“বিভেদের দেয়াল গুঁড়িয়ে সম্প্রীতি আসুক আমার উঠোনে”

সাবিরা শাওন:

গত কয়েকদিনের প্রচণ্ড দাবদাহ শেষে আজকের সকালটা নরম আলোমাখা ছিলো। বেশ আরাম লাগছিল। আমি যখন এই আয়েশে চোখবুঁজে শান্তির রোদ গায়ে মাখছি তখনও রংপুরে পীরগঞ্জে অনেক ঘরের কড়িকাঠে জ্বলছে মিটমিটে আগুন৷ কী ভয়ানক এক দৈত্যে’র মুঠোয় বন্দী আমরা!!

ভেবেছিলাম কিচ্ছু বলবো না, কিচ্ছু লিখবো না। ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে শুধু চুপচাপ শান্তির বুলি আওড়াবো ঝড়ের শেষে বিধ্বস্ত নগরীতে৷ কিন্তু না, এখনও সব অনুভূতিতে পচন ধরেনি বলেই বোধহয় ক্রোধ আর ক্রন্দনের একটা জ্বালা শান্তিতে বসবাস করতে দিচ্ছে না।

একদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে শান্তির বাণী প্রচার আর অন্যদিকে দৈত্যে’র তাণ্ডব৷ হাস্যকর হলেও সত্য এই দৈত্যে’র জন্ম কিন্ত শান্তি বিচ্যুত একদল থেকেই।
ধর্মের বাণী দিয়ে অধর্মের এমন উপশম করার প্রবণতা দেখে ঠিক মন ভালো হচ্ছে না। বিষয়টি এমন যে, এক মলমের অতিরিক্ত প্রয়োগে চামড়া পুড়ে গেলে অন্য আরেক মলমের প্রলেপ লাগিয়ে সাময়িক শুশ্রূষা করা। অথচ ক্ষত কিন্তু সারে না। দগদগে বিচ্ছিরি দাগটা থেকে যায়।

এই যে, মন্দিরের ভাংচুর হলো, পুরো উৎসবটাকে নষ্ট করে সম্প্রীতির চাদর ছিড়েখুঁড়ে টুকরো টুকরো করা হলো এর জন্য আমরা কী ভাবছি?

ইসলাম শান্তির ধর্ম। এই ধর্ম এমন অনিষ্টতার বিরোধী এবং যারা এই ঘৃণ্য কাজটি করেছেন তারা কোনভাবেই মুসলিম কিংবা হিন্দুবহতে পারেন না। তার কোন ধর্ম নেই। – এই ধরনের বহুল চর্চিত স্ট্যাটাস ফেসবুকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এবং সমস্যা আমার এই জায়গাতেই। ধর্মের নামে অধর্ম যা হচ্ছে সেটাকে প্রশমনের জন্য আবার ধর্মের প্রলেপ লাগানোটাকে আমার সাময়িক শুশ্রূষাই মনে হচ্ছে। যদি তাই না হবে তাহলে, অতীতে ঘটে যাওয়া এমন কুৎসিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতো না।

আমি বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখার বিরোধিতা করছি। আবারও বলছি, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখার বিরোধিতা করছি। কারণ, আমি যখন একটি ধর্মকে সাংবিধানিকভাবে ঘোষণা দিচ্ছি, তখন অন্য ধর্মগুলোকে স্বাভাবিকভাবেই বুড়ো আঙুল দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে সকল চরমপন্থীরা। এবং এই দুঃসাহসটুকু করে দিয়েছে আমার রাষ্ট্রযন্ত্র।
আজকের এই অরাজক পরিস্থিতির দায় আমার রাষ্ট্রের, তার প্রতিনিধিদের এবং আমাদের সকলের।

এই দ্বিচারিতা দেখে ভাবতে কষ্ট হয়, আমরাই কি না বিভেদহীন, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাওয়ার জন্য ৭১’এ জীবন দিয়েছি! আমাদের জাতির পিতা ও তাঁর সঙ্গী বিজ্ঞজনেরা বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলেছেন!
সত্যি নাকি??
এই নষ্ট প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে একবার ছুঁতে চাই সেই সংবিধানকে। পারবো কি?

ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম থাকবে এটা প্রায় সব মুসলিম চাইছেন এবং এটা প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য অন্যের জীবন নিতেও কুণ্ঠাবোধ করবেন না জানি। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, বৃত্তের ভেতরে থেকে তার বাইরের পৃথিবী সাজাবেন, ভাবনাটা কেমন গোলমেলে না??
অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনেই যদি থাকবো তবে তা শর্তহীন হোক।

আবার এটাও ঠিক শুধু রাষ্ট্রধর্মের বিরোধিতা করলেই সব শেষ নয়। এই অমানবিক অন্ধকারে ঘোঁট পাকিয়ে আছে অনেকগুলো সুতো, নষ্ট রাজনীতি থেকে শুরু করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, জবাবদিহীতার অভাব, সরকারি প্রতিনিধিদের অদূরদর্শিতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, মগজের সুস্থ বিকাশের অভাব, আর আমাদের অবিবেচক হবার প্রতিযোগিতা এই সবকিছু মিলিয়ে অন্ধকারটা যেন ক্রমশঃ গাঢ় হচ্ছে। জানি না আলো আসবে কী না।

তবে ৯০% মুসলমানদের দেশে অন্য ধর্মাবলম্বীরা অতিথি হিসেবে নয়, তারা থাকুক আমাদের বন্ধু, ভাই কিংবা আপনার জন হয়ে। এই সুন্দর ভাবনাটা যারা ভাবছেন, তারা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবেন সাম্যতা মানে গরিষ্ঠতা আর লঘিষ্ঠতার বিশ্রী অনুপাত নয়।

“পৃথিবীটা মানুষের হোক,
ধর্ম থাকুক অন্তরে।
মসজিদে আজান হোক,
ঘন্টা বাজুক মন্দিরে।”
(সংগৃহীত)

আমি এই বাংলার মাটি জলে গড়া প্রাণ এই হোক আমার পরিচয়।

– সাবিরা শাওন, উন্নয়ন কর্মী।

(ফিচারে ব্যবহৃত ছবিটি সংগৃহীত)

শেয়ার করুন: