মেহজাবিন সিদ্দিকী:
সারা বিশ্বে করোনা মহামারী ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে দেড় বছরেরও বেশি হলো। বিশ্ব অর্থনীতির পালে লেগেছে মন্দ হাওয়া। মানুষ, পরিবার, সমাজ সর্বোপরি রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত বাঁচার লড়াই করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে সামগ্রিক পরিস্থিতি সঙ্গত কারণেই ভয়াবহতম। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো যখন মনেপ্রাণে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত অবার আশায় বিভোর, তখনই শুরু হলো এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়। অস্তমিত সূর্যের মতো সমস্ত কিছু অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে অস্তিত্বের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলো তাদের।
আমরা জানি বাঙালী জাতির ইতিহাস আর ঐতিহ্য হাজার বছরের। আর এ বছর বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের বয়স হিসেবে পঞ্চাশ নবীন হলেও নেহাৎ কম নয়। বাংলাদেশ এখন পঞ্চাশ বছরের এক প্রৌঢ়। এই দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে আমাদের সামগ্রিক পাওয়া না পাওয়া, অর্জন- বিসর্জন, আশা -নিরাশা, উন্নতি -অবনতির হিসেবে করতে আজ আমি বসিনি। আমি আজ ছোট্ট করে বলবো, রাষ্ট্র হিসেবে আমরা এই মহামারীকে কিভাবে মোকাবিলা করছি, এই মোকাবিলায় রাষ্ট্রের সফলতা -ব্যর্থতা কতটুকু, সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার দায়িত্ব কী কী বা রাষ্ট্রের নিকট হতে আমার কী কী সাহায্য পাওয়া উচিত!

তো আলোচনার প্রথমেই এই করোনা মহামারি মোকাবিলায় রাষ্ট্রের ভূমিকা এখন পর্যন্ত কতটুকু তা নিয়ে কথা বলি।
করোনার ভয়াবহতা এতোটাই প্রচণ্ড, ব্যাপক এবং ভয়াবহ যে, কোন একজন ব্যক্তি, পরিবার বা সমাজের একার পক্ষে তাকে মোকাবিলা করা সম্ভব না। তাই স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের উপর বর্তায় এক কঠিন চ্যালেঞ্জ, রাষ্ট্রের প্রধান এবং মহা মূল্যবান উপকরণ জনগণের জীবন রক্ষা করা। সর্বোপরি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা।
দেড় বছর সময় চলে গেছে করোনায়, এই দেড় বছরে রাষ্ট্র কতটুকু গুছিয়েছে তার জনগণকে সাহায্য করতে! দেড় বছর কিন্তু কম সময় নয়। একটি শিশু ভূমিষ্ট হলে দেড় বছরে সে হাঁটতে এবং কথা বলতে শিখে যায়। অথচ গভীর পরিতাপের বিষয় হলো এই দীর্ঘ সময়েও রাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট কোন লেজিসলেশন তৈরি করতে পারিনি। যে লেজিসলেশনে রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং জনগণের দায়িত্বের সুনির্দিষ্ট বণ্টন উল্লেখ থাকবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় এখন পর্যন্ত কোভিড সংকট মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে করণীয় পদক্ষেপ সমূহ, পদক্ষেপ অনুসরণে জনগণের করণীয় এবং যথাযথ পদক্ষেপ অনুসরণে ব্যর্থ হলে সম্ভাব্য মহা দুর্যোগের আশংকা; এই বিষয়ে কোন বিশ্বস্ত প্রচার মাধ্যম গড়ে তুলতে পারেনি।
করোনা মহামারি শুরু হবার পর থেকেই প্রশাসন দফায় দফায় লকডাউন দিয়েছে, যা ছিল পুরোপুরি ভাবে ব্যর্থ এবং জনগণের উপর নির্যাতনের নামান্তর। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে যারা বসে আছেন, আমি বিশ্বাস করতে চাই তাদের মাথায় কিছুটা হলেও ঘিলু আছে। আর তাই যদি হয়, তবে তাদের উচিত ছিল লকডাউনের মতো কঠোর সিদ্ধান্তে যাবার আগে একটি বার চিন্তা করা রাষ্ট্র এবং তার জনগণ লকডাউনে যাবার জন্য প্রস্তুত কিনা। যে দেশে অর্ধেকের বেশি মানুষ দিন এনে দিন খায়, সে দেশে সপ্তাহের পর সপ্তাহ লক ডাউন কীভাবে কার্যকরি হবে! আমি জানি আমরা এমন এক দেশে বসবাস করি যেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য চরমে অবস্থান করছে। আর পরিতাপের বিষয় হলো এই বৈষম্য কিছু মানুষ উপভোগ করছে। তাই তারা অন্ধের ভূমিকা পালন করছে এই বৈষম্য ঘোচানোর ব্যাপারে, এই আলোচনা পুরোপুরি আলাদা। সে যাই হোক আসল কথায় ফিরি, লক ডাউনের ফলে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষকে যে চরম দুর্দশা আর কষ্টের মাঝে ফেলে দেয়া হয়েছে, তা বর্ণনাতীত।
