অনুপম সৈকত শান্ত:
এক
আহমদ ছফা লিখেছিলেন বাঙালি মুসলমানের মন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে বাঙালি পুরুষের মন নিয়ে আরো বড় পরিসরে লেখাজোখা থাকা দরকার ছিল। বাঙালি মুসলমানের অসংখ্য রকমফের আছে, নানান গন্ধ, নানান বর্ণ, নানান ছন্দ আছে! বাঙালি মুসলমানের মেলা পরিবর্তন আছে, আছে মেলা রূপান্তর! তারপরেও আমার মনে হয়েছে, অধিকাংশ বাঙালি মুসলমানই খুব অল্প পরিমাণে মুসলমান! এবং খুব অল্প সময়ের জন্যে, মানে ওয়াক্ত মেপে মেপে মুসলমান। খুব অল্প জায়গায়, মানে বিশেষ বিশেষ জায়গায়, বিশেষ বিশেষ ঘটনায়, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মুসলমান।
কিন্তু বাঙালি পুরুষ – তার জাত, পাত, বর্ণ, গন্ধ, ছন্দ – সব নির্বিশেষে, সময় – জায়গা – ঘটনা – ক্ষেত্র, অতীত – বর্তমান – ভবিষ্যৎ, সব নির্বিশেষে, তারা পুরুষ। বাঙালি পুরুষ মানেই অনেক বড় পুরুষ, গায়ে গতরে লিঙ্গে যতো না পুরুষ, তার চাইতেও মননে, মগজে অনেক বড় পুরুষ, সবকটাই একেকটা আস্ত ব্যাটা ছেলে! ধনী, গরীব, ডান, বাম, উঁচা, নীচা – কোন পার্থক্য নাই, বাঙালি পুরুষ মাত্রই সবার আগে পুরুষ!
দুই
বাঙালি পুরুষ বামুন পুরুষ, বাঙালি পুরুষ বনসাই পুরুষ। জন্মের পর থেকেই এদেরকে বামুন আকৃতিতে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়, ফলে এরা সেভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। ক্রমাগত এদের ডালপালা ছাঁটতে ছাঁটতে এরা বনসাই হয়ে যায়। বাঙালি পুরুষ জানে যে তারা বনসাই, তারা বামুন। তাই তারা আমৃত্যু হীনমন্যতা নিয়ে চলে, এই হীনমন্যতা থেকেই তারা অনেক বেশি আত্মমগ্নতায়ও ভোগে, সময়ে অসময়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ব্যস্ত হয়, ফলে উঠতে বসতে তাদের ব্যাটাগিরি ফলাতে পিছপা হয় না!
হ্যাঁ, হীনমন্য বাঙালি পুরুষ নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে নিজেদের ব্যাটাগিরি দেখায়, ব্যাটাগিরি দেখাতে হয় নারীদের উপরে। বাঙালি পুরুষের রুচি, সংস্কৃতি, ধর্ম, সংস্কার সবকিছুর মাঝেই আছে এই ব্যাটাগিরি, যার শুরু ঐ হীনমন্যতা আর অবদমন। ক্রমাগত অবদমনের সংস্কৃতি বাঙালি পুরুষকে বনসাই করে রেখেছে, বিকৃতিটাই হয়েছে তাদের আকৃতি। ভেতরে বাইরে, মননে মেজাজে তাদের মাঝে চরম বৈপরিত্য, আগাগোড়া কপটতা ও ভণ্ডামিতে ভরা তাদের জীবন! ভোগের প্রতি সুতীব্র বাসনা আর প্রাপ্তিহীনতায় চরম অবদমিত রসনা, তাদেরকে ভেতর থেকে কুড়ে কুড়ে খায়! ফলে তারা নানান উপায়ে নিজেদের সেই উদগ্র বাসনাকে চরিতার্থ করার চেষ্টা করে, কল্পনায় – ফ্যান্টাসিতে – ধান্দায় – ভয়ারিজমে – নানান কায়দা কানুনে ভোগ-লালসাকে তৃপ্ত করার পথ নেয়। কিন্তু এসবের মাধ্যমে রসনাকে আরো বেশি করে অবদমিত করাই সম্ভব, ফলে বাঙালি পুরুষের আজীবন সঙ্গী অবদমন।
অন্যদিকে ক্ষমতাধর পুরুষেরা বিত্ত-বৈভবে, বল প্রয়োগে ও ক্ষমতার সাহায্যে ভোগ প্রাচুর্য অর্জন করে, কিন্তু তাতে বাঙালি পুরুষ সমাজে ভারসাম্য রক্ষা হয় না এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাহীন – দুই তরফই ধর্ষকামী, মর্ষকামী হয়ে থাকে, কেউ বা ফিজিক্যাল দুনিয়ায়, আর কেউ বা ক্ষমতা তথা সুযোগের অভাবে মনন জগতে!
