এতিম

ফাহমিদা খানম:

চায়ের তেষ্টায় কাজের ছেলেটিকে ডাকতে থাকি, মরার মতো ঘুমাচ্ছে বলে ওর ঘুম ভাঙ্গে না। সারারাত বসে টিভিতে সিনেমা দেখে আর দিনের বেলা ঘুমিয়ে থাকে। রাগারাগি করলে আবার তেজ দেখিয়ে চলে যায় বলে কিছু বলতেও পারি না। আজকাল আর আগের মতো কাজের লোক পাওয়া যায় না, এটাও চলে গেলে সম্পূর্ণ একা হয়ে যাবো বলেই সহ্য করি বাধ্য হয়ে।

“বাবা তোমার চা”
“আজকে সকালবেলা এলে যে?”
“আমি প্রতিদিন নিয়ম করে দুইবেলা আসি বাবা, তুমি কি ভুলে গেছো?”

অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারছি না সত্যি কি নীরু দুইবেলা করেই আসে! বয়স হয়েছে, আজকাল সবকিছু ভুলে যাই।
“বাবা হটপটে রুটি আর সবজি ভাজি আছে, খেয়ে নিও, আর সকালে নাস্তা খাবার পর যে ওষুধ সেটা নাস্তার সাথে আলাদা করে দিয়েছি, দুপুরের খাবারের পর দুইটা মেডিসিন আলাদা করে গায়ে লিখে দিয়েছি। না বুঝলে আমাকে ফোন দিবে”।
“সবজি খেতে আমার রুচি হয়না নীরু”।
“রাজকীয় রোগ বাঁধিয়ে বসে আছো, এখন নিয়মকানুন মেনে চলতেই হবে বাবা”।
আমি চুপ করে মেয়ের কথা শুনি, ওর মুখের দিকে তাকাই না। ওর মায়ের কথা মনে পড়ে —

“যে মেয়েদের অবহেলা করেছো, একদিন তারাই তোমাকে দেখবে”, কথাটা আশ্চর্যভাবে মিলে গেলো বলে অবাকই হই। স্ত্রী যাবার পর থেকে তিন মেয়েই পালা করে আমাকে দেখছে।
“বাবা, আমি কলেজ যাচ্ছি, সন্ধ্যায় আসবো”।
“খোকার সাথে একবার কথা বলিয়ে দিবি?”
“বাবা তোমার মোবাইলে নেট খুলে দেবার পর আজ পর্যন্ত ওরা নিজেরা ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে ফোন করে না, কেবল তুমিই দুদিন পর পর কথা বলার জন্যে অস্থির হয়ে যাও?”
মেয়ের কথায় মন খারাপ হয়ে যায়, নির্মম হলেও কথাটা যে সত্যি!
“মন খারাপ করো না, আমি সন্ধ্যায় কথা বলিয়ে দিবো,
আমি এখন আসি বাবা”।

নীরুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি, ওর কাছে ডুপ্লিকেট চাবি আছে বলে কখন নিঃশব্দে আসে টের পাই না। পর পর দুই মেয়ে হবার পর মায়ের আক্ষেপের সাথে সাথে আমার নিজেরও আক্ষেপ হয়েছিল খুব, যখন দ্বিতীয় মেয়ের পর মা বলেছিলেন—

“মোতালেব তোর বুঝি আর বংশরক্ষা হইলো নারে বাপ”।
আমার স্ত্রী সন্তানের মা হয়েই খুশি ছিলেন। তৃতীয়বার ছেলে হবার খুশিতে পাড়ার সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছিলাম আমার বংশরক্ষা হবার খুশিতে, তবে আফসোস, মা বেঁচে ছিলেন না তখন। পুত্রের বংশরক্ষা দেখে যেতে পারেননি। বড় দুই কন্যাকে সেভাবে আদর না করলেও ছেলেটা হয়ে উঠেছিল আমার চোখের মনি।
ছেলের সব আবদার মেটাতাম বলে স্ত্রী বলতেন …
“ছেলে/মেয়ের মধ্যে ফারাক করাটা ঠিক না। সব সন্তানকে এক চোখে দেখতে না পারলে জবাব দিতে হবে”।

