নাদেরা সুলতানা নদী:
২০০৯ এ দেশ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছি এই দেশে। শুরুতে ছিলাম এখানকার সবচেয়ে কম ঘনবসতিপূর্ণ সাউথ অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী এডিলেইডে। একটা বাংলা দোকান, তারপরও অনেককিছু পাওয়াই যেতো না, যা এই সময় ২০২১ এ এসে পাই। কোন বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট খুঁজেই পাইনি। সকল অস্ট্রেলিয়ান চেনা ব্র্যান্ড ম্যাক, জ্যাক, কেএফসি, নান্দোস এবং অন্যান্য ক্যাফের পাশে আর যা ছিল তার কিছু ইন্ডিয়ান, আফগান কাবাব শপ। বাংলাদেশি মালিকানার রেস্টুরেন্ট যা ছিল তাতে ছিল মিক্সড কুইজিন, যা অস্ট্রেলিয়ানরাও পছন্দ করে সেইরকম সব খাবার আয়োজন নিয়েই।
আমাদের যেরকম খাবার পছন্দ সেরকম কিছু বাইরে খেতে ইচ্ছে করলে এমন কোনো রেস্টুরেন্টেই যেতাম নিতান্ত বাধ্য হয়ে। গাঁদা গাঁদা রঙ আর বাটার দেয়া চিকেন কারি, স্বাদহীন কাবাব, নান-টান দিয়ে খেয়েই মন হতো, আহ্, আমাদের খাবার … আহা, কী ছেড়ে এলাম দেশে! যা খেয়ে বড় হয়েছি, যা রান্না করতে দেখেছি, বিশেষভাবে নিজেদের ঘরে মা-মাসীকে, আলাদা আলাদা সিজনে, বন্ধুদের নিয়ে যেকোনো সেলিব্রেশনে বা অন্যান্য আচার অনুষ্ঠানে… সেই খাবারগুলো সবাই মিস করতাম এবং একসাথে হলে সীমিত উপকরণ দিয়েই কাছাকাছি কিছু রান্না করেই পেতাম সেইরকম তৃপ্তি! নিজেদের মাঝে খাবার আলোচনা হলে সেইসব নিয়েই চলতো স্মৃতি চারণ…
‘তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন মন রে আমার’!
পরিকল্পনা হতো, আমাদেরই কেউ কোন একদিন একটা রেস্টুরেন্ট ওপেন করবো এই বিভূঁইয়ে (আমি নিজ দায়িত্বে তার জনসংযোগের কাজটা বেছে নিতাম সবার আগে। ওখানে বাংলা সুর বাজবে, দুর্দান্ত ডেকোরেশন হবে দেশীয় সব ঐতিহ্য থাকবে দেয়াল জুড়ে… আহ টেবিলে উঠে আসবে মৌ মৌ গন্ধে মাছের ঝোল, চিকন চালের সাদা ভাত, আলু ভর্তা (ম্যাশড পটেটো না)… ডাল পাতলা, ঘন, বেগুন ভাজি, শর্ষে দিয়ে ইলিশ, কই… রুই ভুনা, নারকেল দিয়ে চিংড়ি… মালাইকারি, শেষ পাতে দই, রসমালাই জাতীয় যা কিছু আমাদের খাবার, তা!
