ইমতিয়াজ মাহমুদ:
আজ ৬ই জুলাই ম্যাগদালেনা কারমেন ফ্রিদা কাহলোর (Magdalena Carmen Frida Kahlo y Calderón) শুভ জন্মদিন। বিশ্বব্যাপী তিনি ফ্রিদা কাহলো নামেই পরিচিত। পরাবাস্তব শিল্পী, কম্যুনিস্ট কর্মী ফ্রিদা সারা দুনিয়ায়ই নারী, নারীর অধিকার ও নারীবাদ এইসবের একজন আইকন হিসাবেই চিহ্নিত। (ফ্রিদা কাহলোর নাম লেখার সময় বাংলায় আমরা কাহলো লিখি বটে, কিন্তু ওঁর পারিবারিক নাম কাহলো, মেক্সিকোর ভাষায় উচ্চারিত হয় মাঝখানের হ ধ্বনিটা বাদ দিয়ে- কালো বা আকারটা একটু দীর্ঘ করে কাআলো এইভাবে।) ১৯০৭ সনের ৬ই জুলাই থেকে ১৯৫৪ সনের ১৩ই জুলাই পর্যন্ত ছিল তাঁর জীবনকাল।
ওঁর জীবনের ব্যক্তিগত অসুস্থতা, দুর্ঘটনার পর প্রায় অচল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে সর্বক্ষণ শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সম্পর্কের টানাপড়েন, পার্টির সাথে ওঁর সম্পর্ক এবং সবকিছুর উপরে তাঁর শিল্পকর্ম এইসবকিছু নিয়েই তিনি যেন সংগ্রামেরই একটি প্রতিরূপ। আপনাদের মধ্যে যারা ফ্রিদা সম্পর্কে এর আগে জানতেন না বা ওঁর কথা শোনেনি, আপনি চাইলেই ওঁর সম্পর্কে সকল তথ্য, ওঁর সকল সৃষ্টিকর্ম সবকিছুই অনলাইনে পাবেন। ওঁর সম্পর্কে অনেক লেখা পাবেন, ওঁর উপর নির্মিত সিনেমা ডকুমেন্টারি এইসবও পাবেন। ফ্রিদাকে নিয়ে পশ্চিমাদের এইসব লেখা, সিনেমা ইত্যাদি দেখে আপনার মনে হতে পারে যে ওরা ফ্রিদার কম্যুনিস্ট আদর্শ ও কম্যুনিস্ট হিসাবে সংগ্রামের দিকটা খানিকটা আড়াল করে ওঁর ব্যক্তিগত লড়াই সংগ্রামটাকেই একটু বড় করে দেখাতে চায়। পশ্চিমারা ওঁর আদর্শের দিক অর্থাৎ ওঁর মার্ক্সবাদী দিকটা আসলেই একটু আড়াল করতে চায়। এমনকি পশ্চিমা দুনিয়ার জনপ্রিয় মাধ্যমগুলিতেও ফ্রিদা কাহলোকে নিয়ে যেভাবে আলোচনা হয়, সেগুলিতেও ওঁর কম্যুনিস্ট চরিত্র সম্পূর্ণ আড়াল করা যায় না।
ফ্রিদা কাহলোর শিল্পকর্ম দেখলেই আপনি দুইটা বিষয় লক্ষ্য না করে পারবেন না। প্রথমত, তিনি তাঁর ছবিতে এমন সব বিষয়কে স্পর্শ করতে চেয়েছেন যেগুলি ওঁর সময়ে মেক্সিকোতে তো বটেই, এমনকি অপেক্ষাকৃত অগ্রসর ইউরোপীয় দেশগুলিতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ট্যাবু বা নিষিদ্ধ বিষয় হিসাবে বিবেচিত হতো- এইগুলি নিয়ে প্রকাশে কথা বলা যাবে না, আলোচনা করা যাবে না, কথা বলা যাবে না। নারীর জীবনের এইসব দিক তাঁর ছবিতে উঠে এসেছে খুবই স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিকভাবেই। গর্ভপাত, সন্তান জন্মদান, সন্তানকে স্তন্যদান এই সবই তিনি তাঁর ছবিতে এঁকেছেন। তাঁর শিল্পের ফর্মটা যেহেতু অনেকটা পরাবাস্তব ধরনের ছিল, সেজন্যে নারীর জীবনের এইসব বিষয় শুদ্ধ চিত্ররূপেই উপস্থাপিত হয়নি- বরং প্রতিটা ছবিতেই একজন নারীর একান্ত অনুভূতি, নারীর সংগ্রাম সবই প্রকাশিত হয়েছে রেখায়, ফর্মে এবং বিশেষ করে উজ্জ্বল সব রঙে।
