একবার দৃঢ়তার সাথে এবিউজকে ‘না’ বলতে শিখুন

ইসাবেল রোজ:

দুটি খবর-

**রাজশাহীতে একজন স্কুল শিক্ষিকাকে ঘুমন্ত অবস্থায় তার স্বামী কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে. তাঁর অবস্থা আশংকা জনক. স্কুল শিক্ষিকার ভাই ৭১ টিভি কে জানান ২০বছর আগে তারা ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন. কিন্তু বিয়ের পর থেকেই তিনি বুঝতে পারেন স্বামী মাদকাসক্ত.

একজন মানুষের সাথে দুই দশক বসবাস করেছেন যে নারী তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছে. ভাবা যায়?

**এদিকে সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের অভিযোগ এনেছেন তার স্ত্রী। তাদের দাম্পত্য জীবনের বয়সও নেহায়েত কম না। হয়তো ২০ বছরের কাছাকাছি। যদিও তার শারীরিক কোন ক্ষতি হয়নি, কিন্তু মানসিক ক্ষতির হিসাব আর কেই বা রাখে?

আমার মতো আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগে কখনও যে একজন নারী কতদিন মানে কত বছর সহ্য করার পর ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স কে “না” বলতে পারে? আমি নিশ্চিত উপরের দুটো পরিবারেই এই ঘটনা প্রথমবারের মতো ঘটেনি। অবশ্যই গায়ে আগুন হয়তো দেয়নি আগে, তবে স্কুল শিক্ষিকা নিশ্চয়ই ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছেন আগে। তাহলে কীসের আশায় এই নারীরা সংসার চালিয়ে যান?

খেয়াল করুন, এই দুজন নারী কিন্তু কেউই সাধারণ গৃহবধু নন, একজন সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান সহকারি শিক্ষিকা এবং অন্যজন একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার।

“ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হয় সেইসব মেয়েরা যাদের ফাইনান্সিয়াল ফ্রিডম থাকে না” এইসব রাবিশ কথাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেয়া যায় না।
সুপারস্টার গায়িকা রিয়ানাকে তার বয়ফ্রেন্ড ঘুষি মেরে চেহারা চেঞ্জ করে দিয়েছিল। তিনি অর্থনৈতিকভাবে শুধু স্বচ্ছলই ছিলেন না, পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত থাকা অবস্থায় এই এবিউজের শিকার হয়েছিলেন।

এই দুজন কর্মজীবী নারী যারা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছেন, তাদের টক্সিক রিলেশনশিপ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকার কথা। অথচ বছরের পর বছর তারা যাদের সাথে সংসার করেছেন তাদের সম্পর্কে সবকিছু জেনেও না জানা হয়ে থেকেছেন। হ্যাঁ সমাজের চাপ আছে, বাচ্চাদের বড় করার বিষয় আছে, সামাজিক অবস্থান, নিরাপত্তা অনেক বিষয় আছে, সেটা মেনে নিলাম, এই সবকিছুকে প্রয়োরিটি দিতে গিয়ে আমরা নিজেদের কথা ভুলেই যাই। প্রায়োরিটি লিস্টে নিজের নাম সবার শেষে পড়ে যায়। অনেকের হয়তো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না। কিছুদিন আগে একজন নারী আমাকে একটা কথা বলেছিলেন। তিনি বয়স্ক, পোড় খাওয়া রাজনীতি করা নারী। তিনি বলেছিলেন, “মেয়েদের আবার জীবন কী? মেয়েদের জীবন বলতে কিছু নেই”। কথাটি তিনি যদিও অভিমান করেই বলেছিলেন, সেই থেকে এই কথাটি আমার কানে বাজছে বারবার।

আজকে একটি গ্রুপে একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, টক্সিক কীভাবে ডিফাইন করা যায়? আজকাল কেউ নাকি পার্টনারের সাথে তর্ক-বিতর্ক হলেই তাকে টক্সিক বলে আখ্যা দেয়।

