ফারজানা নীলা:
সখের বশে না প্রয়োজনে যখন অর্থ উপার্জন করতে হয় তখন জীবনের অনেক কঠিন সময় দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যেতে হয়। কিন্তু চাকরি ছাড়ার কথা চিন্তাও করা যায় না। তেমনই এক কঠিন সময় হচ্ছে কর্মরত অবস্থায় গর্ভধারণ করা।
এখন বলতে পারেন, কেন, সরকার তো ছয় মাসের ছুটি দিয়েছেই। আর কী চান?
না, ছুটি নিয়ে কারও কোনো সমস্যা থাকার কথা না। বেসরকারি অফিসভেদে এই ছুটির তারতম্য ঘটে, সেটা আলাদা কথা।
বলতে চাচ্ছি মানসিক শান্তির কথা। যদি হয় এটি কোনো প্রতিযোগিতামূলক প্রতিষ্ঠান বা কাজ, যদি জীবনে ক্যারিয়ারের গুরুত্ব অনেক হয় তবে অতি অবশ্যই একটা মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয় এই সময়।
আপনার গর্ভধারণে অনেকে খুশি হয় এই ভেবেও যে এখন আপনাকে টপকিয়ে উঠে যাওয়া যাবে সহজে। আপনি “অসুস্থ” এই ট্যাগ দিয়ে অনেক কিছুই নিয়ে নিবে। আপনিও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবেন শুধু।
অথবা মনে মনে খুশি হবেন ভেবে যে কেউ আপনার কাজ করে দিচ্ছে। কিন্তু পরবর্তীতে কাজগুলো আর ফেরত পাবেন না। আপনাকে আকারে ইঙ্গিতে অনেক কিছু বলা হবে, বলে বলে বুঝিয়ে দিবে যে এখন আপনি একটা ‘বাতিল মাল’। একজন নারী গর্ভবতী হওয়া মানে তার সকল শারীরিক শক্তির বিলোপ হওয়া, মানসিকভাবে দুর্বল হওয়া। “রেস্ট” নেওয়া ছাড়া জগতের কোনো কাজে সে যোগ্য না বলে সিলগালা লেগে যাওয়া।
এবং বাচ্চা হওয়ার পর সে তো আরও দুর্বল! সন্তানের প্রতিই তার সকল মনোযোগ থাকবে, অফিসের কাজে কতটুকুই বা মন দিতে পারবে, বারবার ছুটি নিবে, ছুটির বাহানা খুঁজবে। সুতরাং সে আর কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজে আসবে না। এক কোণে পড়ে থাকবে!
এই যে মানসিক অশান্তির ভেতর দিয়ে আপনাকে যেতে হয় সেটা আসলে যে বা যারা যায় তারাই বুঝতে পারে ব্যাপারটা কতটা মারাত্মক।
একজন গর্ভবতী নারীর শরীরের পরিবর্তনের সাথে সাথে মনেরও হাজারটা পরিবর্তন হয়। এই মনের পরিবর্তনের জন্য আমরা চাই যেন তার পরিবার তাকে বুঝুক, তাঁকে সময় দিক, তার পরিবর্তন গুলো যেন মেনে নেয়।
কিন্তু অফিসকে কে বুঝাবে?
