রেহানা মরিয়ম নূর- আত্মবিশ্বাসে দীপ্ত এক নাম

ফারহানা আনন্দময়ী:

গত দু’দিন ধরে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ এর জয়যাত্রার আলোকচিত্র দেখছি গণমাধ্যমগুলোতে; চোখ জুড়োচ্ছে দেখে, হৃদয় আনন্দে উদ্বেল হচ্ছে। সুদূর ফরাসী দেশের কান শহর থেকে ভেসে আসছে সেই যাত্রার জয়ধ্বনি। আঁ সার্তে রিগা (আনসার্টেইন রিগার্ড্‌স) বিভাগে চলচ্চিত্রটির বিশ্বব্যাপী প্রথম প্রদর্শনের পরে কান’এর সেই মিলনায়তন ভর্তি দর্শক-শ্রোতা উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে সমস্বরে অভিবাদন জানিয়েছেন ‘রেহানা মরিয়ম নূর’এর পুরো দলকে। অর্জন ‘রেহানা মরিয়ম নূর’এর নির্মাণ দলের, আনন্দ আমাদের।

চলচ্চিত্রটি এখনও বাংলাদেশে প্রদর্শনের জন্য মুক্তি পায়নি। তাই শুধু ট্রেলার দেখে এই চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে দর্শক-প্রতিক্রিয়া জানানো যায় না। তবে প্রিমিয়ার শো-এর পরে দু-একটি বিদেশি গণমাধ্যমে এর ভালোমন্দ বিষয়ে নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। সেই নিবন্ধগুলো পাঠ করে আর ট্রেলার দেখে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’কে নিজস্ব চিন্তা-ছকের মধ্যে ফেলতে চেষ্টা করেছি। এবং প্রবল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি, আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ’এর ‘পারফেকশনিস্ট’ পরিচালনায় আর আজমেরি হক বাঁধন এর দুর্দান্ত অভিনয় সমৃদ্ধ ‘রেহানা’কে দেখবার জন্য।

রেহানা পেশায় একজন চিকিৎসক, ব্যক্তিগত জীবনে ছয় বছর বয়সী একজন কন্যাসন্তান নিয়ে তার জীবনযাপন, স্বামী প্রয়াত। বিশ্বাস ও বচনে সৎ, জেদি প্রকৃতির একজন নারী, তার কর্ম-চেতনায় এটুকু স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে যে, রেহানা নারীবাদে বিশ্বাসী এবং তার নিজস্ব জীবনে তা শতভাগ চর্চা করেন। রেহানার মতো নারী আমাদের সমাজে অনেক অনেক আছেন। লড়াই করে এই সমাজে ‘একলা নারী’ হয়ে টিকে আছেন। এঁদের মধ্যে কেউ স্বেচ্ছায় অবিবাহিত জীবন বেছে নিয়েছেন, কেউ সংসার ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন, কাউকে বাধ্য করা হয়েছে বেরিয়ে যেতে, অথবা কেউ রেহানার মতো বিধবা। এরা সকলেই একলা একলাই দাঁড়িয়ে গেছেন, যার যার যোগ্যতা অনুসারে। কিন্তু এই দাঁড়াবার পথটা কারও জন্যেই মসৃণ নয়। নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়েছে, সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করতে শিখতে হয়েছে, পুরুষের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে, এমনকি অন্য নারীর ভ্রু-কুঞ্চনকে অবজ্ঞা করতে হয়েছে। পুরুষ সহকর্মীর কুৎসিত যৌন-ইঙ্গিতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়েছে, আবার সেইসব পুরুষেরই স্ত্রীদের আঙুল-নির্দেশের লক্ষ্য হতে হয়েছে সেই একলা নারীকেই। তারপরেও তাঁরা ঋজুভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, এগিয়ে গেছেন… আমাকে এবং আমাদেরকে ছাড়িয়ে অনেকটা সামনে। রেহানা এবং রেহানার মতো কেউ কেউ তার নিজস্ব কঠিন সময়ে দৃশ্যত একলা হলেও মানসিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ।

