ব্যালেন্স

ফাহমিদা খানম:

জীবনের কিছুক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বলে আলাদা কিছু নেই, সবাই অসহায় থাকে জীবনের কাছে। অফিস ফেরত আমি ক্লান্ত হয়ে এসে বউয়ের মলিন মুখ আর মায়ের দ্বন্দ্বে প্রতিদিন রক্তাক্ত হতে থাকি, অথচ দুজনের কেউই মুখ ফুটে কিছুই জানায় না। মাঝেমধ্যে মনে হয় দূরে কোথাও চলে যাই, কিন্তু দায়িত্ব আর কর্তব্যের চাপে সেটাও আর হয়ে উঠে না।
রাতে খাবার টেবিলে মাকে না দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নীরুর মুখের দিকে তাকাই। সে জানায়, মায়ের খিদে নেই।
আমি মায়ের রুমে গিয়ে পাশে বসে বলি –

“খেতে আসুন আম্মা, না খেলে আপনার ডায়াবেটিস রাতে পড়ে যেতে পারে”
“খিদা লাগলে বিস্কুট আছে, মুড়ি আছে, খেয়ে নিবো”
মা এলেন না বলে দুজনেই নিঃশব্দে খেয়ে নিলাম।

“নীরু, কী হয়েছে আমাকে একটু জানাবে?”
“অনলাইনে কিছু জিনিস অর্ডার করেছিলাম, সেগুলো আসার পরেই মায়ের মুড অফ। অবশ্য আমি প্রথম থেকেই দেখেছি আমার কিছুই উনার পছন্দ হয় না”
“এভাবে ভাবছো কেনো? মা একটু পুরনো দিনের মানুষ, বোঝার চেষ্টা করো, মায়ের জন্যেও যদি একটা কিছু কিনতে, উনি অবশ্যই খুশি হতেন”
“খাবার কিছু অর্ডার করলে উনি খেতে চান না, খুঁতখুঁত করেন, ছুঁয়েও দেখেন না, আমি কী করবো বলো? উনি চান, আমি ঘরেই সব করি, অথচ সারাদিন পর বাসায় এসে এসব করার এনার্জি পাই না, এটা কেনো বোঝেন না?”

স্ত্রীর চোখের সামনে আমি অসহায় বোধ করতে থাকি। হ্যাঁ জানি, মায়ের কিছুটা খুঁতখুঁতে রোগ আছে, কিন্তু মা আদতে সে রকম না। নীরু একটা কলেজে জব করে, বেশ দূরে বলে আসা যাওয়াতেই প্রচুর সময় নষ্ট হয়। জ্যাম ঠেলে এসে হয়তো ক্লান্ত থাকে, অথচ মা চায় বউ হিসাবে সংসারের সব দায়িত্ব নীরু সামলাক।

পরের সপ্তাহে ছুটির দিনে এক কলিগের সাথে আমরা ঢাকার বাইরে ঘুরতে যাবার প্ল্যান করে মাকে সাথে নিতে চাইলে মা রাজি হলেন না। এক রকম জোর করেই সাথে নিলেও সারাটা পথ বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলেন, দুপুরে খাবার সময়েও একই অবস্থা দেখে নীরু ইশারায় বুঝালো, বাসায় রেখে এলেই ভালো করতে। আমার শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়। বিশাল সংসারের কাজের চাপে মা আমার কখনও নিজের শখ পূরণ করতে পারেননি। তার জীবনের আনন্দের ঘটনা জানতে চাইলে বিয়ের আগের স্মৃতি আর আমাদের তিন ভাইবোনের জন্ম ছাড়া অন্যকিছুর কথা বলতে পারতেন না। সবার প্রতি দায়িত্ব আর কর্তব্যের চাপে রান্নাঘর আর সবার মন জুগিয়ে চলেছে শুধু। ঘরের বাইরে যে একটা জগত আছে, আমার মা তার দেখাই পায়নি। ঈদের সময় দাদী বাবাকে লম্বা লিস্টি ধরিয়ে দিতেন, সেখানে ফুফু আর তাদের স্বামীদের নাম থাকতো, চাচাদের নাম থাকতো, কিন্তু মায়ের নাম কখনোই সেই লিস্টিতে উঠতো না। ঈদের দিন বলে আলাদাভাবে তার ছুটিও ছিল না, সারাটা দিন রান্নাঘরেই কেটে যেতো, সবার পরনে নতুন জামা-কাপড় থাকলেও মায়ের পরার মতো সুযোগ মিলতো না। এভাবেই বছরের পর বছর কেটেছে মায়ের। সংসারের বড় বৌ বলে বাড়িতেও যাবার সুযোগ হতো না। আমি মাকে গোপনে চোখের পানি ফেলতে দেখতাম ।

পরের সপ্তাহে মাকে নিয়ে একা ঘুরতে বের হলাম, এক নদীর ধারে নিয়ে গেলাম তার সাথে একান্তে কিছু কথা বলার জন্যে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, মা একটা লাল ফড়িঙয়ের পিছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছে –
“বুঝলি, ছোটবেলায় ওদের ধরে পিছনে সুতো বেঁধে দিতাম, আহারে কতো কষ্ট দিয়েছি”
“মা আমার পাশে বসেন একটু গল্প করি”
“আচ্ছা এই নদীতে নৌকা আছে, আমায় একটু ঘুরাবি?”

