ধর্মান্ধতার দখলে!

Tania Lopaতানিয়া মোর্শেদ: প্রথম ঘটনাটি ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালের কথা। কোথায় কে কি মুভি বানালো আর শুরু হয়ে গেল মার মার কাট কাট!! টিভিতে নামী একজন বললেন যে, কেন বারে বারে পশ্চিমা বিশ্বে মুহাম্মদ/ ইসলামকে ব্যাঙ্গ করা হয়! মুসলমানরা তো মুসা/ঈসাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করে না।

একজনের সাথে এ বিষয়ে কথা শুরু করতেই বললেন, “বাংলাদেশে সারা জীবন দেখে আসলাম, কোনো হিন্দু কারও সাথে তর্কাতর্কি শুরু হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই বলা হয়, “চুপ কর …।” আর ওয়াজ মাহফিলে, “ইহুদী/ নাসারা ……।”

এদেশের সংবিধান ব্যক্তিকে বাক স্বাধীনতা দিয়েছে তার কারণে সে চাইলে প্রেসিডেন্ট/ মুসা/ ঈসা/ মুহাম্মদসহ যে কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে মুভি বানাতে পারে। হ্যাঁ, চাইলে মানুষ আদালতে মানহানির মামলা করতে পারে। এদেশের সংবিধানের বিষয়টি কি প্রধানমন্ত্রীর জানা নেই! না কি ভোটের কারণে বললেন, “যুক্তরাষ্ট্রকে কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে।”

এদেশের বাক স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে এদেশের সরকারের বিরুদ্ধে শুধু নয়, ইহুদী আর খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে কথা বলেন অনেক মুসলমান। আর কেউ ইসলাম নিয়ে কথা বললেই লাগে! যে আচরণ নিজে সহ্য করা যায় না, তা অন্যের ক্ষেত্রে করা যায়!! শরিয়া আইন মেনে চলা মানুষও আছে এদেশে। ব্যক্তি জীবনে শুধু নয়, কেউ কেউ নিজের কমিউনিটির  মধ্যেও পারলে ফতোয়া জারি করতে চান/করেন। ইসলাম কেন, কোনো মুসলমানের কোনো কাজ/লেখায় কিছু বলা যাবে না (তাদের  পছন্দের ব্যক্তির/ মতের হলে)।

ফতোয়াবাজদের বন্ধু কী কম! মানুষ এতটাই দলবদ্ধভাবে বাস করে যে, জানার পরেও/ বোঝার পরেও/ আড়ালে সমালোচনা করবার পরেও ফতোয়াবাজদের সাথে কোলাকুলি করে/ পিঠ চাপড়িয়ে চলেন!

এবার আসি এক সাম্প্রতিক ঘটনায়। দিনটি ২৮ আগস্ট ২০১৩ সাল। শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী।

আজ পর্যন্ত শুধুই মুসলমান ধর্মান্ধদের সাথে প্রয়োজনে তর্ক করেছি, প্রতিবাদ করেছি, বলেছি, লিখেছি। আমি মনে করি অন্য ধর্মের ধর্মান্ধদের সাথে সেই ধর্মের বা সেই ধর্মের নাম বহন করা মানুষরাই তর্ক করবেন, প্রতিবাদ করবেন। আজ একবন্ধু শ্রীকৃষ্ণের ১৬০০ গোপিনী, একাধিক প্রেম নিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেয় (তার নাম হিন্দু ধর্মের পরিচয় বহন করে)।

মূল বক্তব্যই ছিল যে শ্রীকৃষ্ণ একাধিক প্রেম করতে পারলে নারীদের অসুবিধা কোথায়? লেখাটি মজা করে এবং নারীর অধিকারের বিষয়ে লেখা। সে নিজেই বলেছে যে, সে সারাজীবন শ্রীকৃষ্ণের প্রেমে পাগল। লেখাটি পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবে যে, ধর্মকে আঘাত করে নয়, নারীর অধিকার নিয়ে বলা। বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি। তাই আমার একাত্মতা জানাই। এও বলেছি যে, শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে গানের আমি ভীষণ ভক্ত। আর বাঁশির সাংঘাতিক ভক্ত। আরও বেশ কয়েকজন মতামত দিয়েছেন।