‘রেহানা মরিয়ম নূর’ এ ঠিক এই বার্তাটাই দিতে চেয়েছেন নির্মাতা। মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্রী, রেহানারই সহকর্মী চিকিৎসকের দ্বারা শারীরিকভাবে নিগৃহিত হওয়ার ঘটনার খানিকটা চাক্ষুষ করেন রেহানা। রেহানা বারংবার আশ্বস্ত করার পরেও ছাত্রীটি যখন এটা অভিযোগ আকারে কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানানোর মতো যথেষ্ট মনোবল দেখাতে ব্যর্থ হয়, রেহানা নিজেই ভিক্টিম দাবি করে এই হেনস্থার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ান। একাই। অসীম আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে লড়াই চালিয়ে যান। নারীর প্রতি এই নিগ্রহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শেষপর্যন্ত রেহানার জয়ী হওয়া জরুরি, যাতে পুরুষ চিকিৎসকটি অভিযোগ স্বীকার করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কলেজে আর কোনো ছাত্রী পুনরায় এই ঘটনার শিকার যেন না হন, সেটা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন রেহানা। তবে ধর্ষণের শিকার ছাত্রীটি কেন সাহস করে অভিযোগটি জানিয়ে প্রকাশ্য হলেন না, তারও একটি যৌক্তিক কার্যকারণ রয়েছে। তা হচ্ছে এ সমাজ ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ এ কুৎসিতরকম তৎপর।

আমার বা আপনার কিশোরী বা সদ্যতরুণী কন্যা যদি আপনার কাছে এসে তার স্কুলে কিংবা আত্মীয়তার বলয়ে ঘটে যাওয়া কোনো যৌনহেনস্থার অভিযোগ করে, বেশিরভাগ টাইপ মা-বাবা বা শিক্ষকেরা তা সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হবার ভয়ে গোপন করে যেতে বলেন। অনুগ্রহ ক’রে তাকে বিশ্বাস করুন। তাকে উল্টো দোষারোপ না ক’রে তার অভিযোগ আমলে নিন। আপনার সাধ্যের মধ্যে যতটা পারেন, প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। স্কুল-কলেজে ঘটনা ঘটলে, লিখিত অভিযোগ দিন কর্তৃপক্ষকে। পরিবারের মধ্যে ঘটলে আত্মীয়তা ভুলে যান। হেনস্থাকারী যদি আপনার পরম কাছের কেউ-ও হয়, তাকে ছাড় দেয়া যাবে না।

ফারহানা আনন্দময়ী

আর পরিণত বয়সে পৌঁছানোর পরে ঘরে বা কর্মক্ষেত্রে কখনও যৌনহেনস্থার শিকার হলে প্রকাশ করতে দেরি করা উচিত নয় মোটেই। পরিবারের কাছে এসে মন খুলুন, হতে পারে আপনার বিশ্বস্ত সঙ্গী বা প্রাপ্তমনস্ক সন্তা্নের কাছে। এই সমাজে আবার বেশিরভাগ ‘স্টিরিওটাইপ’ মানসিকতার সঙ্গীর কাছে অভিযোগ জানানোর একটা সমস্যা অবশ্য আছে। গতানুগতিক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার সঙ্গী যদি হয়, তখন উলটে সেই নারীকে অভিযুক্ত করতে পারে, “একা কেন গেছ? নিশ্চয়ই তোমার আচরণেও এমন কিছু ছিল যা তাকে অন্যরকম ইঙ্গিত দিয়েছে?” ভিক্টিম ব্লেমিং-এর প্রথম ছুঁড়ে দেয়া অস্ত্র হলো এটি। তারপরেও প্রতিবাদে মুখ খুলতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।

আরও একটি বিষয়, এই প্রজন্মের সন্তানেরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মানসিকভাবে অগ্রসরতা পায়। চিন্তার দীনতা তাদের মগজে কম প্রভাববিস্তারী। ক্ষেত্রবিশেষে বিপরীতটাও করা যায়। এমনও হয়, মা-বাবা যেমন সন্তানকে সাহসের মশালটা জ্বালিয়ে দিতে পারেন, কোনো ক্ষেত্রে সন্তানও পারে বিধ্বস্ত সময়ে মায়ের শক্তিসঞ্চারি হয়ে উঠতে। যত আমরা এধরনের নিগ্রহের ঘটনা গোপন ক’রে রাখবো, পচন তত বেশি ছড়াবে। একজনের তোলা আওয়াজে আশেপাশের আরো পাঁচজন পুরুষ সতর্কবার্তা পাবে। রেহানা এই সিনেমায় ন্যায়বিচার চেয়ে প্রতিবাদের সেই আওয়াজটা তুলেছেন, একা কিন্তু সশব্দ।

