আর কত প্রাণ ঝরে গেলে বন্ধ হবে ফ্রি ফায়ার পাবজির মতো গেম?

সালমা লুনা:

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া এক তরুণ মা-বাবার সাথে রাগ করে বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে গেছে। টাকাপয়সা ফোন কিচ্ছু নেয়নি। এখনও সে ফিরে আসেনি। বাবা-মা ফেসবুকে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে আকুতি জানিয়েছেন, বাবা ফিরে আয়।
অতিরিক্ত অনলাইনে গেম খেলার জন্য বাবা-মা বকাঝকা করায় গৃহত্যাগ করেছে ছেলে।

কদিন আগে যাত্রাবাড়িতে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। এখানেও কারণ অনলাইন গেইম। মাসকয় আগে বগুড়ায় এক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে, মৃত্যুর আগে চিরকুটে লিখে গেছে, বাবা-মা ফ্রি ফায়ার গেম খেলতে দেয়নি বলে সে আত্মহত্যা করছে।
অনলাইনে অতিরিক্ত গেম খেলে ছেলে, পড়ালেখায় মন নেই দেখে মা-বাবা বকাঝকা করেছে, তাই ১৪ বছর বয়সী ছেলের আত্মহত্যা বগুড়ায়। এক দরিদ্র কৃষকের ১৩ বছর বয়সী ছেলেটিও আত্মহত্যা করেছে স্মার্টফোন না কিনে দেয়ায়। স্মার্টফোনে সে গেইম খেলবে।
চাঁদপুরে এক কিশোর আত্মহত্যা করেছে ফোনে এমবি কেনার টাকা না দেয়ায়। এমবি কিনলে গেইম খেলতে পারবে।
এক সেনা সার্জেন্টের ষষ্ঠ শ্রেণী পড়ুয়া কন্যা বিশ্বসেরা গেমার হতে চেয়েছিল। কিন্তু বাবা-মা খেলতে দেয় না। ফোন কেড়ে নিয়েছে। ফলাফল আত্মহত্যা।
সাতক্ষীরার আরো এক অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া কিশোর আত্মহত্যা করেছে।
তারও মা মোবাইল লুকিয়ে রেখেছিল। গেমে আসক্ত ছেলেকে ফেরাতে মায়ের শেষ চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে এভাবেই।

এইরকম আত্মহত্যার অসংখ্য ঘটনা পাওয়া যাবে যে সংখ্যাটা আতঙ্ক জাগায়।
আর এর পেছনের অন্যতম কারণ ফ্রি ফায়ার, পাবজি ইত্যাদি গেইমে আসক্তি। বাবা-মায়ের বকাঝকা বা মারধর, ফোন কেড়ে নেয়া, স্মার্টফোন কিনে না দেয়া, এমবি কেনার টাকা না দেয়া, গেইমের সরঞ্জাম বা খরচ যোগানো, গেইমের খরচ যোগাতে চুরি করে ধরা পড়া এইসব কারণে বাচ্চাগুলো আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
শুধু যে স্কুল পড়ুয়া ১২ থেকে ১৫ বয়সী বাচ্চারাই এই গেমে আসক্ত এমন নয়। যেকোনো বয়সী মানুষই গেমে আসক্ত হতে পারে।

★ কীভাবে আসে এই আসক্তি?

প্রথমে সময় কাটানোর জন্য খেলাচ্ছলে শুরু হলেও অচিরেই শুরু হয় রাত জেগে খেলা, নতুন নতুন খেলায় যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি অনলাইনে দেশবিদেশের অপরিচিত খেলার সাথী বা বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে ফেলা। এবং তাদের সাথে সবসময় খেলা বিষয়ে কথা বলা। দীর্ঘসময় ডিভাইস নিয়ে সময় কাটাতে থাকলে বুঝতে হবে সে গেমে অনেক আসক্ত হয়ে যাচ্ছে।

★ কীভাবে বোঝা যায় এটি গেমে গুরুতর আসক্তি কীনা?

সহজেই বোঝা যায়। কেউ যদি দিনের বেশিরভাগ সময়ই গেম খেলে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে হবে সে আসক্ত ।

এরপর খেলতে নিষেধ করলে বা খেলায় বিঘ্ন ঘটলে যদি কেউ ভীষণ প্রতিক্রিয়া দেখায়, যেমন রাগারাগি, চিৎকার, চেঁচামেচি করে, ভাঙচুর করে, তাহলে বুঝতে হবে আসক্তি গুরুতর। খেলার জন্য নিজের কাজ ফেলে রাখা বা সময়মত করতে না পারা, অমনোযোগিতা, অনিদ্রা, অরুচি, মুড সুইং, পরিবারের সাথে সময় না দেয়া এসবই গুরুতর আসক্তি বোঝায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৮ সালে গেমের ক্ষতিকর এই ব্যবহারকে ডিজঅর্ডার বা মানসিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এবং বলা হয়েছে, এইসব লক্ষণ ১২ মাস লাগাতার কারও মধ্যে দেখা গেলে অভিভাবককে অবশ্যই নড়েচড়ে বসতে হবে যে তার আদরের সন্তান বা পরিবারের সদস্যটি গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে। কারো ক্ষেত্রে এই উপসর্গ আরো কম সময়ের মধ্যেও খুবই বেশিমাত্রায় দেখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে গুরুতর আসক্ত বলা যায়।

এই আসক্তি নিষিদ্ধ কিছু না হলেও যে কোনকিছুর নেশাই যে খারাপ এবং প্রাণঘাতি হতে পারে, তার প্রমাণ দেখাই যাচ্ছে।
এই গেমের নেশা ইতিমধ্যেই কেড়ে নিয়েছে বহু প্রাণ।

★কেন এমন হয়?

