‘মুখরা’ মমতার বাগড়ায় তিস্তার পর স্থলসীমান্ত চুক্তিও হলো না!

Momota
মমতা ব্যানার্জী

নাজনীন আখতার: কংগ্রেসের বিরোধিতা করতে গিয়ে ছিটমহলবাসীর বিরুদ্ধেই চলে যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই রূপ বিজেপিরও। বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তি নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল আর প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরোধিতার মূল বিষয়টা এমনই সাদামাটা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এর বিরোধিতার মূলে যতটা না যুক্তি, বিবেচনা বা বিশ্লেষণ রয়েছে, তার চেয়েও বেশি রয়েছে নির্বাচনের আগে আগে ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের বিরোধিতা করা। আর ভারতের এ অভ্যন্তরীণ কাদা ছোড়াছুড়ির মধ্যে পড়েছে ছিটমহলবাসী। যেখানে ভারতের লোকই রয়েছে বেশি, তাদের দুর্দশা বেড়েই চলেছে।

কূটনৈতিক মহলের মতে, স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন ঝুলে থাকার হতাশা থাকলেও এ বিষয়ে বাংলাদেশের বর্তমানে করণীয় কিছুই নেই। মহাজোট সরকার এ বিষয়ে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তবে যেখানে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দল আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোঁয়ার্তুমি বহাল থাকে, সেখানে বাংলাদেশের চেষ্টা আর কতদূর সফলতা পেতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কূটনীতিক এ বিষয়ে  বলেন, স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে বিজেপির চেয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচরণ আরও বেশি বিরক্তিকর। সে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের গণমাধ্যমও তাঁর প্রশংসায় ছিল মুখর। ধারণা করা হয়েছিল, তিনি বাংলাদেশের এ সমর্থনের মূল্য দেবেন। অথচ এই ‘মুখরা’ নারী বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নে আপাতত প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। একই সময় বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এবং ভারতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট ক্ষমতায় থাকায় ৪২ বছরের পুরাতন ইস্যু তিস্তা ও স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে আশার আলো দেখা দিয়েছিল। কিন্তু প্রায় বাস্তবায়নের পথে থাকা দুটি ইস্যুতেই বাগড়া দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের ঢাকা সফরের সময় চূড়ান্ত অবস্থায় থাকা তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরে ভেটো দিয়ে তা বানচাল করে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

উল্লেখ্য, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থল সীমান্ত চুক্তি এবং ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের ঢাকা সফরের সময় সই হওয়া এ সংক্রান্ত প্রটোকল বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতের সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এ লক্ষ্যে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট সরকার এর আগে পার্লামেন্টে বিল তোলার উদ্যোগ নিলেও বিষয়টি আটকে আছে প্রধান বিরোধী দল বিজেপির বিরোধিতার কারণে। কোন বিল পাস করতে হলে ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয়কক্ষ লোকসভা ও রাজ্যসভায় অন্তত দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন দরকার, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট সরকারের যা নেই।

এ বিলে বিজেপির আসাম অংশের নেতাকর্মীদের বিরোধিতা থাকায় বিজেপি বিল পার্লামেন্টে তুলতে বিরোধিতা করে। তবে বাংলাদেশকে ভারত আশ্বাস দেয় এই জানিয়ে যে, তারা বিজেপির সঙ্গে আলোচনা করছে। বর্ষাকালীন অধিবেশনে বিলটি তোলা হবে। তবে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে শুরু হওয়া বর্ষাকালীন অধিবেশনে বিজেপির বিরোধিতায় বিলটি তোলা থেকে বিরত থাকেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ।

সর্বশেষ গত শনিবার বিজেপির কেন্দ্রীয় নেত্রী সুষমা স্বরাজ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, স্থল সীমান্ত চুক্তির জন্য সংবিধান সংশোধন বিল তাঁরা রাজ্যসভায় পেশ করতে বা পাস করতে দেবেন না। বিজেপির এমন সুষ্পষ্ট বিরোধিতার পাশাপাশি আবার এখন নতুন ঝামেলা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের ভেতরে প্রগতিশীল চিন্তাধারীদের সমালোচনাও তিনি গায়ে মাখছেন না।