তিন
এই ধর্ষকামী, মর্ষকামী বাঙালি পুরুষ তাদের তাদের যাবতীয় ব্যাটাগিরি চালায় নারীদের উপরে। ফলে সমাজের নারীকে নিয়ে তাদের দারুণ ঐক্য, নিদারুণ সামাজিক সম্মতি। নারী তাদের ভোগের বস্তু, দারুণ কামনীয়, নারী মাত্রই যৌন সামগ্রী। কিন্তু সেই ভোগের জন্যে তারা বিদঘুটে কিছু সামাজিক নিয়ম করে রেখেছে! যৌন চাহিদা পূরণের জন্যে বিয়ে নামক চুক্তির আবশ্যকীয়তা তৈরি করে নিয়েছে, এবং বিয়ে করা বউকে তার স্বামী বাদে আর কোন পুরুষ কোনকালে স্পর্শ করেনি, এরকম এক প্রবল আকাঙ্ক্ষা সমাজ-সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছে। অথচ বাঙালি ধর্ষকামী – মর্ষকামী পুরুষ অন্য নারীতে, বহু নারীতে, এমনকি পরস্ত্রীতে প্রতিনিয়ত আসক্ত হয়! এই আসক্তির কথা জানে বলেই তারা সর্বদাই নারীকে সন্দেহ করে, নারীকেই তাই ঘরের ভেতরে, ওড়না ও ঘোমটার ভেতরে, অধুনা পর্দার ভেতরে ঢেকে ঢুকে রাখতে চায়, সতী সাধ্বী করে রাখতে চায়।
কিন্তু বাঙালি পুরুষের মারাত্মক বৈপরীত্য হচ্ছে এই যে, তারা কেবল নিজ মা, বোন আর বউকেই এরকম সতী সাধ্বী রাখতে চায়, কিন্তু বাকি সব নারীকে তারা ভোগ্য মনে করে এবং মনে মনে কামনা করে। ফলে ওড়না, শাড়ির ফাঁক গলে ক্লিভেজ দেখার জন্যে, নারীর শরীরের ভাঁজ গিলে খাওয়ার জন্যে চোখ সর্বদা ছোঁক ছোঁক করে বেড়ালেও, ওড়না – শাড়ি ঠিক না থাকলে, আঁটোসাঁটো কাপড় পরলে, নারীর চলাচলে কিছুটা অবাধ্যতা দেখলে, সেই নারীকেই বাঙালি পুরুষ অবলীলায় বেশ্যা, নষ্টা, রাতের রানী বলে অভিহিত করে।
যেহেতু বেশিরভাগ পুরুষই শারীরিকভাবে যৌন চাহিদা তৈরি হওয়ার পর থেকেই অবদমনে অভ্যস্ত, এমনকি বিয়ের পরেও তাদের বান্ধা বউয়ের সাথেও বেশিদিন যৌন পরিতৃপ্তি ভোগ করতে পারে না (বউকেও পরিতৃপ্ত করতে পারে না, যৌন পরিতৃপ্তির ব্যাপারটা মিউচুয়াল), ফলে তাদের অবদমন চলতে থাকে এবং এই অবদমিত মনন অন্য নারীকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু মন দিয়ে, কল্পনায়, কিংবা চোখ দিয়ে যাদের খুঁজে পায় – তাদের যেহেতু কল্পনা বাদে বাস্তবে নিজের বিছানাসঙ্গী বানানোর কোন উপায় করতে পারে না, সেহেতু সেই নারীদের প্রতি যাবতীয় রাগ এসে পড়ে। প্রচণ্ড রাগ, আক্রোশ এবং তারও চাইতে বেশি হিংসা বাঙালি পুরুষের মননে। কামনীয় সেই নারীর প্রতি ক্ষোভ আর তার কাল্পনিক বিছানাসঙ্গীদের প্রতি হিংসা! এরই ফল হচ্ছে, সেই নারীকে সবাই মিলে বেশ্যা, খানকি, মাগী, নষ্টা, মক্ষীরানী, আর একটু শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিশীল বাঙালি পুরুষ হলে রাতের রানী বলে অভিহিত করা!