অনেক সময় শিশুকাল থেকেই নিজেদের অজ্ঞতাবশত বাবা-মায়েরাই সন্তানের অকারণ কান্নাকাটি, খাওয়ায় অনিহা, তাদের দেখভালের ঝামেলামুক্ত হতে তাদের হাতে তুলে দেন মোবাইল বা কম্পিউটারের মতো ডিভাইস। এতে সন্তান হয়তো শান্ত হয়, খায়। কিন্তু ধীরে ধীরে সে এতেই অভ্যস্ত হয় যা বড় হলেও রয়ে যায়। ফলে বড় হয়ে কার্টুন তো আর দেখে না, বৈচিত্র্য আনতে গেম খেলে।
তাই ছোট শিশুরা যাতে ইন্টারনেট, গেমে আসক্ত হতে না পারে তাদেরকে প্রয়োজন ছাড়া যথাসম্ভব ডিভাইস থেকে দূরে রাখার জন্য মনোযোগ অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা করতে হবে। খেলাধূলা, বই পড়া, স্বাস্থ্যকর পারিবারিক পরিবেশই পারে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে।
আর বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার চাপ নেই, পরীক্ষার চাপ নেই অঢেল সময় পাওয়ায় এইসব খেলায় ঝুঁকে পড়ছে বহু ছেলেমেয়ে। বিশেষ করে অনলাইন ভিত্তিক লেখাপড়া চালু হওয়ায় স্মার্ট ফোন এখন বাচ্চাদের হাতেও। ফলে খেলার সুযোগ বেড়ে গেছে অনেকটাই।

★ কী করতে হবে?

সালমা লুনা

মারামারি বকাঝকা দিয়ে কোন সমস্যারই সমাধান হয় না। গেম আসক্তদের সাথে আলোচনা করতে হবে, সময় কাটাতে হবে আসক্ত সন্তান অথবা পরিবারের সেই সদস্যের সাথে।
বাচ্চারা অনলাইনে কতটা সময় কাটাচ্ছে, সেটি অবশ্যই মনিটর করতে হবে।
পড়ালেখার জন্য স্মার্ট ফোন ল্যাপটপ দিলেও সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই বাবা-মায়ের হাতে রাখতে হবে।
দরজা বন্ধ করে ক্লাস, পরীক্ষা এসাইনমেন্ট করলে সেটিকেও নজরদারিতে রাখা উচিত।
আজকাল মোটামুটি সবার ঘরেই হাই স্পিড ওয়াইফাই কানেকশন আছে। পাওয়া যায় স্বল্প মুল্যে মোবাইল ডাটাও, ফলে নেট ডালভাত। বাসায় দীর্ঘসময় অনুপস্থিতিতে বা রাতে শিশু-কিশোর বয়সী সন্তানের ঘরে কোন ডিভাইস মানে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব ইত্যাদি রাখতে দেয়ার অর্থ নিজ হাতে সন্তানকে বিশাল খাদে ঠেলে দেয়া।
এতোকিছুর পরেও খুব বেশি আসক্ত হয়ে গেলে তাদেরকে নিজের তত্ত্বাবধানে খেলার মধ্যে রেখে ধীরে ধীরে সময় কমিয়ে এনে খেলা থেকে মনোযোগ কমিয়ে আনতে হবে। এরপরও নিজেরা না পারলে প্রয়োজনে প্রফেশনাল কারও সাহায্য নেয়া যেতে পারে।

আর যা করতে পারি সবাই মিলে সেটি হলো, সরকারের কাছে আবেদন জানানো যেন এই গেমগুলো দেশে নিষিদ্ধ করা হয়।

বিশ্বের অনেক দেশ জনপ্রিয় এই ইন্টারনেট গেইম ফ্রি ফায়ার নিষিদ্ধ করেছে। চায়নার তৈরি করা যুদ্ধ গেম ফ্রি ফায়ার তরুণ প্রজন্মের কাছে খুবই জনপ্রিয়। বিশেষ করে এই প্যানডেমিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা এসব গেমে আসক্ত হচ্ছে।
আমরা অনেক অভিভাবকই জানি না এই গেমগুলি কী ধরনের! বেশিরভাগই মূলতঃ যুদ্ধবিগ্রহ ভায়োলেন্স মারামারি রক্তপাত হিংস্রতা এসব। দীর্ঘসময় ধরে এসবের সংস্পর্শে থাকায় কিশোর বয়সীদের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা প্রভাবিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।

গেম আসক্তিতে দেশে বেশ কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটায় শোনা গিয়েছিল বাংলাদেশ সরকারও নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে এই পাবজি ফ্রি ফায়ার গেমগুলো।
নেপাল, ভারতের কয়েকটি রাজ্য সফলভাবে পেরেছে।
আমাদের দেশে সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক এইগুলো ধীরে ধীরে করতে হবে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কত ধীরে? আর কত দেরি করে, আর কত শিশু কিশোরের প্রাণ গেলে, অভিভাবকদের যন্ত্রণা ভোগ করিয়ে তারপর বন্ধ হবে এই ভয়াবহ খেলার দরজা?

(ফিচারে ব্যবহৃত ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেয়া)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.