‘মেয়েরা একা বেরিও না’ হেমার মন্তব্যে তোলপাড়

Hema
হেমা মালিনী

উইমেন চ্যাপ্টার: পরপর বেশ কটি আলোচিত ধর্ষণের ঘটনায় ভারত ফুঁসছে। গতবছর দিল্লিতে চলন্ত বাসে নির্ভয়াকে গণধর্ষণ এবং পরে তার মৃত্যুতে বিক্ষোভ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে। এবার সেখানে ফুলকি ছড়িয়েছে মুম্বাইয়ে সাংবাদিককে গণধর্ষণের ঘটনা। সবাই একবাক্যে স্বীকার করছেন, এ পর্যন্ত কোন ধর্ষণ মামলাতেই অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এ অপরাধের হার ক্রমাগত বাড়ছেই।

 এমন একটি বিক্ষোভমুখর সময়ে একসময়ের ডাকসাইটে অভিনেত্রী ও সাংসদ হেমা মালিনীর একটি মন্তব্য তোলপাড় তুলেছে সংশ্লিষ্ট মহলে। তিনি বুধবার পুনেতে এক অনুষ্ঠানে মেয়েদের একা বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। গণ্ডগোলটা বেঁধেছে সেখানেই।

কলকাতা থেকে পরমা দাশগুপ্ত লিখেছেন, পর্দায় তিনি তুমুল ডাকাবুকো বাসন্তী। যিনি খোদ গব্বরের সামনেও অকুতোভয়। কিংবা গীতা, যমজ বোন সীতার উপর হওয়া যাবতীয় অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়াটা যাঁর বাঁ হাতের খেলা। এমন দুটো চরিত্র ওতপ্রোত জড়িয়ে গিয়েছে তাঁর পথচলায়। অথচ আগাগোড়া স্বাধীন জীবনযাপনে বিশ্বাসী, মেধাবী, রুচিশীল অভিনেত্রী তথা প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ হেমা মালিনীই এখন মনে করেন মেয়েদের একা একা বেরোনো উচিত নয়।

 দুই কন্যার মা হেমার এ হেন মন্তব্য ঘিরে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। একজন মা হিসেবে, সচেতন মহিলা হিসেবে তাঁর এই বক্তব্যকে স্বাভাবিক উদ্বেগ বা আশঙ্কার নিরিখে দেখেও অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, সমাজ বদলের দাবি না করে মেয়েদের পায়ে হেমা ‘বেড়ি’ পরাতে চাইছেন কেন?
বুধবার পুনেতে একটি অনুষ্ঠানে হেমার পরামর্শ, “মেয়েদের কোথাও একা যাওয়া উচিত নয়।” তাঁর কথায়, “সবকিছু হাল্কা ভাবে নিয়ে মেয়েরা যখন যেখানে খুশি চলে যেও না। তাতে যা কিছু ঘটতে পারে। তোমায় কেউ আটকেও রাখতে পারে।” এর পরেই তাঁর হালকা মন্তব্য, “কৃষ্ণ সর্বদা দ্রৌপদীকে রক্ষা করতেন। মনে রাখতে হবে, এখন কিন্তু রক্ষা করার মতো ঈশ্বর নেই।”

ছেলেদের সঙ্গে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে সর্বত্রই এখন পা বাড়িয়েছেন মেয়েরা। তা হলে কেন একা একা সর্বত্র না যাওয়ার এমন নিদান? এ কি চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়া? নাকি দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সমাজের মানসিকতার প্রতি এক জন মায়ের পুরোপুরি আস্থা হারিয়ে ফেলা? সমাজের বিশিষ্টেরা প্রায় সকলেই হেমার আশঙ্কার জায়গাটুকু উপলব্ধি করতে পারছেন। তবে তাঁর পরামর্শের সঙ্গে একমত হননি অনেকেই।

অভিনেত্রী ও তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায় যেমন প্রশ্ন তুলেছেন, “যেখানে আজ মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে, সেখানে কেন তারা একা যেখানে খুশি যেতে পারবে না? দিল্লি বা মুম্বাইয়ের সাম্প্রতিক দু’টি ঘটনায় তো মেয়ে দু’টি একা ছিল না। তাহলে তাদের সঙ্গে এমন ঘটল? মেয়েদের একা বেরোতে বারণ না করে, বরং যারা অমানবিক বা পাশবিক, তাদের মানুষ করে তোলা হোক।”

নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ বলছেন, “মেয়েদের উপরে পরপর এই আক্রমণগুলোয় একটা প্রবণতা দেখছি। ফাঁকফোঁকর খুঁজে সবাই মেয়েটির উপরেই সব দায় চাপিয়ে দিতে চাইছেন। আক্রমণকারীর যেন কোনও দায়িত্ব নেই। মেয়েদের নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা করার যেন দায় নেই সরকারেরও। আর একা না বেরোলে কি সমস্যায় পড়তে হবে না? দিল্লি, মুম্বাই, লাতেহার, ধানতলা কোথাও আক্রান্তেরা একা ছিল না!”

লেখক সুচিত্রা ভট্টাচার্যও হেমার বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তাঁর কথায়, “সমস্যাটা আসলে পুরুষশাসিত সমাজের দৃষ্টিকোণের। মেয়েদের মানুষ বলে গণ্য করার সচেতনতাটা থাকলেই আর এই ধরনের পরামর্শের দরকার পড়বে না। যে অপরাধগুলোর প্রেক্ষিতে এমন পরামর্শ, সেগুলোর শাস্তিও বড্ড কম।”

গায়ক রূপঙ্করের বক্তব্য, “মেয়েরা যদি নিজেদের ইচ্ছেমতো, নিরাপদে, ঘুরতে না পারে, তা সরকারের লজ্জা, গোটা দেশের লজ্জা। হেমা মালিনীর মতো শিক্ষিত, স্বাধীনচেতা, রুচিশীল মহিলার কাছে তাই এটা আশা করিনি।”

অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় আবার ভিন্নমত। তিনি বলেন, “দেশের বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে ওই মন্তব্য খুব ভুল নয়। গভীর উদ্বেগ থেকেই হেমাজি এমনটা বলেছেন। আমাদের মা-মাসিরা বললে কি আমরা এ ভাবে সমালোচনা করতাম?”

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.