আমাদের সুগন্ধি আতপ চালের পোলাও… যখনই সুযোগ এসেছে ভিনদেশি বন্ধুদের চিকেন কোর্মা বা রোস্ট দিয়ে যতবার খেতে দিয়েছি, সবাই শুধু বলেছে এই রকম মজার কোন খাবার হয় তাদের জানাই ছিলো না। সুযোগ এলেই যেন আবার করি। আমাদের আগ বাড়িয়ে বলতে হয়, এই চাল শুধুই আমাদের। আমাদের বলতে এই খাবারগুলো শুধুই বাঙ্গালীর, বাংলাদেশীদের। এইগুলো ভারতীয় বা অন্য এশিয়ান খাবার থেকে আলাদা।
এই গল্পগুলো বোধ হয় প্রবাসে থাকা অনেকেরই গল্প। থাক, এই গল্প তোলা থাকুক আজ।
জানাই হঠাৎ অস্ট্রেলিয়ায় থাকা বাংলাদেশিদের সামনে ঘটে যাওয়া এই খাবার নিয়েই যা রচিত হয়ে গেল, সেই গল্প। যার নাম ‘কিশোয়ার চৌধুরী’। মাস্টার শেফ অস্ট্রেলিয়া ২০২১ এ অংশ নেয়া একজন হয়েই তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন এক অনন্য গল্প।
যাদের জানা নেই, ছোট করে বলে নেই ভূমিকাটা।
কিশোয়ার চৌধুরী, বাংলাদেশি বাবা, মুক্তিযোদ্ধা কামরুল চৌধুরী এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী মা লায়লা চৌধুরীর অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশি মেয়ে। যে থাকে আমি যে শহরে আছি সেখানেই। মেলবোর্ন, ভিক্টোরিয়া। মূলতঃ তিনি বাবার বিশাল প্রিন্টিং বিজনেস দেখাশুনা করেন এবং রান্না নিয়ে পরিবার থেকেই পেয়েছেন সকল অনুপ্রেরণা। আগ্রহ ছিল বিশেষভাবে বাংলা খাবারে। যখনই দেশে বেড়াতে গেছেন তখনই দেখেছেন খুব কাছ থেকে এবং সেই বিয়ের পর যখন বরকে নিয়ে বেড়াতে গেছেন রাঙ্গামাটি, সেখানে গিয়ে খেয়েছেন এমন একটি আইটেমও তিনি তুলে নিয়ে এসেছেন রান্নার এই প্রতিযোগিতায়।
ফাইনাল পর্বটি ছিল দুইদিনব্যাপি। মূল বিচারক তিনজন ছাড়াও সাথে যোগ দেন বিভিন্ন সময়ের সেরা মাস্টারশেফসহ আরও অনেক নামকরা শেফ, তাঁদের আনা কোন না কোন উপকরণ এবং লটারির মাধ্যমে উঠিয়ে আনতে হয়েছে রান্নার মাধ্যম ও নিজস্ব কোন আইটেম। এরই এক পর্বে সেরা ডিশের একটি ছিল আলু ভর্তা, পান্তা ভাত, যাকে স্মোকি রাইস বলা হয়েছে, সাথে সার্ডিন মাছ ভাজা, সরিষার তেলে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচের অপরূপ গার্নিস… যা তিন বিচারকের কাছে দশে দশ পেয়ে পুরো ৩০ পেয়েছে এবং প্রথম পর্বের পর তার প্রাপ্ত মূল নাম্বারে সে ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে।
বলে নেই চূড়ান্ত পর্বের আগে কিশোয়ারকে পাড়ি দিতে হয়েছে ৫৭টি পর্ব, প্রমাণ করতে হয়েছে একের পর এক আইটেম দিয়ে নিজের বিশেষত্ব। এর আগে যে রান্নাগুলো নিয়ে এসেছেন বিচারকদের বেঁধে দেয়া নিয়মের মাঝেই, তার মাঝে নজর কেড়েছে লাউ চিংড়ি, পোড়া বেগুন ভর্তা, মাটন কোর্মা, চাটনি এবং খিচুড়ির মতো বেশকিছু খাঁটি বাংলা খাবার।
গতকাল ফাইনালের চূড়ান্ত পর্বে নামকরা শেফ পিটার গিলমোরের বেঁধে দেয়া রেসিপি অনুযায়ী নাট ক্যারামেল গোল্ডেন ক্র্যাকল কেক এবং স্কুইড কাস্টার্ড নুডলস বানাতে হলো। সময়মতো শেষ করতে পেরেছে কিশোয়ার এবং পেয়েছে বিচারকদের প্রশংসাও।