কর্পোরেট জগতে সব সময় একটা প্রতিযোগিতা থাকে কে কার থেকে ভালো করবে, বসের সাথে সম্পর্ক ভালো রেখে কে এগিয়ে যাবে, কে কাকে ডিঙিয়ে যাবে। এই প্রতিযোগিতায় নিজেকে সবচেয়ে দুর্বল মনে হয় যখন আপনি গর্ভধারণ করেন। এই সময় নারী মানসিকভাবে সবচেয়ে ভঙ্গুর থাকে। এই অবস্থায় একটা তুচ্ছ কথাও মন এবং শরীরকে দুমড়ে ফেলতে সক্ষম।
অথচ অতিরিক্ত ভার কিন্তু ঐ গর্ভবতী নারীটিই বহন করছে। তাকেই একটা প্রাণ ভেতরে নিয়ে বাসা-অফিস সবই ম্যানেজ করতে হয়। এতোদিন সে যা যা করে আসছে, বর্তমানেও তাকে সেই কাজগুলোই করতে হচ্ছে। এবং অন্যরাও তাই করছে। কিন্তু শারীরিক অস্বস্তি, খারাপ লাগা, অতিরিক্ত ওজন, বিষণ্ণতা সব শুধুমাত্র গর্ভবতী নারীটিই বহন করে যায়, সহ্য করে যায়।
নারী কলিগ আর পুরুষ কলিগ সবাই তখন ভীষণ অপরিচিত। ব্যাপারটা তখন “মুখে মধু বুকে বিষ” জাতীয়।
এই ভয়াবহ পরিবেশে নারীটিকে তার কাজ চালিয়ে যেতে হয়। অতিরিক্ত সুবিধা নেওয়ার এখানে কিছু নেই। বা উচিতও না। মনে তখন হাজারটা প্রশ্নের উঁকি ঝুঁকি চলতেই থাকে যদি চাকরি না থাকে, যদি তার কাজ অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়া হয়, যদি তার পারফরমেন্স খারাপ হয়ে যায়, যদি সে আগের মতো একটিভ থাকতে না পারে? অথচ ক্যারিয়ার করার অধিকার নারী পুরুষ গর্ভবতী অবিবাহিত সবারই থাকে।
এই সময়ে নারীরা নাকি সবচেয়ে দুর্বল! সন্তানের জন্য শারীরিকভাবে থাকে সে খুবই কাতর। কিন্তু আসলেই কি তাই? সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সব নারী কি এই সময় দুর্বল হয়ে পড়ে?
না, সবাই দুর্বল হয় না। যদি না কারও মেডিক্যালি কোনো খারাপ অবস্থা হয়। যাদের আসলেই বেড রেস্ট ছাড়া উপায় নেই তাদের হিসেব ভিন্ন। কিন্তু স্বাভাবিক কর্মক্ষম থাকলে একজন গর্ভবতী নারীকে অবশ্যই কাজ করে যাওয়া উচিত। হোক সেটা ঘরের কাজ বা অফিসের।
সমস্যা হচ্ছে আমাদের মননেই এটা গেঁথে গেছে সে গর্ভবতী নারীদের শুধু রেস্ট দরকার। তারা কোনো কাজ করতে পারে না, বা এই সময় করা উচিত না।
কিন্তু এই সময় যে যত একটিভ থাকবে তার শরীর তত ভাল থাকবে।
এবং এই ধারণাটাই “আপনার তো রেস্ট নিতে হবে” কর্মজীবী গর্ভবতী নারীদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
“আপনার খেয়াল রাখা হচ্ছে” অজুহাতে আপনারই চরম ক্ষতিটা করা হয়।
এই অফিস পলিটিক্সের বেড়াজালে পড়ে অনেকেই হাল ছেড়ে দেয়। হাল ধরে রাখত পারে তারাই যাদের চাকরি ছাড়া কোনো গতি নাই। সে “মা” এই পরিচয়ের আগে তার আলাদা নিজস্ব সত্তা থাকতে হবে এই বোধ যাদের আছে, তারা এই যুদ্ধ অতিক্রম করে যায়। তাই সব গর্ভবতী মেয়েদের জার্নি এক না। কর্মজীবী নারীদের সেই জার্নি আরও ভয়াবহ। যে স্নায়ুযুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয় সেটা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বুঝে ভালো।
নারীদের দমিয়ে রাখতে পারার মধ্যে একধরনের পৈশাচিক আনন্দ কাজ করে। আর গর্ভবতী নারী হলে তো কথাই নেই। তখন সে সহজ টার্গেট। দুর্বল দুর্বল বলে তাকে মানসিকভাবে দুর্বল তো করেই ফেলে, এরপর শুরু হয় ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল।
“বাচ্চাকে একা রেখে আসবেন?”
“নানী আর মা কি এক হলো”?
“অফিসের চেয়ে কি বাচ্চা বড় না?”
“এখন সবচেয়ে দামি জিনিস পেয়ে গেছেন, সন্তান! চাকরি গেলে অসুবিধা কী?”