সরল উত্তর হলো, যা কিছু বিষাক্ত, যা কিছু ক্ষতিকারক শারিরীক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সেটাই টক্সিক।
শরীরের আঘাতের চিহ্ন আমরা দেখতে পাই কিন্তু ভার্বাল এবিউজের ফলে মস্তিষ্কে যে শুন্যতা সৃষ্টি হয় সেটা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না. তাই বলে কি মস্তিষ্কের ক্ষত তৈরী হয় না? অবশ্যই হয়. যখনই আমরা মৌখিক ভাবে আঘাত প্রাপ্ত হই বা ভার্বাল এবিউজের শিকার হই তখনই এলার্ট হতে হবে. তখনি বুঝতে হবে এভাবে নিজের মস্তিষ্কে ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে. এই উপলব্ধির পর নিজেকে যত দ্রুত সম্ভব উইথড্র করা প্রয়োজন. একই ভাবে অনলাইনে এবিউজড হলেও মস্তিষ্কের ক্ষত সৃষ্টি হয়.

টক্সিক রিলেশনশিপের মতো টক্সিক প্যারেন্টিংও মারাত্মক ক্ষতিকর। আমি বলবো আরও বেশি ক্ষতিকর। কারণ রিলেশনশিপ থেকে আপনার নিজেকে সরিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে, ( শাবানার মতো ভালবাসা আর চোখের জলে মন জয় করার মন-মানসিকতা যাদের, তাদের কথা ভিন্ন)।
তবে টক্সিক প্যারেন্টিং এর হাত থেকে রেহাই পাওয়া খুব কঠিন, বিশেষ করে মেয়েদের জন্য। কারণ এই সমাজে কোন মেয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে অথবা বাবা মায়ের সাথে সদভাব রাখতে না পারাটা বিশাল একটা ডিস্ক্রেডিট হিসেবে ধরা হয়। মেয়েটিকে প্রথমেই বেয়াদব, মাথায় সমস্যা, উচ্ছৃংখল হিসেবে ট্যাগ দিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করা হয়। এসব ট্যাগিং এর পরেও মেয়ে যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারে অথবা বিয়ের জন্য রাজী না হয়, তাহলে তাকে বে**আ, মা** , খা** ইত্যাদি নামে ভূষিত করে তার মানসিক, শারীরিক অবস্থার বারোটা বাজিয়ে দেয়া হয়। উদাহরণ আর না দেই, যারা আমার লেখা নিয়মিত পড়েন তারা নিশ্চয় বুঝে নিয়েছেন।

বৃটেনে বরিস জনসন যখন ব্রেক্সিট ক্যাম্পেইন করেছিলেন তখন বলেছিলেন, ” Take back control”.
আমি সেই লাইন চুরি করে বলবো, মেয়েরা “Take back control of your life”.

কীভাবে বুঝবেন আপনি টক্সিক রিলেশনে আছেন?
১) আপনার আত্মসম্মান বলে কিছু থাকবে না;
২) আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবেন;
৩) পরনির্ভরশীল হয়ে উঠবেন;
৪) একা থাকতে ভয় পাবেন;
৫) নিজেকে সব কিছুর জন্য দোষী মনে করবেন;
৬) দোষ না থাকলেও বার বার ক্ষমা চাইবেন;
৭)বিষন্ন থাকবেন;
৮) প্রচণ্ড এংজাইটিতে ভুগবেন;
৯) সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি গ্রো করবে;
১০) নিজের ক্ষতি করতে ইচ্ছা করবে;

এখানে উল্লেখ না করে পারছি না এই লক্ষণ গুলো যে কোন এবিউজিভ রিলেশনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেটা পিতা, মাতা হতে পারে, স্বামী, স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, ভাই , বোন যে কারও দ্বারা সম্ভব।

একবার দৃঢ়তার সাথে এবিউজ কে ” না” বলতে শিখুন. ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান সবকিছু খুঁজে পাবেন। মারাত্মক ক্ষতি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন না। তার আগেই নিজেকে প্রায়োরিটি দিন। নিজের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে শিখুন, নিজেকে ভালবাসুন, নিজেকে ভালো রাখার জন্য যা করতে হয় সে অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলুন। বাকি সব সময়মতো ঠিক হয়ে যাবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.