান নিপীড়ন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যা হয়ে উঠতেছে, তা মেজরিটির সমাজ চেতনা থেকে খুব একটা আলাদা কিছু নয়। কিছু কিছু জায়গায় চেতনা ও ধারণাগত হালকা পার্থক্য থাকলেও অচিরেই তা মুছে যাবে। আর কিছু কিছু জায়গায় আদিবাসী নারীদের উপর আদিবাসী পুরুষদের অত্যাচার আরো ইউনিক। মাতৃসূত্রীয় সমাজের এক নারীর সাথে আলাপ হচ্ছিলো একবার। তিনি বলছিলেন, “দিদি, কি আর বলবো! দেশের সরকার নিয়ে, বাঙালীদের নিয়ে অনেক কথা বলতে পারি, গালিগালাজ করতে পারি। কিন্তু নিজের জাতের ছেলেগুলোর অত্যাচার নিয়ে কিছু বলতে পারি না। ঘরে ঘরে আজকাল নিপীড়ন বেড়ে গেছে।” উদাহরণটা তুলেছিলাম ওই প্রবাদ সাপেক্ষে যে, “আদিবাসী নারীরা বেশি শিক্ষিত হলে যোগ্য পুরুষ পায় না।“ এক্ষেত্রে আমি যোগ্যতা শব্দটা ব্যবহার করবো না, বরং বলবো সমঝদারি লোকের অভাব। যারা প্রিভিলেজড তারা প্রিভিলেজড হওয়ার সূত্রে কম স্ট্রাগল করে, আর যারা নানানভাবে অপ্রেসড তারা বাঁচার তাগিদে পথ খুঁজে নেয়। আদিবাসী নারীরা সেটাই করে তাদের বাস্তবতা অনুযায়ী। কিন্তু তার সেই সংগ্রামে যেহেতু পুরুষ দাঁড়ায় না, তাই তার সমঝদারের অভাব ঘটে।

তো উগ্র জাতীয়তাবাদ এমনই। যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যেকোনো জাতীয়তাবাদই সহিংসতা তৈরী করে। সন্দেহ নাই যে বাঙালী জাতীয়তাবাদ ভয়াবহ জুলুম তৈরী করেছে আদিবাসীদের জন্য। কিন্তু তার বদলা হিসাবে যে পাহাড়ি জাতীয়বাদ প্রবল হয়ে উঠছে, তা কাদের জন্য নিপীড়নমূলক হয়ে উঠছে তা খেয়াল করছি কি? এথনিক ন্যাশনালিজমের নামে নারীদের উপর যে শারীরিক ও মানসিক চাপ ও অত্যাচার করা হয় তা নিসন্দেহে ভায়োলেন্স। এটাকে জাতিরক্ষা বলে মোলায়েম করার কিছু নাই। ভিন্ন জাতির বিয়ের পোস্টের কমেন্টগুলোতে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, এগুলো সব ব্যক্তি আক্রমণ, গালাগালি, মব ট্রায়ালে ভর্তি। কন্সট্রাকটিভ কোনো আলোচনা সমালোচনা নেই। তো এই ধরনের আলাপ ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যে তারা নারীজাতিকে রক্ষা করার কথা বলেন, তাদেরকে বলবো আমার মনে হয় নারীকে আসলে রেস্কিউ করার কিছু নাই। বরং পুরুষকূলের উচিত নিজেদের পতিতদশা থেকে নিজেদের রেস্কিউ করা। এই যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত চলে এতে কি জাতি নষ্ট হয় না? প্রতিবছর কত লোক নিহত হয় এইসব সংঘাতে তার কোনো হিসাব নাই। মেধাবী মেধাবী সব ছেলেদের মেরে ফেলা হচ্ছে। রাষ্ট্র এবং চরম বেজাতি বাঙালীদের কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যাকে গালিগালাজ করবো ভালো কথা, সাথে যেনো নিজেদের তৈরী সংকটের কথা নিয়েও কন্সট্রাক্টিভ আলোচনা করি।

তাদের এমন আক্রমণাত্মক কমেন্ট দেখে আমি ভাবছি আদিবাসী সমাজেও তো লেসবিয়ান, গে আছে। তারা যদি স্বজাতির সমলিংগের কাউকে বিয়ে করতে চান, সেক্ষেত্রে কী বিধান? আদিবাসী সমাজের নন বাইনারীদের নিয়ে আমরা কবে আলোচনা করতে পারবো?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.