“বাচ্চা তো আপনাকে পায়ই না, সারাদিন অফিসে কাটান”
“বাচ্চা মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে”
ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই সব কান গরম কথা শুনে শুনে ক্লান্ত হতে হয়। মাঝে মাঝে অপরাধবোধ গ্রাস করে। বিরক্ত লাগে। অসহ্য লাগে।
কিন্তু সব কটু কথাকে ঝেড়ে ফেলে দিতে হয়। ফেলে দেওয়া শিখতে হয়।
কারণ নারীরা সন্তান জন্ম দিলেই বাতিলের খাতায় নাম উঠে না। নারীরা গর্ভ ধারণ করলে অক্ষম হয়ে যায় না।
বরং যে নারী একটা প্রাণকে ধারণ করতে পারে নিজ শরীরে, সেই শরীর খাটিয়ে সে অফিসের কাজও করতে পারে, আগে যেমন করেছে।
যে নারী অকল্পনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে নিজ সন্তানকে জন্ম দিতে পারে, সে নারী নিজের একটা পরিচয়ও বানাতে পারে।
কোনো গর্ভবতী কর্মজীবী নারী যদি আমার এই লেখাটা পড়ে থাকেন তবে তাকে বলবো,
এই সময়ে আপনার মন এমনিতেই নরম মাটির মতো থাকবে। কারো কথাতে সে চরম আঘাত পাবে। আপনাকে সেই আঘাত সহ্য করে যেতে হবে। আপনাকে দুর্বল বানানোর চেষ্টা করবে, কিন্তু আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে যে গর্ভধারণ মানেই দুর্বল হয়ে যাওয়া নয়। বরং এই সময় থাকতে হবে সর্বোচ্চ একটিভ। শরীর মন বাচ্চা ক্যারিয়ার চারটাই থাকবে আনন্দে। আপনি নিজেই দেখবেন যখন আপনি সন্তান পেটে নিয়ে সব স্বাভাবিক কাজ করতে পারছেন তখন নিজের প্রতি ভালো লাগা সৃষ্টি হবে।
শুধু মা না আপনি, আপনি একজন আলাদা মানুষও। যার নিজস্ব একটা পরিচয় আছে। এবং আপনি সেই পরিচয় বানানোর লড়াইয়ে এখন সন্তান পেটে নিয়েই অংশগ্রহণ করছেন। গর্ভবতী বলে আলাদা কোনো সুবিধা দাবি করবেন না। আলাদা সুবিধাগুলোই একসময় আপনার পারফরমেন্স নষ্ট করে দেয়।
একান্তই অপারগ হলে ছুটি নিবেন। যে ছুটি নেওয়ার অধিকার যে কারোরই আছে।
সন্তান জন্মের পর অফিস জয়েন করার পর উপরের ডায়লগগুলোর মত অনেক কথা শুনতে হতে পারে। এসব কথায় ভেঙে পড়া যাবে না। কারণ আপনার সন্তানের ভালোমন্দ দেখার দায় আপনার। আপনি তাকে সবচেয়ে ভালবাসেন, ভালো কেয়ার করেন। বাদ বাকি যারাই সন্তানের চিন্তায় এসব কথা আপনাকে বলবে তারা একবাক্যে আপনার হিতৈষী তো নয়ই, বরং শত্রু স্থানীয়। আপনাকে সন্তানের দোহাই দিয়ে মানসিকভাবে হেয় করা হবে যাতে আপনি রাস্তা থেকে সরে যান। তাদের কম্পিটিশন যেন কমে যায়।
কিন্তু আপনাকে মাথায় রাখতে হবে, জীবনের একটা অংশ হিসেবে আপনি মা হয়েছেন। মা হওয়া, সন্তান লালন করাই আপনার একমাত্র কাজ না। সন্তানের ভরণপোষণও যেন আপনি করতে পারেন, তার সকল চাহিদা ইচ্ছে আহ্লাদ আবদার যেন মিটাতে পারেন সেইজন্যও আপনার একটা আলাদা পরিচয় থাকা উচিত।
মোটকথা, আপনি যদি আপনার ক্যারিয়ার ভালবাসেন, তবে কোনো অবস্থাতেই হাল ছাড়া যাবে না। আশেপাশের অনেক টিপ্পনি যেন আপনার মনোবল ভাঙতে না পারে। একবার মনোবল ভেঙেছে তো ক্যারিয়ার সেখানেই শেষ। এরপর আজীবন হাহুতাশ করেও লাভ নেই।
মেয়েদের জীবনভর শক্ত থাকতে হয়। প্রতিটা স্তরেই কেউ না কেউ ধাক্কা দিবেই। কর্মজীবীদের এই ধাক্কাটা বেশি আসে গর্ভবতী হওয়ার পর। এই সময় নিজেকে যে ধরে রাখতে পারে সে ভবিষ্যতে আরো কঠিন পথও পাড়ি দিতে পারে।