উইমেন চ্যাপ্টার ডেস্ক:
ঢাকায় বনানীতে দুইজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণের আলোচিত মামলায় আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচজন আসামীর সব ক’জনকে খালাস দিয়েছে আদালত।
শুধু খালাসই যে দেয়া হয়েছে অভিযুক্তদের তাই নয়, সেখানে একজন বিচারপতি এমন মন্তব্যও করেছেন যে,
“মামলার দুই ভিকটিম বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভিকটিম দুজনই আগে থেকেই সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত, হাসপাতাল রিপোর্ট তাই বলে। অহেতুক তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন। এতে আদালতের ৯৪ কার্যদিবস নষ্ট হয়েছে। এরপর থেকে পুলিশকে এ বিষয় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। এছাড়া এখন থেকে ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর যদি কেউ মামলা করতে যায়, তা না নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।”
প্রথমত এমন একটি চাঞ্চল্যকর মামলার এমন রায়, যেখানে মামলার শুরুতে জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্তরা সবাই নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছিল। তারপরও আদালতের এমন রায়ে স্বাভাবিকভাবেই সবাই সংক্ষুব্ধ। বিশেষ করে বিচারপতির এমন মন্তব্য ভিকটিম ব্লেমিংকেই পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করা হলো।
২০১৭ সালের ২৮শে মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে আয়োজিত জন্মদিনের পার্টিতে দুইজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়।ধর্ষণের অভিযোগে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ ও তার দুই বন্ধুসহ মোট পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন দুই তরুণী। বিষয়টি নিয়ে সেসময় দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।
মোটামুটি এই হলো খবর। খবরের প্রতিক্রিয়ায় বন্যা আহমেদ লিখেছেন,
আমরা কি এখনো সেই ভিক্টিম ব্লেমিং এর আদিম যুগেই পড়ে আছি? কীসের নারী অধিকার, নারী প্রধানমন্ত্রী আর নারী বিচারক? কীসের উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট নিয়ে এত বড় বড় কথা? এটাকে আসলে আন্তর্জাতিকভাবে ভিক্টিম ব্লেমিং এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা দরকার, বিশ্বকে দেখানো দরকার কী ঘটে বাংলাদেশে! ধিক্কার দেওয়ার ইচ্ছাটুকুও চলে যায় নারী জাজের নিচের মন্তব্যটা দেখলে!!!
“মামলার দুই ভিকটিম বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভিকটিম দুজনই আগে থেকেই সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত, হাসপাতাল রিপোর্ট তাই বলে। অহেতুক তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন। এতে আদালতের ৯৪ কার্যদিবস নষ্ট হয়েছে। এরপর থেকে পুলিশকে এ বিষয় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। এছাড়া এখন থেকে ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর যদি কেউ মামলা করতে যায়, তা না নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।”
– কত টাকা দিয়ে কিনেছে প্রভাবশালী ধর্ষকদের বাপ এই জাজকে?
– তাহলে যারা নিয়মিত যৌনসঙ্গম করেন তাদের ধর্ষণ করা হালাল?
– আর কতদিন ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির শিকারদের এভাবে দোষী করা হবে?
– যতদূর মনে পড়ে ধর্ষণের শিকার কলেজ ছাত্রী ছিল, তাদের এত ক্ষমতা যে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে ফেলবে?
– ৭২ ঘন্টা, কীসের ৭২ ঘন্টা? এখন যেখানে পৃথিবীতে ৩০ বছর পরেও ধর্ষণের মামলা হচ্ছে!!!
