“হিন্দু মরলে আমার কী”: ত্রাস ও সহিংসতার রাজনীতির নেপথ্যের বয়ান

স্নিগ্ধা রেজওয়ানা:

আমি জানি, আমার বলা না বলাতে, লেখা বা না লেখাতে কিছু আসে যায় না। একটা স্ট্যাটাস দিয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য লেখার কোন ইচ্ছা আমার নেই। আমি জানি আর দশটা সাধারণ বাংলাদেশির মতো আমিও এমন একজন বাংলাদেশী, যে কিনা ক্ষমতা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করে, পদাবলীর ক্ষমতা গুনে নিরুপায় এবং নিরস্ত্র। তবে জানেন, আমি ভীষণভাবে ক্ষমতাশীল, শুধুমাত্র এই কারণে আমার দাদা আমার বাবা ইসলাম ধর্মের ধারক-বাহক ঘটনাচক্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে আমার জন্ম। কাজেই এতো এতো অসুবিধার মাঝেও আমি ভীষণভাবে সুবিধাবাদী সুবিধাভোগী আমজনতা। কারণ আমি তো “সংখ্যাগরিষ্ঠ”। তবে হ্যাঁ, শিক্ষক হিসেবে আর দশজনের মতো চোখে সর্ষেফুল না দেখে একটু আহারে উহুরে করে যদি আমি ঘ্যানর ঘ্যানর না করি, তাহলে কি আমার মান ইজ্জত থাকে, বলেন? তাই এই লেখা লিখতে বসা, তবে কি জানেন এই যে লজ্জা শরম কিছু যে অবশিষ্ট আছে আমার, তাতেই কিন্তু মানুষ হিসেবে এখনও আয়নাযর সামনে নিজে দাঁড়াতে পারছি।

আমার এতো ভীষণ লজ্জা লাগছে যে বাংলাদেশের আমার সনাতন ধর্মালম্বী বন্ধু ছাত্র-শিক্ষক সহকর্মীদের সাথে কথা বলার বা তাদের খোঁজখবর নেয়ার সাহস শক্তি ও সঞ্চয় করতে পারছি না। আমার কেবলই মনে হচ্ছে আমি যখন যতবার তাদের সাথে কথা বলতে যাব, কী ভীষণ ঘৃণা নিয়ে তারা আমার দিকে তাকাবে, কী বিষাক্ত বিষবাষ্পে আমার পুরো নিঃশ্বাস আসক্ত হয়ে যাবে, কারণ তারাও তো রক্ত মাংসের মানুষ। এ ঘটনা তো বাংলাদেশে প্রথম ঘটা কোন ঘটনা নয়, গত দশ পনের বছরে নিয়মিত চর্চার অংশ ।প্রতিবছর আমি লজ্জাবোধ করি, প্রতিবছর আমি দুঃখিত হই প্রতিবছর আমি ক্ষমা প্রার্থনা করি, প্রতিবছর আমার লজ্জা লাগে, না কিন্তু তারপরেও আমি হাল ছাড়ছি না।

মনে পড়ে এই বছর দুয়েক আগে যখন প্রিয়া সাহা ট্রাম্পের কাছে নালিশ করেছিলের বাংলাদেশের হিন্দুদের দুর্বিষহ জীবন নিয়ে, তা নিয়ে সে সময় চলছিল নানা ধরনের কটাক্ষ, হাসাহাসি, ভীষণ মাত্রার তামাশা। তখন আমি তার পক্ষে অবস্থান নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম, যেখানে বলেছিলাম, হতে পারে ট্রাম্পের মতো একটি চরিত্রের কাছে নালিশ করাটা ভীষণভাবে অর্থহীন, হাস্যকর, কিন্তু যে অভিযোগগুলো তিনি করেছিলেন তা কি কোন কোনভাবে অলীক বা অবাস্তব?