তারপরই শুরু হয়ে গেলো, লেখক ও আমাদের (যারা মূল বক্তব্যের সাথে একমত) আক্রমণ করে লেখা! চ্যালেঞ্জ দেওয়া হলো যে, আমরা যারা নামে মুসলমান পরিচয় বহন করি তারা মুহাম্মদের একাধিক বিবাহ, অল্প বয়স্ক নারী বিবাহ, পালিত পুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ ইত্যাদি বিষয়ে নীরব কেন? আমি একাধিকবার বলেছি যে, বলুন এসব বিষয়ে। আমার দিক থেকে কোনো ধর্মান্ধতার সাড়া পাবেন না এ বিষয়ে। তারপরও আক্রমণ চলছেই।

অনেক কথার পর আমি তাকে (বিশেষভাবে একজন কথা বলেই চলেছেন) বলেছি, তার কথায় বোঝা যাচ্ছে যে, সে ধর্মান্ধ। সে মানতে নারাজ যে সে ধর্মান্ধ। পুরুষতান্ত্রিক, ধর্মান্ধ কথা বলেই চলেছেন অথচ আমি যখন বলছি তখন বলছেন কোথায় পাচ্ছেন এসব? কেউ যদি জেগে জেগে ঘুমায় তাকে জাগাবে কে? লেখক (বন্ধুটি) খুব মন খারাপ করেছে, আমাকে ও অন্যদের এভাবে আক্রমণের শিকার হতে দেখে। তাই আমি বলেছি যে, সব ধর্মের ধর্মান্ধদের যদি এক জায়গায় কথা বলতে দেওয়া হয় কিছুক্ষণ পর বোঝা যাবে না যে কে কোন ধর্মের অনুসারী। আর কথার বিষয় যদি নারী বিদ্বেষ, পুরুষতান্ত্রিকতা হয় তাহলে তো কথাই নেই!

আমার সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকা মানুষটি আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলেই যাচ্ছে। এও বলেছে, আমাদের মত তথাকথিত নারীবাদীরা একসাথে হলে কিছুক্ষণ পর শাড়ী-গহনার গল্পই করবো! আমার সম্পর্কে সামান্য ধারণা থাকলে একথা আমাকে যে পছন্দ করে না সেও বলবে না। আর আমি আগেই বলেছি, আমি নারীবাদীর থেকেও বেশী ভাবি, করি। আমি মানবতাবাদী। এর বেশী নিজের সম্পর্কে বলবো না। আমার কাজ, আমার কথা, আমার জীবনবোধ, জীবনযাপনের সাথে সম্পূর্ণ এক। কে বিশ্বাস করলো না করলো আমার কিছু যায় আসে না। আমার বাড়ীতে কেউ নামাজ, পূজা, প্রার্থনা করতে চাইলে করতে পারেন। বলতে চাইছি যে, কোনো ধর্ম নিয়ে আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমি বিশ্বাস করি, ধর্ম বা অধর্ম, আস্তিকতা বা নাস্তিকতা  ব্যক্তিগত অধিকার। তবে ধর্মান্ধতা অবশ্যই নয়, যে ধর্মেরই হোক না কেন। আমারই বন্ধু/ পরিচিত কেউ যখন আমার নামের শেষ অংশ যে ধর্ম পরিচয় বহন করে সেই ধর্মের ধর্মান্ধদের কথা বলতে যেয়ে মাঝে মাঝে ধর্ম সম্পর্কেই বলে বসে এমন কিছু যা মানুষের অধিকারের অংশ, আমি কিছু বলি না। আমি একবারও তার ধর্মের আমার অপছন্দের জিনিসগুলো বলি না। কেন বলবো? মানুষের যে কোনো কিছু করবার অধিকার আছে  যতক্ষণ না তা কারো কোনো ক্ষতি করছে।

এই পৃথিবী এখন ধর্মান্ধদেরই দখলে! তাই হয়ত দেখবো যে, যে সব মানুষের অধিকারের জন্য সব সময় ভাবি, করি, বলি একদিন তারাই আমার পেছনে লাগতে দ্বিধা করবে না! ধর্ম যে একটি বিশ্বাস তা বোঝে না। আর কথায় কথায় তাদের বিশ্বাসের দেওয়ালে চিড় ধরে, কেউ কিছু (তাদের অপছন্দের) বললেই ভাবে, ধর্ম গেলো! ধর্মান্ধ মানুষ যেমন বোঝে না যুক্তি তেমনই তাদের মানবিকতাও নেই!

লেখক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.