দুঃখের বিষয় হলো এই এতো সময় পরে এসেও রাষ্ট্র তার সুবিধাবঞ্চিত-দরিদ্র জনগণের জন্য কোন নিয়মিত সাহায্য বা ভাতার ব্যবস্থা করতে পারেনি। রাষ্ট্র এমন কোন ডিজিটাল প্লাটফর্ম বা বার্তা বিভাগ গড়ে তুলতে পারেনি যেখান থেকে সঠিক তথ্য জনগণ জানতে পারবে। আর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে সেই তথ্য কীভাবে ম্যাস পিপলের নিকট পৌঁছানো যায় তার ব্যবস্থাও করতে পারেনি।
উন্নত বিশ্বে প্রতিটি উপার্জনক্ষম মানুষ এবং করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের নিদিষ্ট ক্রাইটেরি মেনে সাপ্তাহিক ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে, প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায় একযোগে প্রতিটি মিডিয়াতে ( রেডিও, টেডিভিশন) খবর প্রচার করা হয়। স্বাস্থ্য বিষয়ক মন্ত্রী দিনে অন্তত একবার মিডিয়ার সাথে সরাসরি সংবাদ সম্মেলন করে সর্বশেষ আপডেট জনগণের সামনে তুলে ধরে। আমাদের কোন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে দেশের সামগ্রিক করোনা বিষয়ে কোন প্রশ্ন করলে কতটুকু সদুত্তর পাওয়া যাবে, তার প্রমাণ অলরেডি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আরো হলো, টিকা প্রদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকার দক্ষ লোকবল বা সিস্টেম কোনটাই তৈরি করতে পারেনি। গতকালই একটি ভিডিওতে দেখলাম, এক ভদ্রলোক টিকা কেন্দ্রে গেলে তাকে পরপর তিনবার টিকা প্রদান করেছে সেখানকার টিকা প্রদানকারী লোকজন (যদিও এই তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে)। এটা যদি কোনভাবে সত্যি হয়ও, তবে এখানে দায় অবশ্যই দুই পক্ষেরই। যে ভ্যাকসিন নিয়েছে আর যারা দিয়েছে, উভয়ের। কতোটা অসচেতনতা থাকলে এরকমটা হতে পারে, ভাবা যায়?
এবার যদি কথা বলি জনগণের কী কী দায়িত্ব সরকারকে এই মহামারি মোকাবিলা করতে, জনগণ কীভাবে সরকারকে সাহায্য করবে, এর সোজাসাপটা উত্তর হলো, রাষ্ট্র কর্তৃক নির্দেশিত নিয়মাবলি অনুসরণ করা। আর এই কাজটি যথাযথভাবে করতে প্রথমেই যা দরকার তা হলো, দেশের মানুষের ধারণ বা বোঝার ক্ষমতাকে সামনে রেখে লেজিসলেশন তৈরি করা। বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘লকডাউনের’ আভিধানিক অর্থই এখনও পরিষ্কার হয়নি। আর হবেই বা কীভাবে? লকডাউনের নামে দুদিন পর পর যা হচ্ছে দেশে, তাতে এটা রীতিমতো তামাশায় পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাষ্ট্র দ্বারা তৈরি কোন লেজিসলেশন জনগণের নিকট কতোটা অর্থ বহন করছে, তা নিশ্চিত হওয়া দরকার। মানে জনগণ কতোটা বুঝলো আর কতোটা বুঝলো না! যদি না বুঝে থাকে তবে যথাসম্ভব সহজবোধ্যভাবে তা প্রকাশ করা।
এই এতোগুলো কথার বলার কারণ হলো, এতোদূর এসেও আমরা সুদূরপ্রসারি কোন ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হইনি, তা স্পষ্ট। আরও ভয়ংকর বিষয় হলো অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে যখন আবার এরকম একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবো, তখনও এই রকম দুর্দশার মধ্য দিয়েই যেতে হবে।
আফসোসের বিষয় হলো এই মহামারী থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের মহামারী মোকাবিলা করার জন্য কোন পদ্ধতিই আমরা এখন পর্যন্ত এস্টাবলিশ করতে পারিনি।