গত দশ পনের বছর ধরে তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামগুলোতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সার্বক্ষণিক ওয়াজ মাহফিল চলে সেই বিষয়ে কি কোন ভাবে কখনো আমাদের প্রশাসন বা তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মহল দৃষ্টিপাত করেছেন? আপনাদের কি মনে হয় ওয়াজ মাহফিলের বয়ান তার কি কোন ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করে না? তা কি আমজনতার মস্তিষ্ককে মোহছন্ন করে না? এদেশের সরকার প্রশাসন ডিজিটাল নিরাপত্তা এক ব্যবহার করে সরকারের বিরুদ্ধে কোন প্রচার-প্রচারণা হলে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ।কিন্তু যখন এই সকল ওয়াজ এর বিস্তার ঘটে ইউটিউবে সোশ্যাল মিডিয়া এবং তার মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়ে নারীদের সম্পর্কে কুৎসিত আলাপ , মুসলমান বনাম অপরাপর ধর্মালম্বী মধ্যকার বিভাজন তৈরি করা , উৎসবের বিভাজন তৈরি করার ন্যারেটিভ, ভাস্কর্য ভাঙ্গা ভাঙতে অনুপ্রাণিত করার রাজনৈতিক এজেন্ডা, তখন এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কোন থলিতে লুকিয়ে রাখা হয়?

রাষ্ট্র যখন স্বপ্রণোদিতভাবে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন না করে, তার দায়িত্ব এড়াতে গ্রামের পর গ্রাম অলিতে-গলিতে কেবলমাত্র মাদ্রাসা, এতিমখানা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মৌলবাদীদের উদ্দীপনাকে উজ্জীবিত করে যায় তখন আপনি এর থেকে কিভাবে সে প্রত্যাশা করতে পারেন। ভাবুনতো গত দশ পনের বছরে বাংলাদেশে কয়টি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকারি উদ্যোগে? দরিদ্র, অসহায়, এতিম, অনাথ তারাই কি শুধু মাদ্রাসায় পড়ে? উত্তর, এক বাক্যে বলে দেওয়া যায়, না। রাষ্ট্রীয় অক্ষমতার সূত্র ধরে এই তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা, তিন ধরনের বিভাজন, তিন ধরনের মতবাদ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে যার সুতিকা হচ্ছে ক্ষমতার লোভ।

একই সাথে ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার রাজনীতি ও তার প্রপাগান্ডা। এই ধর্মানুভূতি রাজনীতির খেলা টি ও ভীষণভাবে ক্ষমতা সম্পর্কের সাথে যুক্ত। আর কার অনুভূতি কে আপনি ধর্মানুভুতিতে আঘাত বলবেন সেটিও ভীষণভাবে রাজনৈতিক বটে। আমাদের মনস্তত্ত্ব এমনভাবে তৈরী থাকে, যেখানে চেতন এবং অবচেতন মনে আমরা বিভক্তি এবং এই ধর্মানুভূতি খেলার “সংখ্যাগুরু”বনাম “সংখ্যালঘুর” রাজনীতিকে ধারণ করি। এমনকি আমাদের প্রতিবাদের ভাষার মধ্যেও এক ধরনের অবহেলা এবং অবজ্ঞা ভীষণ ভাবে লক্ষণীয় যা প্রমাণ করে আমাদের মনস্তত্ত্বের সাম্প্রদায়িকতাকে।