এ অবস্থায় বাংলাদেশের করণীয় কী, বা বাংলাদেশ হতাশ কিনা- প্রশ্ন করা হলে ‘না’ সূচক জবাব দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা। তাঁর মতে, বাংলাদেশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ২৫ থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত ভারত সফর করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। মন্ত্রী আর কে মিশরা মেমোরিয়ালে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকাভিত্তিক আঞ্চলিক সহযোগিতা বিষয়ে লেকচার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারত গেলেও স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে তিনি সরকারের হয়ে শেষ চেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি বিজেপি নেতা অরুণ জেটলির সঙ্গে বৈঠক করে সমর্থন চেয়েছেন। বাংলাদেশের হাইকমিশনার বৈঠক করেছেন বিজেপির কট্টরপন্থী নেতা নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। এর পর আর সরকারের দিক দিয়ে আর কি করার থাকতে পারে?

তবে স্থল সীমান্ত চুক্তিতে মমতার বিরোধিতায় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই বলে মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা। তাঁর মতে, মমতার পক্ষে সবই সম্ভব!
চলতি মাসে দেয়া এক সাক্ষাতকারে স্থল সীমান্ত চুক্তি নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, ‘স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল না। দেশের স্বার্থে সরকার এতে কাজ করেছে। আমি আশাবাদী, এটা নিষ্পন্ন হবে।’ তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘যদি এ সরকারের সময় চুক্তিটি না হয় তাহলে কি তা সরকারের ব্যর্থতা হবে? এর আগের সরকারগুলো যে এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগই নিল না, সেটা কি ব্যর্থতা নয়?’

দীপু মনি বলেন, ৮-৯ মাস পরও যদি চুক্তিটি বাস্তবায়ন হয়, তাহলেও সেটি হবে এ সরকারের সফলতা। তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের পার্লামেন্টে যে সিদ্ধান্ত হবে সেটি তো আমি হাতে করে বা ব্যাগে করে নিয়ে আসতে পারি না।’

স্থল সীমান্ত চুক্তির বিরোধিতা করে গত শনিবার রাতে ফেসবুক বার্তায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘রাজ্য সরকারের সম্মতি ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশকে ভূমি দেয়ার যে প্রস্তাব করেছে, তা মেনে নেয়া কষ্টকর। এ চুক্তি হলে পশ্চিমবঙ্গ পাবে মাত্র ৭ হাজার একর ভূমি। বিনিময়ে বাংলাদেশকে দিতে হবে ১৭ হাজার একর ভূমি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা অবশ্যই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাই কিন্তু সেটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে নয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ওই চুক্তির খসড়া যখন হয়, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এক রকম কথা বলা হয়েছিল। পরে প্রস্তাবিত চূড়ান্ত খসড়ায় দেখা গেল, সরকারের আগের কথা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। তৃণমূল নেত্রী প্রশ্ন তোলেন, ‘রাজ্য সরকারের সম্মতি ছাড়াই আমাদের ভূমি ও পানি দিয়ে দেয়ার জন্য সরকারের এত তাড়া কিসের?’

এদিকে ভারতের গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, তৃণমূল ও বিজেপির উদারপন্থী নেতারা বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে দলের বিরোধিতার সমালোচনা করছেন। তৃণমূলের সংসদ সদস্য জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমন এ বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। আর বিজেপির সংসদ সদস্য প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর আরেক নাতি বরুণ গান্ধী ভারতের দি টাইমস অব ইন্ডিয়ায় তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ও স্থল সীমান্ত চুক্তির প্রতি সমর্থন জানিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন দুই সপ্তাহ আগে। এ ছাড়া গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাতকারে বিজেপির ঘনিষ্ঠ সাবেক সেনা কর্মকর্তা শ্রীনিবাস কুমার সিনহা ওই দুটি চুক্তির ক্ষেত্রে সমর্থন দেন। তিস্তা চুক্তি না হওয়ার কারণে মমতার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘এক মমতাতেই তিস্তা আটকে গেল? কেন্দ্রীয় সরকার তবে করছে টা কী?’