আমি স্ত্রীর এসব কথায় কান দিতাম না। চকবাজারে দোকান, এতোবড় ব্যবসা, বাড়ির মালিক পুত্রই হবে, যেমনটা আমিও পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছিলাম। তবে মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে উপযুক্ত পরিবারেই বিয়ে দিয়েছি। বড় মেয়ে চিটাগাং আছে, মেজো মেয়ে আছে যাত্রাবাড়ি, তবে অনেক চেষ্টা করেও ছেলেটার পড়াশোনায় মন বসাতে পারিনি। ছেলের পর নীরুর জন্ম। আমি আশা করেছিলাম এটাও পুত্রই হবে। ছেলে বন্ধু-বান্ধব আর আডডা দিয়ে বেড়াতো বলে ওর মা বার বার বলতো এখুনি লাগাম টেনে ধরতে, না হলে পরে নাকি পস্তাবো।

আমার বাবা সবসময় বলতেন মেয়েমানুষের সব কথা কানে দিতে নাই, আর সোনার আংটি বাঁকা হলেও ভালো।
“যে মেয়েদের এতো অবহেলা করেছো, একদিন সে মেয়েরাই তোমাকে দেখবে, দেখে নিও”।
আমি স্ত্রীর কথায় পাত্তা দিতাম না, আমার ভাই আর আমরাই মা-বাবাকে দেখেছি শেষদিন পর্যন্ত, আমার ছেলেও একই কাজ করবে। যৌবন বয়সে এমন করেই থাকে, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে, এটাই ভেবেছি আমি।

ছেলে যখন বিদেশে পড়তে যেতে চাইলো, ওর মা রাজি হলো না। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, আমাদেরকে কে দেখবে?
ছেলের জেদের কাছে আমি পরাজয় স্বীকার করে তাকে পাঠিয়ে দিলাম। মনে একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো নিজে বেশিদূর পড়তে পারিনি, আর আমার বংশে কেউ বাইরে পড়তে যায়নি আগে। ছেলে ডিগ্রি নিয়ে এসে আমার ব্যবসা ধরবে। যাবার সময়ে বড় অংকের টাকা নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে গিয়েও দুই দফায় তাকে টাকা পাঠাতে হয়েছে। ওর মা বার বার বলতো লাগাম টেনে ধরতে, কিন্তু ছেলে কষ্ট করুক আমিই চাইনি। দেড় বছরের মাথায় খবর পেলাম ছেলে বাচ্চাসহ এক ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করেছে। আমার মাথায় আকাশ ভেংগে পড়েছিল। সেদিন স্ত্রী বলেছিল—
“ছেলে যদি ভালো থাকে সুখে থাকে তবে আমাদের সমস্যা কোথায়?”
ছেলের বিয়ে নিয়ে মনে অনেক স্বপ্ন বুনেছিলাম, সব ভেস্তে যাবার পরেও আশায় ছিলাম। ওর মা বার বার বউ-বাচ্চা নিয়ে দেশে আসার কথা বললেও ছেলে জানাতো, বৌ-বাচ্চাদের নিয়ে দেশে আসতে ভয় পায়। ততদিনে ছেলের ঘরেও এক কন্যা জন্ম নিয়েছে।

“বাবারে, আমরা সব মেনে নিয়েছি। আমাদের বয়স হয়েছে, তোমাদের দেখতে ইচ্ছে করে”।
“তোমাদের বউ দেশ পছন্দ করে না বুঝতে চেষ্টা করো। দেশে মশা মাছি আর আবহাওয়ায় বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে যেতে পারে”।
আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে স্ত্রী বলতো –
“মা-বাপ নাইতো, তাই বউয়ের দেশের জন্যে টান কম। মন খারাপ করো না। ওরাও মা-বাবা হয়েছে, এক সময় ঠিকই বুঝবে”।
অপেক্ষায় থেকে পাঁচ বছর আগে আমাকে একা রেখে চলে গেলো, তারপর থেকে আমি সম্পূর্ণ একাই। মেয়েরা অনেক কান্নাকাটি করে নিজেদের কাছে রাখতে চায়, কিন্তু আমিই যাই না। সবাই শ্বশুরবাড়িতে আছে, সেখানে থাকতে লজ্জা লাগে। ছোট মেয়েটা বাসা বদলে কাছাকাছি বাসা নিয়েছে, তার শাশুড়ি আবার বেয়াই বাড়ি থাকতে চায় না বলে মেয়েটার অনেক কষ্ট হয় আমি তো বুঝি। দুই বাসার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে, তবুও কখনও বিরক্ত হতে দেখি না। মায়ের স্বভাবই পেয়েছে মেয়েরা। সবকিছুকে সহজ করে দেখা আর মানিয়ে নেবার অদ্ভুত ক্ষমতা। তিন মেয়ে পালা করে দুজনকে দেখতো, একজন চলে গিয়ে আমাকে একা করে দিয়েছে।