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া লিখেছেন,
রেইনট্রি মামলার রায়ে বিজ্ঞ বিচারক যা বলেছেন বলে সংবাদমাধ্যমগুলো সংবাদ প্রচার করছে তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে বলতে হবে- বিচারক মহোদয় নিজের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে অযাচিত মন্তব্য করেছেন। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অভিযোগ করা কিংবা ডাক্তারি প্রত্যয়নপত্র ছাড়া ধর্ষণ মামলা না নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়ার তার কোন এক্তিয়ারই নেই। সবাই নিজেদের হাইকোর্ট ভাবতে শুরু করার ফল পাচ্ছি আমরা।
নওগাঁ থেকে সেদিন এক ক্লায়েন্ট এসে বললেন- “আমাকে ভাত কাপড় দেয়ার দরকার নেই, চাকরি দেয়ার দরকার নেই, প্রয়োজনে ভিক্ষা করে খাবো, কিন্তু আমাকে কোর্টে আসলে ন্যায় বিচার দেয়ার ব্যবস্থা করেন।”
অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক লিখেছেন,
৭২ ঘন্টা পর কোনো নির্যাতিত মানুষ তাঁর উপর সংগঠিত যৌন নির্যাতনের জন্য পুলিশের কাছে মামলা করতে পারবে না-আদালতের এই পর্যবেক্ষণের সাথে দ্বিমত পোষণ করছি। ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না- এটি একটি মেডিক্যাল ইস্যু। কিন্তু ধর্ষণ মামলায় শুধুমাত্র মেডিকেল ইস্যুই একমাত্র বিবেচনায় আসবে কেন? কেউ যদি কাউকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে ৭২ ঘন্টা পরে অপহৃতাকে ছেড়ে দেয়, তাহলে কি ধর্ষণের মামলা হবে না?
ধর্ষণে শুধু শারীরিক ক্ষতি হয় এমন নয়, এর সাথে গভীর মানসিক ক্ষতি জড়িত। ভিকটিম ভয়াবহ ট্রমার মধ্য দিয়ে যায়। আমাদের সামাজিক ট্যাবু এমন গভীর সেখানে কোনো ধর্ষিতা এমনটা ভাবতে পারেন না যে শরীরের উপর দিয়েই নির্যাতনটা গেল, আমি সুস্থ হয়ে উঠবো। সুতরাং কারো মাথা ফাটিয়ে দেয়া আর কাউকে ধর্ষণ করা, এই দুইজন নির্যাতিতের মানসিক ক্ষতি এক নয়। একজন নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আদালতে তাঁকে চরিত্রহীনা হিসেবে প্রমাণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।
সুতরাং মামলা করার সাহস সঞ্চয় করা সহজ নয়। যারা ধর্ষিত হন, তাঁদের বেশিরভাগই ভালনারেবল বলেই নির্যাতনের শিকার হন। তাঁদের ব্যক্তিগত সামাজিক প্রভাব, আর্থিক সঙ্গতি ও সাপোর্ট নেটওয়ার্ক কম থাকে। সেরকম কেউ মামলা করতে হলে পরিবারের সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়। সেই পরিবার এবং এই সমাজ তখন কালক্ষেপন করতে থাকে। সামাজিক মীমাংসার নাম বলেও অনেক সময় এসবকে দীর্ঘায়িত করা হয়।
এরকম অবস্থায় ধর্ষণ মামলা গ্রহণের সময়সীমা ৭২ ঘন্টায় বেঁধে দেয়াটা পুনর্বিবেচনার জোরালো দাবি রাখে। প্রয়োজনে আইন সংস্কার করতে হবে, ব্যাখ্যাগুলো স্পষ্ট করতে হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই যাতে কোনো ধর্ষক আইনের মারপ্যাঁচে ছাড়া পেয়ে না যায়, সেটাই নিশ্চিত করতে হবে যেকোনো মূল্যে।
উন্নয়ন কর্মী ও এক্টিভিস্ট ফেরদৌস আরা রুমী নারী বিচারক কামরুন্নাহারের রায়/মন্তব্য ও পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে কিছু প্রশ্ন করেছেন।
১. রেগুলার সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সে কি ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে পারে না?