এ ছাড়া তৃণমূল সংসদ সদস্য কবীর সুমন গত শুক্রবার আক্ষেপ করে গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘ছিটমহলের মানুষ পরিচয়হীনভাবে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে আছে। তা থেকে তাদের মুক্তি দেয়ার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু ভিশনলেস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য সেটা সম্ভব হলো না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার দল বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সীমান্ত চুক্তি অনুমোদনের জন্য রাজ্যসভায় বিল উত্থাপনে বাধা দেয়ায় আমি ব্যথিত ও লজ্জিত। কেন, কোন যুক্তিতে এ কাজ করা হয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়।’ তিনি বলেন, ‘আমার ইচ্ছা করছে সংসদ থেকে পদত্যাগ করি কিন্তু নির্বাচনের আগে পদত্যাগ করলে নির্বাচন করা এবং গাদা গাদা টাকা খরচ- এই ভেবে করছি না।’

শনিবার আনন্দবাজার পত্রিকায় এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার ঠিক তিন মাস পর বিদেশ সচিবকে চিঠি লিখে ওই খসড়া চুক্তিতে সায় দিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যসচিব সমর ঘোষ। প্রশ্ন উঠছে, মুখ্যসচিবের পাঠানো চিঠির বক্তব্য থেকে রাজ্য সরকার এভাবে সরে আসতে পারে কিনা?’

প্রতিবেদনে বলা হয়, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, স্থল সীমান্ত চুক্তি হলে রাজ্যের লাভ নয়, লোকসানই হবে। কারণ ভারতে বাংলাদেশী ছিটমহল রয়েছে ৫১টি, যার মোট এলাকা প্রায় ৭ হাজার একর। আর বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের যে ১১১টি ছিটমহল রয়েছে, তার জমির পরিমাণ প্রায় ১৭ হাজার একর। ফলে ছিটমহল হস্তান্তর হলে ভারত পাবে ৭ হাজার একর কিন্তু দিতে হবে ১৭ হাজার একর।

যার উত্তরে কেন্দ্রীয় সরকার সূত্রে বলা হচ্ছে, খাতা-কলমে ভারতকে বেশি জমি দিতে হলেও বাস্তবে ওই ১৭ হাজার একর জমিতে কখনই ভারতের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ভারতীয় ছিটমহলগুলো বাংলাদেশের গভীরে অবস্থিত এবং সেগুলো কার্যত বাংলাদেশেরই দখলে থেকেছে। একইভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডে থাকা বাংলাদেশী ছিটমহলের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। ফলে ছিটমহল বিনিময় একটি পরিস্থিতিকে বৈধতা দেবে, যা ইতোমধ্যেই বিদ্যমান।

তাছাড়া দিল্লি মনে করে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা রয়েছে। ফলে এ সুযোগে ছিটমহলসহ দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা অন্য সমস্যার যদি সমাধান করা যায়, তাহলে সেটা জাতীয় স্বার্থের পক্ষেও ভাল হবে।

এত দূর এগিয়ে এখন স্থল সীমান্ত চুক্তি করা না গেলে ভবিষ্যতে যে সেটা করা কঠিন হবে, সে বার্তাও বার বার দিচ্ছে বিদেশ মন্ত্রক। মন্ত্রকের কর্তাদের মত- সময়ের সঙ্গে নদীপথ বদলে যাবে, জনসংখ্যা, ভূগোল সবই বদলে যাবে। মাঝখান থেকে ছিটমহলবাসীর দুর্দশা ঘুচবে না।

(প্রতিবেদনটি দৈনিক জনকণ্ঠ থেকে নেওয়া)

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.