রুমা, ভীষণ ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের!

সুপ্রীতি ধর:

রুমা, দেখো, তোমার শিক্ষার্থীরা আজ কাঁদছে। তারা তাদের মা’কে, বন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছে। তুমি যে কতবড় বন্ধু ছিলে ওদের, সে তো আমি জানি, আর জানে উইমেন চ্যাপ্টারের লাখো পাঠক। তুমি সেসব কথা অজস্রবার লিখে গেছো। তোমার সেইসব প্রিয় শিক্ষার্থীদের কান্না আমায় ছুঁয়ে যাচ্ছে রুমা। কিছুতেই স্থির হতে পারছি না। কেউ কি বলবে আমায় যে এসব যা শুনছি, সব মিথ্যা? কিছু কিছু মৃত্যুকে আমার অস্বীকার করতে ইচ্ছে করে। আজও তাই হচ্ছে। মানতে পারছি না এই পৃথিবী থাকবে, আমি-আমরা থাকবো, অথচ তুমি থাকবে না।

তাইমুর হাসান শুভ নামের ছাত্রটি লিখেছে, ‘আমার বিশ্বাস হ‌চ্ছে না। ম্যা‌ম কীভা‌বে আমা‌দের ছে‌ড়ে যা‌বেন? মৃত্যু চাই‌লেই কি একজন মানুষ‌কে এভা‌বে নি‌য়ে যে‌তে পা‌রে? যে মানু‌ষটা‌কে এতো এতো মানুষ ভা‌লোবাসে, কমপ‌ক্ষে শতা‌ধিক শিক্ষার্থীর মা ছি‌লেন যি‌নি, তি‌নি কীভা‌বে সব‌কিছু উ‌পেক্ষা কর‌বেন? ম্যাডাম, আমা‌দের আরেকটিবার সু‌যোগ দিন। আমরা বিশ্বাস করে‌ছিলাম, আপ‌নি ফি‌রে আস‌বেন। স্বভাবসুলভ হা‌সি দি‌য়ে বল‌বেন, ফি‌রে এলাম। কিন্তু আপ‌নি কথা রাখ‌লেন না ম্যাডাম। আপ‌নি ব‌লে দিন, কীভা‌বে আমরা আপনা‌কে শেষ বিদায় দে‌বো?’

আরও লিখলো, ‘আমাদের একস‌ঙ্গে শ্রীমঙ্গল যাবার কথা। লকডাউ‌নের কার‌ণে যাওয়া হ‌লো হ‌লো না। আপ‌নি কথা দি‌য়ে‌ছেন, যা‌বেন। আপনা‌কে যে‌তেই হ‌বে। লাইফ সা‌পো‌র্টের দোহাই দি‌য়ে আর যা‌বেন না, এরকম কথা শুন‌তে চাইনা। আপ‌নি ফি‌রে আসুন। আমরা পু‌রো পৃ‌থিবীটা ঘুরে বেড়া‌বো।

আমরা আপনা‌কে ভালবা‌সি ম্যাডাম।
স্রষ্টা নিশ্চয়ই এতটা নিষ্ঠুর না ম্যাডাম। আপনার হাজারো ছাত্র আপনার অ‌পেক্ষায়…’।

 

এই শুভকে আমি চিনতাম না, অথচ সেই আমাকে কাল ইনবক্সে জানালো তোমার লাইফসাপোর্টে থাকার কথা। অথচ দেখো, মাত্র পাঁচদিন আগে যখন তুমি তোমার অক্সিজেন মাস্ক পরা ছবি দিয়ে দুষ্টুমি করে লিখলে,’বেড়াইতে আইসি। ভাব্লাম অক্সিজেন খাইয়া যাই। আমার অরোলা হইসে’ – এটা পড়ে ভয়াবহতা বুঝতে পারিনি। তুমি নিজেও কি বুঝেছিলে রুমা যে কোথায় পাড়ি দিতে চলেছো? আমি নিশ্চিত, বুঝতে পারোনি। তুমি তো মরতে চাওয়া মানুষ না। প্রচণ্ড রকমের আশাবাদী, প্রাণবন্ত একজন মানুষ। তোমার চিন্তাভাবনার সাথে আমার মিলে যেতো বলে আমরা কতকিছুই না শেয়ার করেছি গত পাঁচ বছরে।

শুভ আমাকে জানিয়েছিল তোমার সবশেষ আপডেট।
‘ম্যামের অবস্থা গতকালের মতোই আছে। লাইফ সাপোর্টে অক্সিজেন সেচুরেশন ৯০-৯৪%। প্রেসার মোটামুটি ঠিক আছে। তবে ‘একটেমরা’ নামের ইঞ্জেকশনের দ্বিতীয় ডোজটা আজ প্রচন্ড দরকার ছিলো। হাসপাতালের ডাক্তাররাও ইঞ্জেকশনের বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন। কারণ হাসপাতাল থেকেও যোগাড় করার চেষ্টা করা হয়েছিলো, কিন্তু পাওয়া যায়নি। অবশেষে রাত সোয়া ১১টায় এক লাখ ২৫ হাজার টাকায় সেই ঔষধ ম্যানেজ করা গেছে। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে হলি ফ্যামিলিতে আইসিউতে থাকাকালীন অবস্থায় তার ফুসফুস ২৫% ড্যামেজ হয়েছিলো। ইমপালস হাসপাতালে যখন লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়, ধারণা করা হচ্ছিলো ততক্ষণে ম্যামের ফুসফুস প্রায় ৪০ থেকে ৫০% ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে। তবে আশার বাণী, ম্যামের সেন্স কাজ করছে। ইঞ্জেকশনটা দেয়ার পর ইমপ্রুভ হবার কথা। যদি ইমপ্রুভ হয়, সেক্ষেত্রে লাইফ সাপোর্ট খুব দ্রুত খুলে নেয়া হবে।’