চার
বাঙালি পুরুষদের যোগ্য আওয়ামী লীগ সরকারের র্যাবের বিশাল বাহিনী চিত্রনায়িকা পরীমনিকে বাসা থেকে বিপুল মদের বোতলসহ আটক করেছে। তা নিয়ে আমাদের বাঙালি পুরুষ মিডিয়াওয়ালারা, আমাদের বাঙালি পুরুষ সামাজিক মাধ্যমের যে পরিমাণ উত্তেজনা ছিল, তা এর আগের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী গ্যাং এর লিডার বা কুখ্যাত চোরাকারবারি – মাদকসম্রাট বা কথিত ভয়ংকর চরমপন্থী সর্বহারা কিংবা জেএমবি – আনসার বাংলার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পুলিশ – র্যাব – মিলিটারির চালানো অভিযানগুলোর সময়কার উত্তেজনার চাইতেও বেশি ছিল! র্যাব যখন ওয়ারেন্ট ছাড়াই পরীমনির বাসায় ঢুকতে চায়, পরীমনি ফেসবুক লাইভে এসে সাহায্য চায়! সেখানে লাখ লাখ বাঙালি পুরুষ কমেন্ট করেছে। ইউটিউবে, ফেসবুকে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার করা ভিডিও’র নিচে, প্রিন্ট মিডিয়ার অনলাইন ভার্সনে পরীমনিকে আটকের খবরের নিচে এসব কমেন্ট পাওয়া যাবে! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভর্তি হয়ে আছে লাখ লাখ বাঙালি পুরুষের পোস্ট, স্ট্যাটাস আর কমেন্টে! সেসব দেখলেও বাঙালি পুরুষ সমাজের মোটাদাগে ঐক্য মিলবে! পরীমনির সেই লাইভ ভিডিওর কমেন্টেই কেউ কেউ রাখঢাক বাদ দিয়েই তাদের অবদমিত আকাঙ্খার প্রকাশ ঘটিয়েছে, পরীমনিকে “খাইতে” চেয়ে, পরীমনির ক্লিভেজ আরো ভালোভাবে দেখার লক্ষ্যে “মোবাইল ক্যামেরা আরেকটু উপরে ধরতে” বলে! অনেকে আবার রাখ ঢেকে বলেছে, “সবাই আছে বলে কিছু বলতে পারছি না, কিন্তু মনে মনে যা বলার বলেছি”। এই যে মনে মনে বলা, ভয়ারিস্টিক চোখে নায়িকাকে দেখে, নায়িকার শরীর দেখে মনে মনে আরো ভালো ভাবে, মানে আরো নগ্নভাবে দেখতে চাওয়া, ভোগ করতে চাওয়া – তারই ফল হচ্ছে, বাকি বেশিরভাগের কড়া সমালোচনাগুলো! যেই সমালোচনার সবচেয়ে বড় অংশই হচ্ছে পরীমনির পোশাক নিয়ে সমালোচনা!
পরীমনি যেহেতু ফেসবুক লাইভে এসে ক্লিভেজ দেখিয়েছে (এবং তাতে অবদমিত বাসনা আরও তীব্র হয়েছে), সেহেতু পরীমনির বাসায় র্যাবের তাণ্ডব চালানো ঠিক আছে, তাকে আটক করা, হয়রানি করা- সবই ঠিক আছে। “র্যাবকে ধন্যবাদ”, “সরকারকে অনেক ধন্যবাদ” – এরকম লাখ লাখ কমেন্ট দিয়ে বাঙালি পুরুষ তাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। সেসব কমেন্টে সরকার দলীয়, কিংবা সরকার বিরোধী, সব ভেদাভেদ ‘নাই’ হয়ে গিয়েছে। র্যাবের মতো বাহিনীর জঘন্য অত্যাচারের কথা ভুলে অসংখ্য বাঙালি পুরুষ র্যাবকে সেই নির্যাতনের কথাই মনে করে দিয়েছে, “এরে রিমান্ডে নিয়ে ঠাপানো দরকার” বলে। বাঙালি পুরুষের মনে এই ঠাপানোর কথাই আসবে, কেননা নিজের “ঠাপানোর” কথা চিন্তা করতে না পারলেও, র্যাব কর্তৃক ঠাপানোর কল্পনায় পর্নোগ্রাফিক আনন্দ লাভ হয়! মিডিয়ায় ফলাও করে বিপুল মদ উদ্ধারের খবর আসে। পুরুষ র্যাব কর্মকর্তার বরাতে জানা যায়, বিত্তশালী পুরুষদের ব্লাকমেইলিং এর অভিযোগের কথা। বাঙালি পুরুষ কল্পনায় বিত্তশালী পুরুষদের সাথে পরীমনির মদের আসর দেখে! মিডিয়ায় পুরুষ বিশ্লেষকরা পরীমনির লাইফ-স্টাইল, বাড়ি গাড়ি, সম্পদ নিয়ে গবেষণা করে, প্রশ্ন তোলে “করোনার এই অতিমারিতে যেখানে চলচ্চিত্র শিল্পের মন্দা চলে, সেখানে পরীমনির এমন সম্পদের উৎস কী”! সব আলাপ-আলোচনা, বিশ্লেষণ-গবেষণা, জল্পনা-কল্পনার মধ্য দিয়ে বাঙালি পুরুষ বের করে আনে, পরীমনি একজন ‘রাতের রানী’ ছিল!