আমি দুই ঘন্টার চুক্তি নিয়ে নৌকা ভাড়া করে মাকে নিয়ে উঠলাম।
“মা, যুগ পাল্টে গেছে ,আপনি চাইলেও সব আগের মতো হবে না”
“আমিও তো পরিবারের বড় বউ ছিলাম, একা হাতে কি এতোবড় সংসার চালাইনি? সব কাজের আগে তোর দাদীর অনুমতি নিতো হতো আমাকে”।

“সেসবের বিনিময়ে আপনি কী পেয়েছেন মা? সবার জন্যে করতে গিয়ে নিজের আস্ত জীবনটা কেটেছে, আপনার ত্যাগের কথা কেউ কি মনে রেখেছিল?”
ঘোর লাগা দৃষ্টিতে মা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন –
“তোর বাবা মায়ের অনুমতি ছাড়া কিছুই করতো না। আমি যে রক্তমাংসের একটা মানুষ ছিলাম, আমার যে শখ আহ্লাদ আছে, সেগুলো কেউ কখনও জানতেও চায়নি।আমি তো নিজের মা-বাবা বা ছোট ভাইবোনদের জন্যেও কিছুই করতে পারিনি কখনও। অথচ সংসারে অভাব ছিলো না, কিন্তু মাসের প্রথমেই তোর দাদীর হাতে তোর বাবা টাকা দিতো, আর নিজের কাছে রাখতো”।

“আপনার কি ভালো লাগবে আমার ছোট বোনের এমন বিয়ে হলে?”
মা অনেকক্ষণ চুপ করে উত্তর দিলেন,
“আমি তো হাতে কখনও টাকা পাইনি, তাই অহেতুক খরচ করলে আমার খারাপ লাগে”
“মা, নীরুর কলেজ বাসা থেকে অনেক দূরে ,আসা যাওয়া আর জ্যাম ঠেলে এসে শপিং করার সময় পায় না বলে অনলাইনে কেনাকাটা সারে, আর এটা ফালতু খরচ না, ও নিজেই ইনকাম করে”
“চাকুরী না করলে কী হয়? সারাটা দিন আমি বাসায় একা থাকি, সে খেয়াল আছে তোমাদের?”
“ও যদি চাকুরী ছেড়ে দেয় তাহলে সিয়াম আর ছোটনের খরচ একা টানতে আমার উপরে খুব চাপ পড়ে যাবে মা, আপনার মতো আপনার বৌমাও একসময় আক্ষেপ করবে তার কোনো শখ আমি পূরণ করতে পারিনি। আপনি নীরুর জায়গায় ছোটনকে কল্পনা করুন মা। আমরা যদি একজনকে আপন করে নিতে পারি, তাহলে অন্য কেউ এসে আমাদের ছোটনকে একই সম্মান দিবে”।
রাতে ফিরে মা কিছুই খেলেন না, বাঁধা কাজের মেয়েটাকে দিয়ে জানালেন, তার খুব মাথাব্যথা, তাই খাবেন না, আজকে আমি জোর না করলেও নীরু রুমে খাবার নিয়ে যাবার পর ঠিকই নিঃশব্দে খেলেন।

আমি জানি মায়ের ভেতরে টানাপোড়েন চলছে। আমি মাকে দেখেই অনেক কিছু শিখেছিলাম। আমি বুঝি মা ইচ্ছা করে নীরুর সাথে এমন করেন না, তার আক্ষেপগুলো মনের ভেতরে রয়ে গেছে বলেই অজান্তে এমন আচরণ করে বসেন। অথচ নীরু ভাবে, মা নীরুকে পছন্দই করে না। মায়ের ত্যাগগুলো কাছ থেকে দেখেছি বলেই শিক্ষা নিয়েছি। সন্তান হিসাবে তার প্রতি আমার যেমন কর্তব্য আছে, স্ত্রীর প্রতিও আছে। আমি জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্যালেন্স করার চেষ্টা করছি মাত্র!

মায়ের কথা

বিয়ের পর থেকে শুধু দায়িত্ব নিতেই হইছে, সংসারের চাপে নিজের ইচ্ছের কথাও কখনও কেউ জানতে চায়নি। আজ ছেলের কথায় বাস্তবতায় ফিরলাম, অথচ সারাটা জীবন ভেবেছি আমি যা পাইনি আমার ছেলের বউদের সেই স্বাধীনতাটুকু আমিই দিবো। সত্যিই তো একটা মেয়ে তার জগতের সবটা ছেড়ে আসে আমরা যদি না বুঝি, তাহলে কীভাবে হবে! নিজের অজান্তেই হয়তো ভুল করেছি। মাসের প্রথমেই ছেলে কিছু টাকা হাতে দিয়ে বারবার বলে, আমার যা মনে চায় আমি যেন করি, আমার কান্না পায় খুব। একটা বয়সের পর কিছুই আর ইচ্ছে করে না। ভোরের পদ্ম কি আর মধ্য দুপুরে ফোটে? এই এতোটুকুন ছিলো ছেলে, এতোকিছু যে খেয়াল করে এটাই বুঝিনি। মেয়েটা এগ্রিকালচারে আর ছোট ছেলেটা কুয়েটে পড়ে। ওদের খরচ ছেলেই চালায়। ঢাকা শহরে ভাড়া বাসা, বাঁধা বুয়া আর দুই বাচ্চার খরচ একা চালানো যে কতটা কষ্টকর বুঝতে পেরে নিজেই লজ্জা পাচ্ছি। শিক্ষায় কোনো বয়স নাই, নীরু আর আমার মধ্যে যে দূরত্ব চলে এসেছে তাকে ঘুচাতে আমাকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে বৈকি!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.