আহারে মানুষের মন, বার বার ফিরে আসতে চায় নিজের ইচ্ছার কাছে, স্বপ্নের কাছে। তোমার শিক্ষার্থীরাও আশায় বুক বেঁধেছিল, তোমার ফেরার প্রতীক্ষায় ওরা এতিমখানায় গেছে, মন্দিরে গেছে। মন যখন দুর্বল হয় বিশ্বাসই তখন একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠে। এতো সবার জানা।

শুভ লিখলো আমাকে, ‘ম্যাম আপনাকে পছন্দ করতো, আমি জানি আপনি তার শুভাকাঙ্খি। এজন্যই জানানো।’ তার মানে তুমি তোমার ছাত্রদের কাছে আমার গল্প করেছো? কথাটা শুনে আমার ভালো লাগার কথা রুমা, কিন্তু চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে।
আজ জেনে কী লাভ হলো আর? তবে হ্যাঁ, আজ সকালে চোখ খুলে নিউজফিডে খবরটা পেলে বেশি খারাপ লাগতো আমার। শুভ’র কাছ থেকে শোনাঅব্দি এক ধরনের প্রস্তুতি আমি নিয়ে ফেলেছিলাম মনে মনে। তারপরও আশা ছিল ফিরে আসবে তুমি। এই যে দেশে একজনের পর একজন চোখ বন্ধ করছেন প্রতিদিন, তা নিয়ে কোথাও কোন হৈ চৈ নেই, আলোচনা নেই। সবাই পড়ে আছে পরীমণি ইস্যুতে। এবসার্ড! আমি নিশ্চিত, তুমি ফিরে এলে তোমারও রাগ হতো এ নিয়ে, ক্ষোভ হতো। শক্তিতে কুলোলে একটা লেখাও লিখে ফেলতে।

লেখার কথায় মনে পড়লো তুমি যখন ডেফোডিল ইউনিভার্সিটি থেকে পিআইবিতে জয়েন করলে, আমাকে বললে, সরকারি চাকরির অনেক হ্যাপা আছে দিদি, হয়তো আগের মতোন আর লিখতে পারবো না। আমার মন খারাপ হয়েছিল, কিন্তু আমরা নতুন কিছু করবো বলে পরিকল্পনা করেছিলাম বেশ কয়েকবার।

যখন লিখলে ওই লেখাটা ‘একা থাকতে যোগ্যতা লাগে বাহে’ , বহুল প্রশংসিত হয়েছিল তা। কত মেয়ে যে তোমার দ্বারস্থ হয়েছিল একটুখানি ভরসা পাবার আশায়, সবই আমি জানতাম। যেহেতু লেখাটা উইমেন চ্যাপ্টারের ছিল, তাই তোমার সব প্রাপ্তি তখন তুমি একেই দিয়েছিলে। চেয়েছিলে মেয়েদের মানসিকভাবে সাপোর্টের জন্য একসাথে কিছু কাজ করতে, কিন্তু তারপরে চাকরি পরিবর্তন তোমাকে ব্যস্ত করে তুললো, বা বলা ভালো যে তোমার হাতেপায়ে শেকল পরিয়ে দিল, তাই আর এগোয়নি কাজটা। অথচ স্বপ্নগুলো আমাদের যৌথ ছিল! দেশে যখন একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা চলছে, তুমি লিখলে, ‘হিন্দু শিক্ষার্থীটির চোখের দিকে তাকাতে লজ্জা হয়’। এমন জীবনবোধসম্পন্ন মানুষ তো আর বেশি নেই রুমা। শেষ হয়ে যাচ্ছে। উইমেন চ্যাপ্টারে ছাপা হওয়া তোমার অসংখ্য লেখা আজ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওদের ভাঁজ খুলে খুলে তোমাকে ছুঁতে চাইছি রুমা। (আর লিখতে পারছি না, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে)

দেশে যদি একটা সত্যিকারের হেলথ সিস্টেম ডেভেলপ করতো, তাহলে তোমাকে আমরা হারিয়ে ফেলতাম না এই অকালে। কী বিশাল ক্ষতি যে হয়ে গেল, হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, অথচ আমরা অসহায়ের মতোন হাত গুটিয়ে বসে আছি। যাদের কিছু করার কথা তারা এখন নিজেদের গা বাঁচাতে জনদৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টা করছে।

হায়রে জীবন, কী ক্ষুদ্র, অসহায় এক জীবন আমাদের, যেখানে নিজেকে আর মানুষ হিসেবে ভাবতেও ভাবি, আসলেই মানুষ কীনা!

রুমা, অন্যলোকে আমার বিশ্বাস নেই। তাই তোমাকে হারিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আমার জানা নেই। তুমি হারিয়ে গেলে রুমা, প্রাণের ‘পরে চলে গেলে তুমি। ভীষণ রাগ হচ্ছে আমার, ভীষণ, তোমার ওপর, আমার ওপর, আমাদের জন্মের ওপর। এটা হওয়ার কথা ছিল না, সত্যিই ছিল না। যা হচ্ছে তা অন্যায় হচ্ছে। প্রকৃতি কোনদিন ক্ষমা করে না, তোমাকে হারানোর অপরাধও ক্ষমা করবে না আমি নিশ্চিত।

আদিউস।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.