লক্ষ্য করে দেখুন, গত কয়েকদিনে বিভিন্ন মানুষ যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন এবং বলেছেন, “বাংলাদেশের কোন হিন্দুর সাহস নাই যে সে গণেশের ঠেঙ্গের উপর এর উপরে কোরআন দিয়ে আসতে পারে”। খেয়াল করে দেখুন, প্রথমত: ধর্মালম্বীদের এই যে সাহস না থাকতে পারা এটি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের সনাতন ধর্মালম্বীদের ক্ষমতা সম্পর্কের অবস্থান, দ্বিতীয়তঃ এখানে যে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ভীষণ অবলীলায় “গণেশের ঠেঙ্গের উপর”, এটা কি কোনভাবে ধৃষ্টতা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে? ভেবে দেখুন তো, ঠিক একই ধরনের শব্দের ব্যবহার ইসলামের কোন খলিফা, নবী, পয়গম্বর সম্পর্কে বা এমনকি আজরাইলের সম্পর্কে কি বলা সম্ভব? উত্তরটা নিজেরাই নিজেদেরকে প্রশ্ন করে জেনে নিন। কিন্তু যে প্রসঙ্গটি আমি এখানে উত্থাপন করতে চাচ্ছি, সেটা হচ্ছে, আমাদের ভাষা আমাদের মনস্তত্ত্বকে খুব স্পেশালভাবে পরিবেশন করে এবং এই মনস্তত্ত্বের মধ্যে নিহিত আছে ক্ষমতার দাপট। ক্ষমতাটি হচ্ছে আপনি আমি সংখ্যাগরিষ্ঠের ধারক, অর্থাৎ আমরা মুসলমান আর তারা হচ্ছে অমুসলিম। ধর্মানুভূতিতে আঘাত প্রসঙ্গটি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে মুসলমানের একক সম্পত্তি। ঠিক যেমন ভারতে ধর্মানুভূতির প্রসঙ্গটি বিজেপি সমর্থিত উগ্র হিন্দুদের একক সম্পত্তি। ধর্মানুভূতির এই আঘাতের রাজনীতিতে অনেক বেশি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, ঈশ্বরের ক্ষমতা নির্ভর করে তার অনুসারীর ক্ষমতা গুনে। মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে ভক্তিটি কী ঈশ্বরের প্রতি নাকি ক্ষমতার প্রতি?

যাই হোক, এবার একটু শিক্ষক হিসেবে নিজেদের চরিত্র বর্ণনা করি, বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের কিছু মহলে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও তারকা শিক্ষকগণ সেকুলারিজমের ক্রিটিসিজম করতে ভীষণভাবে উৎসাহিত বোধ করেন এবং মনে করেন তালাল আসাদ হচ্ছেন একমাত্র মহান “বুদ্ধা ” যাকে পাঠ করা বাংলাদেশের জন্য ভীষণভাবে জরুরি। মানে ভাবখানা এরকম বাংলাদেশের জনগণ ভীষণভাবে সেকুলার চর্চা করেন এবং দেখতে পারে না, যে সেক্যুলারিজমের ভূত কিভাবে প্রান্তিক কে আরো প্রান্তিক করে তুলে।

পশ্চিমা দুনিয়ায় বসে তালাল আসাদ এর এই তত্ত্বের বিষয়ে আমার কোন দ্বিমত নেই! কিন্তু বক্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এই তত্ত্বের প্রচার-প্রচারণা এবং তার রাজনৈতিক এজেন্ডা কতখানি যুক্তিযুক্ত? যে রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত সেকুলারিজম চর্চার ক খুব শিখতে পারেনি এবং এবং যে রাষ্ট্র একতরফাভাবে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের মৌলবাদিতা, তার একটি রাজনৈতিক এজেন্ডা সাথে যুক্ত করে সার্বক্ষণিক প্রমোট করা কেন জরুরি তার খুব বিনয়ের সাথে আমার জানতে ইচ্ছা করে। এখন পর্যন্ত যে সমাজে সেক্যুলারিজমের চর্চার কোন হদিস মিলে না, সেখানে তার ক্রিটিসিজম করার মধ্য দিয়ে এ সকল বিশিষ্ট তারকা শিক্ষকদের যেই জনপ্রিয় হওয়ার চাহিদা তার জন্য ও আমি ভীষণ ভাবে লজ্জিত বোধ করি।

সবশেষে এতোটুকুই বলবো, যেই বিভেদের আগুনে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী মহল, বিদ্বেষ ও সহিংসতার দহন লাগানোর চেষ্টা করছেন, সেই দহনে নিজে যেনো আক্রান্ত না হন সে বিষয়ে অন্তত চিন্তা করতে শিখুন।

স্নিগ্ধা রেজওয়ানা (পিএইচডি)
শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.