পাঁচ
বাঙালি পুরুষের এ এক দারুণ ঐক্য! রাজনীতি, দল-মত-পথ, ধর্ম নির্বিশেষে সবার একই মত, পরীমনি হচ্ছে বাজারি মেয়ে, নষ্ট মেয়ে, বাজে মেয়ে। করোনা পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ, হাশেম ফুডসে অগ্নিকাণ্ডে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের পোড়া শরীর, মাত্র ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের সাথে পোড়া হাড্ডি আর ছাই নামক মৃতদেহ হস্তান্তর থেকে শুরু করে এই রাষ্ট্র ও স্বৈরাচারি সরকারের যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম – সব ভুলে বাঙালি পুরুষ সমস্বরে সরকারকে ধন্যবাদ জানায়, এক ক্লিভেজ দেখানো – মদ খাওয়া – রাতে বিরাতে ক্লাবে যাওয়া বাজারি নায়িকাকে আটক করার মহান দায়িত্ব পালনে!
আওয়ামী ঘরানার পুরুষ মিডিয়া, পুরুষ ব্লগার – ফেসবুকার – টকশো বুদ্ধিজীবীরা সরকার যে কত শক্তহাতে মাদকচক্র – ব্লাকমেইলিং চক্রকে ধরছে, এরকম জনপ্রিয় নায়িকাকেও ছাড় দিচ্ছে না, সে কথা গর্বভরে জানান দিচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপি-জামাতি ঘরানার পুরুষ ব্লগার – ফেসবুকার – বুদ্ধিজীবীরা সরকারকে সরাসরি ধন্যবাদ না দিলেও পরীমনির আটকে তাদের আনন্দ-উল্লাস লুকিয়ে রাখতে পারছে না! তাদের কাউকে কাউকে দেখলাম, পরীমনির পক্ষে দাঁড়ানো বা ওয়ারেন্ট ছাড়া এভাবে র্যাবের অভিযানের বিরুদ্ধাচারণকারীদের নারীবাদী আখ্যা দিয়ে, এই নারীবাদীরা যে পরীমনির ক্লিভেজ দেখতে দেখতে বা মোবাইলে ক্লিভেজের ছবি তুলতে তুলতে অভিযান বিরোধী পোস্ট দিয়েছে, তা নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন বের করেছে। এর বিপরীতে জাতীয়তাবাদী পুরুষ বুদ্ধিজীবীদের একটা ছোট অংশকে দেখেছি এই প্রশ্ন করতে, মওদুদ – খালেদা জিয়াকে যখন মদ, পর্নো ম্যাগাজিনসহ আটক করা দেখে চেতনাবাজরা দাঁত কেলিয়ে হাসছিলো, তখন কি তাদের প্রাইভেট জীবনের উপরে হস্তক্ষেপ হয়নি? এই প্রশ্নটা খুবই ভ্যালিড একটি প্রশ্ন। কিন্তু এদের অন্যান্য আলাপ আলোচনা থেকে বোঝা যায়, এদের আসল বক্তব্য এমন না যে, এখন পরীমনির সাথে যা যা করা হচ্ছে এবং খালেদা জিয়ার সাথে যা যা করা হয়েছে- দুটোই অপরাধ। বরং তারা মূলত দেখাতে চাচ্ছে, খালেদা জিয়ার সাথে যা যা হয়েছে, সেটা অপরাধ, কিন্তু পরীমনির সাথে যা যা হচ্ছে, তা খুব ঠিকই আছে।
আওয়ামী – বিএনপি – জামাতি সবার অবস্থান এক, আমাদের প্রগতিশীল খ্যাত বামপন্থী, যারা বিভিন্ন সময়ে নারীর অধিকার নিয়ে, নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিয়ে কথা বলে, বিভিন্ন নারীবাদী আন্দোলনেও সম্মুখ সমরে যাদের পাওয়া যায়, সেই বাঙালি বামপন্থী পুরুষদের অবস্থান কী? দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অনেক বামপন্থী, প্রগতিশীল, “নারীবাদী” পুরুষের