নারী খেলোয়াড়দের প্রতি কী হিপোক্রেসি আমাদের!

ইসাবেল রোজ:

১) ব্রিটেনে এমা র‌্যাডুক্যানো মাত্র ১৯ বছর বয়সে ইউএস ওপেন টেনিসে শিরোপা জয় করার পর বিবিসি তিনদিন ধরে শুধু এই মেয়েটির নিউজ হাইলাইট করেছে, স্পেশাল প্রতিবেদন করেছে, তার ফ্যমিলি, স্কুল ফ্রেন্ড থেকে শুরু করে যাকে পেয়েছে তার সাক্ষাতকার নিয়েছে, ফলাফল এখন লন্ডনে মেয়েদের টেনিস লেসনের চাহিদা এতোই বেড়েছে যে ঠিকমতো জায়গা দিতে পারছে না, সব বাচ্চা মেয়েরাই র‌্যাডুক্যানোর সাফল্যে উৎসাহিত হয়েছে টেনিস খেলাকে সিরিয়াসলি নিতে স্কুল ড্রপ করার প্রয়োজন নেই।
এমা জি.সি.এস.সি (বাংলাদেশের মাধ্যমিক বা ও লেভেলের সমান) এক্সামে ভাল রেজাল্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে প্রফেশনাল টেনিস এবং পড়াশোনা দুটোই একসাথে চালানো সম্ভব। এমাকে নিয়ে মিডিয়া, এতো বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে যে এদেশের প্রতিটা টিনএজার এমাকে এক নামে চেনে।

২) ফ্রান্সে যখন ২০১৯ সালে মেয়েদের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়, যদিও ফ্রান্স ফিনালে যেতে পারেনি, তবুও সে দেশের মেয়েরা দ্বিগুণ উৎসাহে নেক্সট কোয়ালিফাইং রাউন্ডের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশ্বকাপ এবং গোল্ডেন বুট আমেরিকান মেয়েরা জয় করেছিল। Megan Rapione মেয়েটির নাম না জানলেও বয়কাট চুলের সেই দূর্দান্ত খেলোয়াড় মেয়েটি মিডিয়ার সৌজন্যে পরিচিতি পেয়েছে। পাওয়ার ফুল পারফরমেন্সের জন্য বিভিন্ন মিডিয়ায় তাকে হাইলাইট করেছে। আমেরিকান টেনিস তারকা যুগল উইলিয়াম সিস্টারদের চেনে না, কে আছে? তারা ব্ল্যাক কমিউনিটিতে টেনিস জনপ্রিয় করেছে। তাদের আগে কোন আফ্রিকান আমেরিকান মেয়েরা টেনিস খেলতো না।

তাদের বাবা তাদের জন্মের আগে বিশাল বই লিখেছে যেখানে তাদের টেনিস খেলোয়াড় বানানোর সম্পূর্ণ নীল নকশা তৈরি করেছিলেন। সে শুধু তার ভবিষ্যত সন্তানকে টেনিস প্লেয়ার বানানোর স্বপ্ন দেখেন নাই। তার বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল তার কন্যা সন্তানই হবে এবং এই কন্যারাই আফ্রিকান আমেরিকান কমিউনিটির প্রেরণা হয়ে থাকবে যুগের পর যুগ। এসমস্ত লিখিত ডকুমেন্ট আছে এবং কন্যাদের জন্মের আগেই তিনি সব লিখে রেখেছিলেন। কন্যারা জন্মের পর টেনিস খেলতে গিয়ে তাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু তাদের পাওয়ার প্লে সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। টেনিস খেলার মান এক ভিন্ন লেভেলে তার পৌঁছে দিয়েছিল।

৩) আমেরিকা, ব্রিটেনের কথা বাদ দিলাম। তারা উন্নত দেশ তাদের মেয়েরা সুযোগ-সুবিধা পায় তারা তো ভালো করবেই। ভারতে ম্যারিকম মেয়েটির জীবনের উপর সিনেমা বানানো হয়েছে। ‘দাংগাল’ সিনেমার দুই কুস্তিগীর বোন হাজার মেয়েদের প্রেরণা যুগিয়েছে. গীতা, ববিতারা এখন ভারতের লেজেন্ডারি আইকনে পরিণত হয়েছে। সানিয়া মির্জা তো রীতিমতো স্টার। তাকে যেভাবে মিডিয়া কভারেজ দেয়া হয় কোন বলিউড স্টারের চেয়ে কম নয়।

আমাদের দেশের মেয়েরা ক্রিকেট, ফুটবল জিতে এসে কী পায়? শুকনো অভিনন্দন। তারপর সবাই তাদের ভুলে যায়। তাদের মধ্য থেকে কারও নাম আমরা জানতে পারি না, কে স্কোর করলো, কতটা পাওয়ারফুল পারফরমেন্স ছিল এসব বিষয়ে মিডিয়ার কোন মাথাব্যথা নেই। তাদের দেখে অন্য মেয়েরা এগিয়ে আসুক এটাই মনে হয় কেউ চায় না। তাদের হাইলাইট তো দূরে থাক তাদের নিয়ে আলোচনারও প্রয়োজন নেই। এতো বড় বড় ধিংগি মেয়েরা হাফ প্যান্ট পরে মাঠে দৌঁড়াবে, সেটা প্রমোট করাটা ৯০% মুসলমানের দেশে কেমন দেখায়?

ক্রিকেটেও একই অবস্থা মেয়েদের। পুরুষদের ন্যাশনাল টিম এর সাথে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার সি, ডি গ্রেডের প্লেয়ারদের নিয়ে এসে নির্লজ্জের মতো খেলায় জিতে “বাংলা ওয়াশ”, “বাংলা ওয়াশ” উল্লাস করি আমরা। এই আমরাই মেয়েদের বিজয়কে গোনায় ধরি না। মেয়েরা কেন নির্লজ্জের মতো মাঠে দৌড়াদৌড়ি করবে? ছেলেরা যখন অন্য দেশের জাতীয় দলের কাছে মান ইজ্জত নিয়ে দাঁড়াতেও পারে না তবুও কোন সমস্যা নেই।

ক্রিকেটে পলিটিক্স, ফুটবলে পলিটিক্স খেলোয়াড়দের আর কী দোষ দেবো? আমি এন্টি ন্যাশনাল না। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম নিয়ে মানুষ যে আদিখ্যেতা করে তার শিকি ভাগও যদি মেয়েদের স্পোর্টস নিয়ে করতো তাহলে অনেক ভালো প্লেয়ার বেরিয়ে আসতে পারতো। অবশ্য যেমন জনগণ, তেমন তার মিডিয়া, তেমন তার সরকার। কাকে কী বলার আছে! এদেশের মিডিয়ার কভারেজ পায় এক্স এথলেটের বোরখা পরে ক্রিকেট খেলার ছবি। তাদের কাছে যারা প্রকৃত খেলে শিরোপা জয় করে তাদের কোন মূল্য নেই।

যেই আদিবাসী মেয়েরা হাজার প্রতিকূলতার মধ্যে দেশের নাম উজ্জ্বল করেছে তাদের নাম কেউ জানে না, তাদের মুখ কেউ চেনে না, তাদের যদি হাইলাইট না করা হয় অন্যরা প্রেরণা পাবে কী করে? তাদের যদি সুযোগ সুবিধা না দেয়া হয় তারাই বা আরও উন্নতমানের ম্যাচে অংশ নেবে কীভাবে? সবাই নিশ্চুপ, as if nothing happened. it is only a game played by few girls!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.