“বাবা নাও তোমার প্রিয় বাখরখানি, একদম গরম”
নীরুটা আবার নিঃশব্দে কখন এসেছে টের পাই না।
“ঘন দুধের চা দিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে”
“আচ্ছা বানিয়ে দিচ্ছি, তবে শুধু আজকের জন্যে, তোমার রাতে ঘুম হয় না, বিপি বেশি থাকে, আর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে না, কারণ তুমি হাঁটাচলা করতে পারো না, তাই তোমার ভালোর জন্যেই দেই না বাবা”
“আমার সময় ফুরিয়ে আসছে মা, জোর করে কি ধরে রাখতি পারবি?”

নীরু দৌঁড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে—
“মা নাই, তুমিই আমাদের সবকিছু বাবা, প্লিজ এভাবে বলো না। আল্লাহপাক তোমাকে দীর্ঘ হায়াত দান করুক বাবা”।
বুকে জড়িয়ে নেওয়া মেয়েটার জন্মের পর আমি খুশি হইনি, আমি ছেলে আশা করেছিলাম। আমার চোখে পানি চলে আসে, স্ত্রীর কথাটা মনে পড়ে যায় –
“এই মেয়েরাই একদিন তোমাকে দেখবে”।

গত পাঁচ বছর পালা করে তিন মেয়েই আমাকে দেখছে তার আগে মা বেঁচে থাকতেও সব দায়িত্ব তারাই পালন করেছে। ছেলেটা মায়ের মৃত্যুর পরেও আসেনি, বলেছিল, ব্যবসায় লস খেয়ে আর্থিক সমস্যায় আছে।
মেয়ে ছেলের সাথে কথা বলিয়ে দেয়, আমি ছেলের মুখে একই ভাংগা রেকর্ড শুনতে পাই—
“বাবা তোমার বয়স হয়েছে, এখনও বিষয়-আশয় ভাগ করছো না কেনো? তুমি যদি চকের দোকান আর বাড়িটা আমাকে দিতে, আমি বিক্রি করে এদেশে নতুন করে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করতে পারতাম”।
আমি ফোনটা নীরুর হাতে দিয়ে দেই। আমার কিছু বলার ইচ্ছেই হয় না, ছেলেকে দেখার জন্যে আমার আকুলতা, অস্থিরতা ছেলেকে ছোঁয় না বলে বুকের ভেতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়।
“তোর উকিল চাচাকে খবর দিস নীরু, আমার দরকার আছে”।
“আচ্ছা খবর দিবো, আগামী সপ্তাহে বড় আপু আসবে, বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ, এসে নাকি ১৫ দিন থাকবে”।
আমার খুশি হবার কথা থাকলেও আমি খুশি হতে পারি না। বড় দুই মেয়েকে সেভাবে কখনও আদরযত্ন করিনি, কেবল বাবা হিসাবে দায়সারা দায়িত্বটুকু সেরেছি। কেউ না জানলেও আমার মন জানে। আমার অস্বস্তি হয়, অথচ মেয়েরা সেসব মনেও রাখেনি।

মৃত্যুর আগে মোতালেব সাহবে গোপনে দলিল বদলে নিলেন, কেউই জানলো না। মোতালেব সাহেব মৃত্যুর আগে ১৫ দিন হাসপাতালে ছিলেন। তিন মেয়েই সেখানে ছিল, বংশধারক আসতে পারেনি, কারণ তার স্ত্রী তখন তৃতীয়বারের মতো মা হতে চলেছে, তাদের আগের দুটি মেয়ে বলে তারাও বংশরক্ষক চায়। উকিল যখন জানালেন, ব্যবসা আর বাড়ি সমান চার ভাগ করে দিয়ে গেছেন, দূর থেকে ছেলে ধরে নিলো নিশ্চয় বাবাকে ফুসলিয়ে বোনেরা এই কাজই করেছে, কারণ পুরনো দিনের এই বাড়ির মূল্য কয়েক কোটি টাকা, আর ব্যবসা থেকে প্রতিদিন বিশাল অংকের টাকা আসে। কেবল তিন মেয়ে তখনও মাতম করে চলেছে –
ব্যবসা, বাড়ি দিয়ে তারা কী করবে! আজকে থেকে তারা যে পুরোই এতিম হয়ে গেলো!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.