সুপ্রীতি ধর:
ইভানা লায়লা চৌধুরী। মাত্র ৩২ বছর বয়স। তার হওয়ার কথা ছিল ব্যারিস্টার। ওই বিষয়েই সে পড়াশোনা করেছিল। কিন্তু উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠাতে পরিবারের আপত্তির মুখে প্রতিবাদ করার শক্তি তার ছিল না। সঠিক জানি না, হয়তো খুব ‘ভালো’ এবং ‘লক্ষ্মী’ মেয়ে ছিল ইভানা। ফলে এইটুকুন বয়সেই আট ও ছয় বছর বয়সী দুটি সন্তানের মা সে। ছোটটি আবার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। জীবনের পরিক্রমায়, বিশেষ করে বর্তমান সময়ে ৩০-৩২ বছর বয়স কোন বিষয়ই না। আমাদের সন্তানেরা যখন এই বয়সে দৌঁড়াচ্ছে নিজেদের পরিচিতি গড়ে তুলতে, সেখানে তার কাঁধে উঠেছিল দু’দুটি সন্তানের মাতৃত্বের দায়িত্ব। আমরা জানি মাতৃত্ব নিজেই এক কঠিন পরীক্ষা সব মেয়েদের জন্য। কেউ পাশ করে, কেউবা ফেল করতে করতে এগিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সমাজে মাতৃত্বকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতোন সাহস খুব কম মা-ই পারে দেখাতে। এর কারণ, সমাজ তাকে বাধ্য করে এই দায়িত্ব পালন করতে। কখনও সে এই দুর্গম কাজে সঙ্গী পায়, কখনও পায় না। ইভানা পায়নি।
বার বার ভাবছি, যে বয়সে মেয়েটির ক্যারিয়ার গড়ার কথা ছিল, ক্যারিয়ার নিয়ে দিনরাত চিন্তিত থাকার কথা ছিল, বন্ধুদের সাথে আলোচনা করার কথা ছিল, দেশি-বিদেশি টিউটোরিয়ালগুলো অনুসরণ করার কথা ছিল, বৃত্তি নিয়ে বিদেশে পড়তে যাওয়ার কথা ছিল, সেইসব কিছুই না করে সেই বয়সে তাকে চিন্তা করতে হয়েছে সন্তানের ভালোমন্দ নিয়ে। কখন খেলো, কখন ঘুমালো, এইসবই তার দিনরাত্রি হয়ে গেল। বিশেষ করে ছোট সন্তানটির অক্ষমতা, অপরাগতা আর সমাজ, বিশেষ করে ঘরের মানুষজনেরই ভ্রুকুটি সহ্য করে তাকে থাকতে হচ্ছিল। এভাবেই মরে গেল ইভানার স্বপ্নগুলো। ভাবা যায় যে এই একবিংশ শতকে এসেও কোন শিক্ষিত পরিবারে কোন অটিস্টিক শিশুর পুরো দায়ভার তার মাকে একা নিতে হচ্ছে? বাচ্চাটির বাবা তার সন্তানের মায়ের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে সব দায়িত্ব? এও কি সম্ভব?
ইভানার খবরটি শোনার পর ওর ছবি দেখে মনে হচ্ছিল আমি মেয়েটাকে চিনি। আসলেই চিনি। কোথাও আমাদের দেখা হয়েছে, কিন্তু মনে করতে পারছি না। ওর লকড প্রোফাইলে গিয়ে দেখলাম লিখে রেখেছে, I am a mom to two wonderful souls. May the Almighty bless them always. এই যে দুটি wonderful souls এর মা ইভানা কতোটা অসহ্য হলে পর ওদের ছেড়ে যেতে পারলো! কতোটা বিভীষিকাময় হলেই একজন তার জীবন ছেড়ে চলে যেতে পারে! পত্রিকায় পড়লাম যে, বন্ধুদের সঙ্গে কথোপকথনের একটিতে ইভানা লিখেছিল, ‘সম্ভাব্য তালাকের চিন্তায় আমার ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার মা-বাবা সহ্য করতে পারবেন না। তাঁদের দুজনেরই বয়স হয়েছে। নানা রকম শারীরিক জটিলতা আছে।’
যে দুটি সন্তানের জন্য সে কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারছিল না, যে বাচ্চাদের কথা ভেবে সে তার ‘মাতৃত্ব’ নামক দায়িত্ব থেকে সরে আসতে পারছিল না, সমাজের সবধরনের ‘অসুখ’কে মোকাবিলা করতে হচ্ছিল যাকে, সে এখন নিজেকে মুক্তি দিয়ে চলে গেছে। আত্মহত্যা করেছে, বা তাকে লাফিয়ে পড়ার জন্য প্রলুব্ধ করেছে চারপাশ। সত্যিটা হলো, তাকে পাওয়া গেছে দুটি ভবনের মাঝখানে, নিষ্প্রাণ, নিস্তেজ। জীবিত মেয়েকে ডিভোর্সি হিসেবে যে মা-বাবা গ্রহণ করতে নারাজ ছিলেন, সেই মেয়েটিই যখন লাশ হয়ে গেল, ঠিকই পৌঁছে গেল তাদের কাছে। এ কেমন পরিবার? কেমন মা-বাবা ওর যারা সন্তানের বিপদে পাশে থাকে না? আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এখনও এতোটা মানবিক নয় যে আশা করবো ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন ওর পাশে থাকবে, ইভানার শ্বশুরবাড়িও নেয়নি। কিন্তু নিজের পরিবার? মেয়েদের জীবন আমাদের সমাজে এতোটাই ভালনারেবল যে পরিবার নামক খুঁটিটি না থাকলে সেই জীবন তাসের ঘরের মতোন ভেঙে পড়তে বাধ্য হয়। ইভানাও তাই হেরে গেল। ওকে মেরুদণ্ডটা শক্ত করে দাঁড়াতে দেয়নি পরিবারের অসহযোগিতা।
আমি মনে করি এই ঘটনার জন্য কেবলমাত্র ইভানার অসুখী দাম্পত্যকে দায়ী করে লাভ নেই, স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির পাশাপাশি ওর মা-বাবা এবং পরিবারকেও সমাজের সামনে উপস্থাপন করা উচিত। রীতিমতোন তাদের লজ্জা দেয়া উচিত যাতে করে আর কোন ইভানা মরে না যায়! যেন লাখ লাখ ইভানা কঠিন সময়ে নিজের পরিবারকে পাশে পায়!
