রেশমির মৃত্যু ও আমার দিন

স্নিগ্ধা বাউল:

মেয়েটি প্রথম যেদিন আমার কাছে আসে, ওর ঝরঝরে চুলগুলো আমার বেশ লাগছিল; পরনে জিন্স আর টপসের সাথে একটা কারুকাজ করা কটি। ছোট্ট গোলগাল একটা মেয়ে; বিড়ালের ছানার মতো। দরজা খুলে আমি বেশ বিরক্ত হই কেননা নতুন করে কাওকে পড়ানোর সময় আমার তখন নেই। মেয়েটি প্রথমে আমাকে মিস বলে ডেকে উঠে। আমি খুব গম্ভীরভাবে বলি- না না আমি একা কাওকে পড়াবো না। মেয়েটি হেসে বলে আমি বেশি টাকা দিয়ে পরব! আমি ভ্রূ কুঁচকে তাকাই, শহরে বাংলা পড়ানোর সুনাম আমার আছে আমি জানি কিন্তু এই মেয়ে তো নাছোড়বান্দা। আমি বললাম-হাতের লিখা ভালো না হলে আমি পড়াই না। বলে আমার হাতের লেখা সুন্দর, এবং আমি তাকে বলি এখন একপাতা যা খুশি লেখো।

রেশমি বসে যায় খাতা নিয়ে এবং গুটি গুটি অক্ষরে সে যা লিখে তার অর্থ সে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ছে এবং সে পড়াটা চালিয়ে যেতে চায়। আমার ভালো লাগে চটপটে মেয়েটাকে। একই শহরে বাড়ি তার আর আমার; আমি জানি এই শহরে তার বাংলা পড়া আর জিন্স পরা কতটা সাধ্যের সাথে যুদ্ধ করে নিতে হবে। এবার আমি হাসি, বললাম কাল থেকে পড়া শুরু করো। পরদিন রেশমি আসে ঠিক একই সময়ে; আস্তে আস্তে ওর দলটা ভারী হয়; বলা যায় আমরা একদল মেয়ে নতুন করে এক মফস্বলে নিজেদের আবিষ্কার করতে শুরু করি। আমরা ফুচকা খেতে যাই, পিকনিক করি সমান সমান টাকা দিয়ে। মেয়েগুলো আমাকে জড়ায়ে সেলফি তুলতে শুরু করে। আমরা বন্ধু হয়ে যাই, আমি ভুলে যাই আমি শিক্ষক আর ওরা ছাত্রী। আমি ওদের সব গোপন জেনে যাই। আমি তাদের জানাই কীভাবে মোবাইলে পরিচয়ের পর একটা ছেলে আমাকে ধোঁকা দিয়েছিল। ওরা শেয়ার করতে শুরু করে নিজেদের কথা।

রেশমি নিজেকে লুকায়; একটা বাচ্চাদের স্কুলে চাকরি নিয়ে বলে মিস আমি চাকরি করছি। আমরা ওর নতুন চাকরির টাকায় খেয়ে নিই একবেলা। আর্থিক কোনো অনটনের কথা আমি শুনিনি ওর। রেশমি সুন্দর জামা পরতো, আর সাজতে পছন্দ করতো। আমার বিয়েতে ওরা কী আনন্দই না করলো! একদিন কেবল বললো, মিস, ছেলেরা কেমন মেয়ে পছন্দ করে? আমি উত্তর দিতে পারিনি। আবার বলেছিল একদিন, মিস আমি খুব ভালো সংসার করতে পারবো? আমি বললাম, কেন নয়!

প্রতিটা মেয়ে মনে হয় ওই সংসারটাই সুন্দর করে করতে চায়। রেশমিও তাই চেয়েছিল। যখন আমি আলাদা থাকতে শুরু করলাম, বাচ্চা মেয়েগুলো আমাকে সঙ্গ দিতে শুরু করে। আমাকে বোঝায় ওরা নিজের স্বাধীনতার কথা। আমি বড্ড শক্তি পাই। এরপর ওদের বিয়ে হতে শুরু করে। আমি চলে আসি সেই শহরটা ছেড়ে, ওরা বড় হয়ে যায় আরও। রেশমিও বিয়ে করে। একটা ফুটফুটে বাচ্চা জন্ম দেয়, পাশাপাশি পড়াশোনাও চালায়। ওর বন্ধুদের কাছে শুনেছি কোনোদিন শ্বশুরবাড়ির বদনাম করেনি রেশমি; বরং এতো ভালো বলতো যে তা নিয়ে বন্ধুরা রীতিমতো তামাশা করতো। তবুও ভাঙেনি সে, ওই যে সংসার করার নেশা!

আমি ব্যস্ত। ওদের খবর নেই অনেকদিন। আরও একটা দিন আমার নিজের মতো শুরু হয়। দুপুরের খাবারের আগে ফোন আসে, মিস, রেশমিকে ওর জামাই মেরে ফেলছে! আমি সময় নিই, এরমধ্যে খবরটা নানাভাবে পৌঁছায় আমার কাছে। আমার নানাবিধ রঙের দুপুরের আলোয় আমি জানছিলাম না একটা মেয়ে কী এমন অন্যায় করলে তার সন্তানসহ তাকে গলা কেটে হত্যা করা যায়! শুনেছি রেশমি তার সঙ্কটের কথা বলেছিল তার আপনজনদের কাছে; আর সবচেয়ে কাছের মানুষেরাও বলেছিল, মানিয়ে নাও। মেয়েটিও ফিরে আসে আপনজনদের কাছ থেকে আশ্রয় না পেয়ে। সে মানিয়ে নিতে শিখে, এবং মানিয়ে নিতে নিতে লাশ হয়ে যায়। তাই তো যেদিন তার এমএ পরীক্ষার ফল বের হয় সেদিন তার জীবনের হিসেবও ফুরিয়ে যায়। অফিস থেকে ফিরতে পথে আমি ভাবছিলাম, মানিয়ে নিলে আজ আমি কোথায় থাকতাম!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.