২. বন্ধুদের সাথে জন্মদিনের পার্টি করতে গিয়ে মদ খেয়ে বেডে পাশাপাশি শুয়ে থাকলে কি তাকে ধর্ষণ জায়েজ? (বিচারক এমন মন্তব্যই করেছেন। এরকম পরিস্থিতিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটতেই পারে না।)
৩. তদন্ত কর্মকর্তা পাবলিকের সময় নষ্ট করেছেন কেন? এটা কোন গুরুত্বপূর্ণ মামলা না। মামুলি মামলা হলেও কি ধর্ষণের শাস্তি যেখানে মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে সেখানে মামুলি ধর্ষণের ঘটনাও কি এড়িয়ে যাওয়া যায়?
৪. মেডিক্যাল টেস্ট ছাড়া আর কোন আলামত বা সাক্ষী দিয়ে কি ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করা যায় না? ৭২ ঘন্টার বিষয়টি আসে কীভাবে? নিম্ন আদালত নাকি এমন আদেশ দিতেই পারেন না – একজন হাইকোর্টের আইনজীবী এই কথা বলেছেন। কিন্তু ম্যাডাম কামরুন্নাহার দিয়েছেন। কোন ক্ষমতাবলে আমরা তা জানি না।
৫. বিজ্ঞ বিচারক নিজেই ভিক্টিম ব্লেমিং করেছেন বারবার। জেন্ডার সংবেদনশীলতা শব্দটির সাথে তার কখনো পরিচয় ঘটেছে বলে মনে করি না। বরং পুরুষতন্ত্রের ধ্বজা পতপত করে উড়িয়ে বেশ আত্মতৃপ্তিতে রাতে ঘুম দিবেন বলে মনে হচ্ছে।
স্বভাবতই অনেকগুলো প্রশ্ন উঠেছে, যা এক্টিভিস্ট হিল্লোল দত্তের লেখনিতে আছে।
১. যারা নিয়মিত যৌনসঙ্গম করেন, তাঁরা কি ধর্ষণের শিকার হতে পারেন না? সেক্ষেত্রে তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা কি খর্ব হয়? হলে, কেন ও কীভাবে হয়?
২. যৌনসঙ্গমের অভ্যাস থাকার পরেও ধর্ষণের শিকার হলে সেটা বিচারের আওতায় আনা অহেতুক কেন হবে?
৩. তদন্তকারী কর্মকর্তা কার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন? ধর্ষিত কলেজছাত্রী? তাদের কতটা ক্ষমতা ছিল একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রভাবিত করার?
৪. আসামিরা নিজেরা দোষ স্বীকার করার পরেও কেন সেটা গ্রহণযোগ্য হয় না? প্রায় মাসখানেক পর ধর্ষণের আলামত কি থাকা সম্ভব?
৫. এরপর থেকে কি ধর্ষণের পর ৭২ ঘন্টা আটকে রাখলে ধর্ষকেরা বেকসুর খালাস পাবে? নাকি, ধর্ষণের শিকারকে খুন করলেই সব খতম?
মাননীয় ধর্মাবতারের কাছে কৈফিয়ত তলবের ক্ষমতা বা স্পর্ধা কিছুই নেই। আমি শুধু কিছু প্রশ্ন জানালাম যা যেকারোর মনে ওঠা স্বাভাবিক। এই মামলাটার ওপর রাষ্ট্র ও সমাজের অনেক জরুরি বিষয় নির্ভর করছিল। আসামিপক্ষ ক্ষমতাধর ও বিত্তশালী, এটা সারা দেশ জানে। বসুন্ধরার এমডি আনভীরের মুনিয়া কাণ্ডের মতো এটা সহজে চাপা পড়েনি। কিন্তু এই মামলার বিষয়ে আমরা চরম হতাশ ছাড়া আর কিছুই আপাতত হতে পারছি না। এই রায়ে ধর্ষণের বিচারপ্রার্থীদেরই দোষী হতে দেখা গেল বরং।
আশা করি, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা এব্যাপারে উচ্চ আদালতে বিচারপ্রার্থনার যথাযথ উদ্যোগ নেবেন।