ডিভোর্স যে কোন ট্যাবু নয়, এটা একটা প্রক্রিয়া মাত্র, জীবনযাপনেরই একটি অংশ, এই সাধারণ সত্যটি সবার সামনে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যই ইভানার বাবা-মাকে প্রশ্ন করা উচিত, তেমনি শ্বশুর-শাশুড়িকেও। কেন তারা ছেলেমেয়েদের অসুখী জীবনে পাশে দাঁড়ালো না সহায়তার হাত বাড়িয়ে? বিয়ে না হলে তো ডিভোর্সের প্রশ্নই আসে না, বিয়ে হওয়া মানেই যে ডিভোর্স হওয়ার চান্স থাকে, এই সত্যটিকে মেনে নিয়ে একে আপ্তবাক্য হিসেবে মানতে হবে প্রতিটি পরিবারকে। ডিভোর্স এড়াতে গিয়ে, একে মহা অভিশাপ ভেবে আঁকড়ে ধরে অসুখী, অসুস্থ জীবন কাটানোতে যে কোন ‘হ্যাডম’ নেই, সেটা যেসব পরিবার বোঝে না তাদের একঘরে করা উচিত আমার মতে। এদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া উচিত যে কতবড় ভুল তারা করেছে! তাদের কাছে ইভানার জীবনের কোন মূল্য ছিল না?
ইভানাও আটকে গেল সমাজের ‘খারাপ-ভালো’ নিষেধাজ্ঞার ভিতরে? আহারে মেয়েটা! সব ছেড়ে বেরিয়ে এলে হয়তো তার পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে সে ‘খারাপ মেয়ে’ হতো, কিন্তু বেঁচে তো থাকতো! এটা কি একধরনের অনার কিলিং নয়? অবশ্যই অনার কিলিং, আর এজন্য ওর মা-বাবারও শাস্তি হওয়া উচিত স্বামী, শ্বশুর এবং শাশুড়ির পাশাপাশি।
মেয়েটির মৃত্যুর পর এখন তার বন্ধুদের বলতে শুনছি (পত্রিকার মারফত জানলাম) যে ও কতোটা অসুখী ছিল, ওর কী কী সমস্যা ছিল! তার মানে ও বলেছিল তার বন্ধুদের নিজের কষ্টের কথা। কিন্তু বন্ধুরা কেউ তাকে বাঁচার পথটি বাতলে দিতে পারলো না। নিজে শিক্ষিত মেয়ে হয়েও আটপৌরে মেয়েদের মতোন আচরণ করে চলে গেল অভিমান করে।
শেষে একটা কথাই বলবো, এই সমাজ, এই রাষ্ট্র, পরিবার কখনও নারীবান্ধব ছিল না। হলে ইভানা নিজেকে এতোটা অসহায় কখনই ভাবতো না। সে বেঁচে থাকতো। দুটি বাচ্চাও তাদের মাকে হারাতো না। ভাবতেও তো গায়ে কাঁটা দেয় যে এই অটিস্টিক শিশুটির এখন কী হবে? মা ছাড়া তার পৃথিবী যে অচল। সে কীভাবে বাঁচবে? অথচ উন্নয়নের কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলা রাষ্ট্র কখনও ব্যক্তি উন্নয়নের কথা ভাবে না, ধর্তব্যেই নেয় না। আজ ইভানার পাশে যদি সবাই থাকতো, তবে কতকিছুই না সে দিতে পারতো!
উন্নত দেশগুলোতে কোন মাকে চিন্তা করতে হয় না তার সন্তানের দেখভাল, পড়াশোনা, ভবিষ্যত নিয়ে, অটিস্টিক হলে তো আরও সুবিধা পায় তারা। বেঁচে থাকার সবরকম অধিকার নিয়ে জন্মায় উন্নত দেশগুলোর মেয়েরা, আর আমরা কেবলই পড়ে থাকি জীবোন্মৃত হয়ে, নয়তো ঝুলে থাকি নয়তলার ফাঁক দিয়ে, অথবা গলা কেটে বা ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেয়া হয় আমাদের।
কী বীভৎস এই নারী জীবন!!!
লেখক: সম্পাদক, উইমেন চ্যাপ্টার