আবার ‘রেহানা মরিয়ম নূর’এ ফিরি। চলচ্চিত্রটির আরেক পর্বে নির্মাতা দেখান, রেহানার শিশুকন্যাটি স্কুলে কোনো একটা ঘটনায় মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছে। রেহানা স্কুলে সেই বিষয়ে অভিযোগ জানাতে গেলে উল্টো তাকেই ‘গুড প্যারেন্টিং’ শেখার পরামর্শ জারি করা হয়। আপাতদৃষ্টিতে সমাজের কাছে মনে হচ্ছে, রেহানা যেহেতু একজন ‘স্ট্রাগলিং সিঙ্গেল মাদার’, তিনি তার পেশাগত কাজের ব্যস্ততায় কন্যাকে যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন না। কন্যা আর মায়ের মধ্যেও একটা মনস্তাত্বিক লড়াই প্রতিনিয়ত চলতেই থাকে। বয়সে শিশু হলেও ‘ইমু’ নামের কন্যাটির অন্তর্গত জগতে মায়ের একরোখা, জেদি ব্যক্তিত্বের প্রতিবিম্ব স্পষ্টই দেখা যায়। রেহানাকে কেবল বাইরের জগতেই নয়, ঘরে পরিবারে মন কষাকষির টান্‌টান্‌ এক দড়ির এক প্রান্ত ধরে রেখে যাপিত জীবনে বাঁচতে হয়। নৈতিক ব্যাখ্যা আর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার এক দ্বৈরথ চলমান পুরো চলচ্চিত্রটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। ট্রেলার দেখে আর প্রিমিয়ার শেষে রিভিউ পড়ে রেহানার চিন্তাজগতের এই অমোঘ টানাপোড়েনের অনেকখানি অনুভব করাই যায়।

রেহানা চরিত্রে রূপদেয়া অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধন প্রিমিয়ার শো শেষ করে বেরিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রেহানা আর বাঁধন একটা সময়ে এসে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। বাঁধনের রিয়েল-জীবনের লড়াই আর রিলে-জীবনের চিত্রনাট্য এতোটাই মিলে গেছে যে তিনি রেহানা চরিত্রটার সাথে প্রতি মুহূর্তে সংযোগস্থাপন করতে পেরেছেন। পরিচালক সাদ এজন্যই হয়তো বাঁধনের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পেরেছিলেন। বলেছিলেন, “রেহানা চরিত্রটা তুমি যদি না করতে পারো তো আর কেউই পারবে না”। বাঁধন বাস্তবজীবনে মানসিক অবসাদগ্রস্ততার মধ্য দিয়ে গেছেন, এখনও আছেন, তাই নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বাঁধন বলতেই পারেন, বিষণ্নতা মানসিক অসুস্থতার প্রথম ধাপ, ধীরে ধীরে সে পুরোপুরি গ্রাস করে নেয়। তার আগেই বেরিয়ে এসো নারী, মুখ খোলো, মন খোলো। বেঁচে ওঠো, মানুষ। কাটুক জীবন সরব আকাঙ্ক্ষায়।

এই সমাজে রেহানার মতো সংগ্রামরত পরিচিত অপরিচিত সকল এবং প্রতিটি একলা নারীকে অভিবাদন। তাদের এই একা এবং একাকী পথচলা জয়যুক্ত হবেই। আমাদের প্রত্যেকেরই কাঠবেড়ালির মতো কিছু পাথর বয়ে আনার শক্তি আছে, সমুদ্র লঙ্ঘনও যাতে অসম্ভব থাকে না। প্রয়োজন শুধু সেই বিশ্বাসটুকু জাগানো, বিশ্বাসটুকু যোগানো। এই চলচ্চিত্রটি তার প্রতিচ্ছবি। পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, নাম ভূমিকায় অভিনয়কারী আজমেরি হক বাঁধনসহ ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ নির্মাণদলের সকলকে অভিবাদন।

জয় হোক, এই জয়রথ না থামুক, এই শুভকামনা রইলো।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.