কিন্তু ফলাফল বিচারে ফিজিয়ান ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত জাস্টিন নারায়ণ জিতে নিলো এবারের মাস্টারশেফ শিরোপা। প্রথম রানার আপ অস্ট্রেলিয়ান আরেক তরুণ পিট এবং দ্বিতীয় রানার আপ হয়েছে আমাদের কিশোয়ার চৌধুরী।
এই ফলাফল বা এর অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার বিস্তারিত আর নাই বলি, যে কথা বলতেই চাই, এই প্রথমবার এই রকম একটি শোয়ের মাধ্যমে যা উঠে এসেছে…
কিশোয়ার চৌধুরী, আমাদের আত্মপরিচয়ের গুরুত্ব নূতন করে অনুধাবন করার অনুপ্রেরণামূলক এক নাম। খাবার সংস্কৃতি, যা কিছু আমাদের শেকড়, আমাদের নিজস্বতা, স্বকীয়তা, বাংলার, বাংলাদেশের, তা প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার বুকে কেউ এতো গৌরবের সাথে অনন্য এক উচ্চতায় তুলে আনলেন।
প্রবাসী বাংলাদেশী, অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশিদের কাছে তো বটেই, কিশোয়ারের নাম বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বে যে নূতন পরিচয় বহন করছে তা দেখে গত কদিন ধরেই কিশোয়ারের শহরে থাকা বাংলাদেশি হিসেবে অনেক বেশি রোমাঞ্চিত হয়ে আছি লাখো বাংলাদেশিদের একজন হয়ে।
কিশোয়ার, এক সাহসের নাম, ভালোবাসার নাম এবং আমাদের কাছে মাস্টার শেফ, অস্ট্রেলিয়া ২০২১ টপ থ্রি এক ফাইনালিস্ট হয়েই সে চ্যাম্পিয়ন!! আনুষ্ঠানিক ফাইনালে সে দ্বিতীয় রানার আপ হয়েছে এটার তেমন কোন গুরুত্ব নেই আর, সে যে নূতন ইতিহাস রচনা করেছে তা লিখতে আমাদের অনেক লম্বা সময় লাগবে এবং এটা একটা কেবল স্বর্ণালী অধ্যায় হয়েই থেকে যাবে! কিশোয়ার যে পথ দেখিয়ে গেছে আমি নিশ্চিত এই পথে কাল, পরশু অন্য অনেকেই হেঁটে যাবে বহুদূর! কিশোয়ার, আমাদের বাংলা খাবারকে আলাদা করে চিনিয়েছে এবং যে সম্মাননা এনে দিয়েছে তাতে সেই হয়ে থাকবে অন্যতম পথ প্রদর্শক।
কিশোয়ার তার প্রতিটি পরিবেশনায়ই এনেছে বাংলা বাংলাদেশ এই পরিচয়কে। উচ্চারিত হয়েছে বিচারকদের মুখে বাংলা কুইজিন আলাদা করে। জানিয়েছে সে একজন অস্ট্রেলিয়ান, তার বাবা মা যেসব খাবার বাংলাদেশে খেয়েছে তার অনেককিছু তাকে স্পর্শ করেছে বলেই সে এইসব রান্না ভালোবেসেছে এবং সে আবেগাপ্লুত হয়ে সব সময়ই বলেছে সে চায় তার সন্তানদের জন্যে একটি রেসিপি বুক সে রেখে যাবে যেখানে তার অস্ট্রেলিয়ান বাচ্চারা তাঁকেও খুঁজে পাবে।
কিশোয়ার শুরু থেকেই ভীষণ রকমের আবেগী হয়ে অনেকবারই তার ছোট ছোট প্রকাশে চোখ ভিজিয়েছে, অনেকবার তার সেই প্রকাশ বিচারকদেরও ছুঁয়ে গেছে এবং সবটুকু একাত্মতা প্রকাশও করেছে।
কেউ কেউ এই কান্নার সমালোচনা করলেও আমরা যারা পরবাসী জীবন নিতান্তই বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছি, বুকের মাঝে এক টুকরো বাংলাদেশ নিয়েই করি বাস, তাঁরাই শুধু জানি এই কান্নার মানে, কখন ভিজে চোখ কোন কারণে!
নাদেরা সুলতানা নদী
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া