অবস্থানটাও আশ্চর্যজনকভাবে একই রকমই। যদিও তারা অনেকের মতো সরকারকে ধন্যবাদ জানায়নি, বরং সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থানও নিচ্ছে, যদিও পরীমনি কেন ক্লিভেজ দেখালো, পরীমনি কেন বাসায় এতো মদ রাখলো – এসব প্রশ্নও তাদের নেই, বরং ক্ষেত্রবিশেষে র্যাবের এরকম অভিযানের বিরুদ্ধেও তাদের বক্তব্য রয়েছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা পুরুষ পরিচয় আড়াল করতে পারেনি। কেননা তাদের কাছেও পরীমনি একজন বেশ্যা বই কিছু নয়, তাদের ভাষায় রাতের রাণী! রাতের রাণীর প্রতি তারা কোন ঘৃণা প্রকাশ করেনি, বরং প্রগতিশীল এক উপায়ে তারা রাতের রাজার খোঁজ করেছে! “রাতের রাণী দেখছে সবাই, রাজারা গেল কই?” কারা রাতের রাণী বানায়, কোন সে জ্বিনের আছড়ে এইসব পরীরা পরী হয়ে ওঠে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানিয়েছে!
বিভিন্নপন্থী পুরুষ মিডিয়াওয়ালার মতো প্রগতিশীল ও বামপন্থী বাঙালি পুরুষরাও পরীমনির “বড় বড় বাড়ি”, “রাজকীয় কারবার”, “খানা পিনা নেশা”, “বাহারি সাজসজ্জা” প্রভৃতির উৎস নিয়ে রীতিমত গবেষণা করে প্রশ্ন তুলেছে: “এদের (পরীমনি, পিয়াসা, মৌ) এপথে এনেছিল” কারা? “কারা কিনে দিল দামি বাড়ি গাড়ি, খরচ জোগালো কারা”? কাউকে কাউকে প্রশ্ন তুলতে দেখলাম, এতো মদ কি একা পরীমনির জন্যেই, নাকি ছিলো কোন অজানা সঙ্গী? কে বা কারা তার মদের সঙ্গী? কোথায় তারা? একজন বিশিষ্ট নারীবাদী বিশাল এক পোস্ট লিখেছে বেশ্যাদের নিয়ে – বেশ্যারা অপরাধী নয়, আসল অপরাধী হচ্ছে যারা তাদেরকে বেশ্যা বানাচ্ছে!
এসবের মধ্য দিয়ে কথিত প্রগতিশীল, কথিত নারীবাদী, কথিত বামপন্থী বাঙালি পুরুষ আসলে অপরাপর বাঙালি পুরুষদের কাতারেই নিজেদের তুলে ধরছে। অন্যদের মতো তাদেরও ধারণা, কিংবা কল্পনা- এই যে নায়িকা নারী, যে বাজারি, যে মদ খায় ও এমন লাইফ স্টাইলে অভ্যস্ত, যে বাড়ি গাড়ির মালিক, যে তার পোশাক আশাক, সাজসজ্জা ও মদের খরচ বহন করতে পারে, কোনমতেই এই নায়িকা অন্য পুরুষের বিছানাসঙ্গী হওয়া বাদে এসব কিছুই পারতো না! কথিত এই বিত্ত-বিলাসের উৎস সংক্রান্ত প্রশ্নের প্রধান বিষয়ই হচ্ছে, কল্পনায় সেই নারীকে অপরের বিছানাসঙ্গী বানানো! আর সেটিই প্রকাশ পায় – নিশ্চিন্তে, নিঃসন্দেহে তাকে বেশ্যা বা রাতের রাণী হিসেবে ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে! তারপরে রাতের রাজাকে খোঁজা বা তার মদের পার্টনারকে তলব করার মধ্যে কিছু অভিনবত্ব থাকতে পারে, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এটা বাঙালি ধর্ষকামী-মর্ষকামী পুরুষের অবদমিত মনের ফ্যান্টাসি বাদে কিছু না, তার সাথে উপরি হিসেবে কাল্পনিক রাতের রাজা বা মদের পার্টনারদের প্রতি প্রাপ্তিহীন হতাশামিশ্রিত হিংসারও বহিঃপ্রকাশ হতে পারে।