রাশিদা খাতুন: ‘ডাক্তারের নিঃশ্বাসে বিশ্বাস নাই। তাই চাউল ধোয়া পানি খাই। ২১ টাকা দিয়া কবরেজের তাবিজ নিছি। এহন কোনো সময় সমস্যা বাড়ে। আবার কোনো সময় কমে।’ এমনই বললেন রিনা বেগম। তিনি ফিস্টুলা রোগে ভুগছেন দীর্ঘদিন। পাঁচ সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে থাকেন কমলাপুর বস্তিতে। প্রতিটি সন্তান প্রসব হয়েছে বাড়িতেই। চতুর্থ সন্তানের বেলায় তিন দিন ছিল প্রসবব্যথা। ফলে ফিস্টুলায় আক্রান্ত হয়েছেন তিনি।
রিনা বলেন, ‘শইলে গন্ধ থাকে। কাপড় সব সময় ভিজা থাকে। সারা গা চুলকায়। শান্তিমতো বসতে পারি না। তার ওপর আবার এই ছেলে হইছে। ঠিকমতো গা-গোসলও করতে পারি না।’রিনা জানান, কমলাপুর বস্তিতে ৩০ জনের জন্য রয়েছে একটি করে টয়লেট। সেখানে সব সময় ভিড় লেগেই আছে। তার ওপর টয়লেটে সব সময় পানি থাকে না।রিনার স্বামী জাহাঙ্গীর হোসেন কমলাপুর রেলস্টেশনের কুলি। তাঁর ইচ্ছা আরও সন্তান হোক। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, ছেলেমেয়েই আমাদের সব।’ শুধু রিনা বেগম নন, প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও পরিচর্যার অভাবে বহু বস্তির অধিকাংশ নারী এ রকম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। রাজধানীতে ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। সেখানকার বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েরা প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে না জেনেই বড় হচ্ছে আর পড়ছে নানা সমস্যায়।
ফার্মগেট বস্তিতে পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন শান্তা বেগম। তিনি বলেন, ‘এক ছেলে মরে গেছে আলগা রোগে (ডায়রিয়া)। এহন আছে পাঁচজন।’ শান্তার জন্ম বস্তিতেই। তবে সাত বছর বয়সে বাবা তাঁকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ, বস্তিতে মেয়ে একটু বড় হয়ে গেলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় মা-বাবাকে। গ্রামের বাড়িতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করার পর শান্তাকে বস্তিতে এনে বিয়ে দেওয়া হয়। পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে শান্তা কোনো শিক্ষাই পাননি। তা ছাড়া এ বিষয়ে তাঁর স্বামীরও কোনো খেয়াল নেই। শান্তা বলেন, ‘বছর শেষ হলেই একটা বাচ্চা। এখন সংসারে অভাবের সীমা নাই। আগে বুজি নাই। অহন বুজি অনেক কিছুই।’ শান্তা জানান, বস্তিতে পানির কষ্ট লেগেই আছে। পানির অভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পারেন না তাঁরা।
মগবাজারের মধুবাগ বস্তির তাসলিমা (১৪) জানায়, প্রতিদিন তার সাদাস্রাব ভাঙে। এ সমস্যার কথা মাকে জানালেও কোনো চিকিৎসকের কাছে যায়নি সে। কারণ, চিকিৎসককে এসব ‘লজ্জার’ কথা বলা যায় না বলেই ধারণা তাদের।
একই বস্তির নাসিমা গর্ভধারণ করেছেন দুই মাস হলো। গর্ভধারণ করার পর থেকে প্রতিদিন রক্ত ভাঙে। কিন্তু এ জন্য এখনো কোনো চিকিৎসকের কাছে যাননি তিনি। নাসিমার কথা, ‘ডাক্তারের কাছে যাইতে মন চায় না। হেরা তো অনেক টেকা লয়। এত টেকা কি আমগো আছে?’
বস্তিতে প্রজননস্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন স্যাটেলাইট ক্লিনিক রয়েছে। এসব ক্লিনিক থেকে বিনা মূল্যে পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভকালীন সেবা, প্রসবকালীন সেবা ও জরুরি প্রসূতিসেবা দেওয়া হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় জ্বর, সর্দি, কাশি, ডায়রিয়া এসব সমস্যা নিয়ে বস্তিবাসী এসব ক্লিনিকে ধরনা দেয়। প্রজননতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে বলতে গেলে কেউ যায় না। বস্তিবাসীর অনেকে এসব ক্লিনিকের কার্যক্রম সম্পর্কেও জানে না।
মেরি স্টোপস ক্লিনিকের এলিফ্যান্ট রোড শাখার স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ উলফাত বস্তির কিশোরীদের সমস্যা সম্পর্কে বলেন, ‘কিশোরীরা সাধারণত যেসব সমস্যা নিয়ে এখানে আসে, সেগুলো হলো সাদাস্রাব নিঃসরণ, ঘা, তলপেটে ব্যথা ইত্যাদি। গর্ভপাতের জন্যও অনেকে আসে। তবে অবশ্যই অভিভাবকের সম্মতিতে আমরা তা করে থাকি।’
নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক মাসুদা বেগম বলেন, ‘বস্তির বাসিন্দারা এমনিতেই নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে বস্তিবাসী মোটেও সচেতন নয়। অন্তঃসত্ত্বা হলে যে নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়, সে তথ্যও অনেকে জানে না। এ জন্য সরকারিভাবে প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। আমরা তাদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। আমরা বিভিন্ন বস্তিতে গিয়ে প্রতিটি পরিবারকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য কার্ড করে দিই। তার পরও বস্তির বাসিন্দাদের চিকিৎসাকেন্দ্রে আসার হার অনেক কম।’
(প্রথম আলো থেকে নেয়া)