শাশ্বতী বিশ্বাংগ্রী বহ্নি:
আজকাল এই হোমই আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হয়ে উঠেছে। হোমের সামনের অংশে ছোট্ট একটা বাগান। বাগানের গাছের পাতাগুলোর উপর রোদের খেলা আমি অপলক তাকিয়ে দেখতে থাকি। আমার জীবনের রোদ্দুর যে আজকাল আর তেমন হাসে না!! অবশ্য আজ বাইরে তেমন রোদ নেই।
ডাক্তার: দিদি, কী দেখছেন? আজ তো বাইরে রোদ নেই! মেঘলা…।
তনুজা: হুম। আজ শুক্রবার তো তাই রোদ্দুরের ছুটি!
ডাক্তার: (একটু হেসেই) বাহ, এভাবে তো ভেবে দেখিনি!
তনুজাঃ এ আমার ভাবনা নয়। জানেন, এইভাবেই কোন এক শুক্রবার, ছুটির দিন বলে অলস সকালে আমি আর রোদ্দুর জানালা দিয়ে বাসার সামনের বাগানটা দেখছিলাম। সেদিনও ঠিক এমনই মেঘলা ছিলো…হঠাৎ রোদ্দুর বলে উঠেছিলো, মাম্মা, আজ কোন রোদ নেই কেনো, জানো? আমি বললাম, কেনো? রোদ্দুর খিলখিলিয়ে হেসে বললো, আজ শুক্রবার, রোদের ছুটি!
ডাক্তার: বাহ!! এতোটুকুন বয়সেও ও এতো গুছিয়ে কথা বলতো?
তনুজা: হুম। আমার রোদ্দুর ছিলো ভীষণ মেধাবী, উচ্ছ্বল, হাসিখুশি একটা বাচ্চা! কিন্তু, আজ এমনদিনও আমাকে দেখতে হবে ভাবিনি…।
ডাক্তার: দেখুন, আমি তো সবেমাত্র দায়িত্ব পেয়েছি, তাই আমি একটু বিস্তারিত জানতে চাই। যদিও প্রাথমিকভাবে কিছু হিস্ট্রি আমি ফাইলে পড়েছি। কিন্তু, আমি আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই। তাড়াহুড়ো নেই। আপনি সময় নিয়ে বলতে পারেন।
তনুজা: রোদ্দুর খুব প্রাণোচ্ছল শিশু। মুহূর্তেই সবার সাথে ওর সখ্যতা হয়ে যেতো। আমাকে যে বিষয়টা খুব অবাক করতো, সেটা ছিলো ওর ম্যাচুরিটি! ভীষণরকম ম্যাচিউরড একটা বাচ্চা ছিলো। ওর বাবা আর আমার ঝগড়ার সময়গুলোতে ও অদ্ভুতভাবে নিজেকে সামলে নিত। আমাকে বা ওর বাবাকে কোন রকম বিরক্ত করতো না। একদম চুপচাপ হয়ে যেতো! কিন্তু, এভাবেই যে গুমরে গুমরে ওর ভেতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছিলো, তা একদম বুঝতে পারিনি। ওর বাবা আর আমার ঝগড়ার সময়গুলোতে ওর দিকে সেভাবে মনোযোগ দিতাম না। কেবল রাতের বেলা হয়তো একটু কাছে নিয়ে ঘুমাতাম। সে সময় নিজের মনের অজান্তে হাজার বার ওকে জিজ্ঞেস করতাম, তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো? তুমি কার সাথে থাকবে? সেও উত্তর দিতো, মাম্মা, আমি তোমাকে বেশি ভালোবাসি, তোমার সাথে থাকবো। যদিও আমি আবার ওকে বলতাম, কেনো? তোমাকে তো তোমার বাবা অনেক আদর করে, ভালোবাসে! রোদ্দুর খুব আস্তে করে উত্তর দিতো, কিন্তু, বাবা তো তোমাকে মারে! তখন সেভাবে বুঝতেই পারিনি, দিন দিন কতটা বদলে যাচ্ছে আমার রোদ্দুর!
একদিন রোদ্দুর আমার গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করছিলো, মাম্মা, আমি কি বড় হয়ে বাবা হবো? আমি বললাম, হ্যাঁ। রোদ্দুর এবার জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো, কিন্তু, আমি বাবা হতে চাই না!! বাবারা খারাপ। শুধু মারামারি করে! সেই থেকে শুরু… আমি ঘটনার আকষ্মিকতায় প্রথমে একদম বুঝে উঠতে পারিনি যে কী বলে রোদ্দুরকে শান্ত করবো! পরবর্তীতে দেখলাম, আমার রোদ্দুর যেকোনো রুমের একদম এক কোণায় মুখ লুকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে অথবা কীসব বিড়বিড় করে বলতে থাকে… জানতে চাইলে কিছুতেই বলে না অথবা অনেক বেশি চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে! এখন এর মাত্রা এতো বেশি বেড়েছে যে আমার মনে হলো, ওকে বাসায় রাখা ঠিক হবে না!! কারণ ও ওর বাবাকে একদম সহ্য করতে পারছে না। আমার রোদ্দুরের ছুটি দরকার……. (কান্নায় ভেঙে পড়ে তনুজা)
ডাক্তার: আপনি কাঁদবেন না, প্লিজ…। আমরা তো আছি। রোদ্দুর অবশ্যই ভালো হয়ে যাবে। আবার আগের মতো ঝলমলিয়ে হেসে উঠবে।
এমন সময় রোদ্দুর থেরাপি রুম থেকে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মাম্মা, আমার নাম রোদ্দুর কেনো জানো? তনুজা যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, কেনো, বাবা? রোদ্দুর হেসে বলে ওঠে, তোমার চোখের বৃষ্টির পানি শুকিয়ে দেওয়ার জন্য…!