ফ্রিদার ছবিগুলিতে আরেকটা বিষয় আপনি লক্ষ্য না করে পারবেন না, বিশেষ করে ওঁর আত্মপ্রতিকৃতিগুলিতে, তিনি তাঁর নিজের শারীরিক গড়ন ও রূপ পাল্টাতে চাননি কখনো। ফ্রিদা কাহলোর ভুরু ছিল জোড়া ভুরু- মানে একটা ভুরু এসে আরেকটার সাথে কপালের মাঝখানে মিশেছে আর ভুরুগুলি ছিল বেশ কেশবহুল। নারিদেহের যে বাজার চলতি সৌন্দর্যের মান তখন ছিল, যেটা এখনো খুব একটা পালটায়নি, সেটা হচ্ছে যে নারীর ভুরু হবে সরু এবং দুই ভুরুর মাঝখানে বেশ খানিকটা জায়গা থাকতে হবে কেশহীন মসৃণ। এখনো দুনিয়াজুরে নারীরা ভুরু চেঁছে বা উপড়ে ফেলে ঐরকম মাপের করে নেয়। ফ্রিদা এটা কখনো করেননি। ফ্রিদা যে রূপ, সাজগোজ বা অঙ্গসজ্জা এইসব নিয়ে সচেতন ছিলেন না সেটা মোটেও নয়। রঙ তো তিনি মাখতেনই বেশ উজ্জ্বল করে। কিন্তু নিজের যে শারীরিক বৈশিষ্ট্য সেটাকে তিনি মোটেই পরিবর্তন করার পক্ষপাতী ছিলেন না। এজন্যে দেখবেন যে ওঁর ছবিতে তিনি নিজের ভুরু এঁকেছেন ঐভাবে পুরো এবং জোড়া ভুরু হিসাবেই। ওঁর আবার ঠোঁটের উপরে হালকা গোঁফের রেখা ছিল, যেটাকে তখনো পুরুষালি বিবেচনা করা হতো, এখনো তাই করা হয়। ফ্রিদা ঐ গোঁফের রেখাকেও মোটেই আড়াল করতে চাননি। উল্টা তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি তিনি যতগুলি এঁকেছেন, সবগুলিতেই দেখবেন ওঁর উপরের ঠোঁটে খুবই হালকা হলেও রোমের রেখা ঠিকই দৃশ্যমান।
কেননা তিনি নিজের ঐসব শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে তাঁর রূপের জন্যে হানিকর মনে করেননি এবং এইসব শারীরিক বৈশিষ্ট্য আড়ালর করার অসততা প্রয়োজনীয় মনে করেননি। তিনি যেমন বা সেরকম সেই রূপটিকেই তিনি তাঁর অংশ মনে করেছেন এবং সেই নিয়েই নিজেকে রূপবতী ভেবেছেন। তাঁর শরীরের যেসব বৈশিষ্ট্য সেগুলি সবকিছু নিয়েই তাঁর পরিচয়, তাঁর নারী পরিচয়। এই নয়ে তিনি মোটেই ভিত ছিলেন না, শকুচিত ছিলেন না। যেরকমটা আগেই বলেছি- রূপ সৌন্দর্য ইত্যাদি সম্পর্কে মোটেই অসচেতন ছিলেন না ফ্রিদা। তিনি সাজতে পছন্দ করতেন। সাজতেনও, সাজতেন উজ্জ্বল সব রঙে। উজ্জ্বল রঙের সাহসী সব পোশাক পরতেন, নিজেকে সাজাতে উজ্জ্বল রঙের ফুল ফিতে এইসব পরতে মোটেই দ্বিধা করতেন না। অপরের পছন্দ অপছন্দ বা বাজার চলতি সৌন্দর্যের মান ইত্যাদি নিয়ে এক পয়সা শঙ্কা তাঁর ছিল না। কখনোই নিজের পছন্দ থেকে তিনি সরে যাননি। কখনোই তিনি সমাজের কাছে বা পৃথিবীর কারো কাছে তাঁর নিজের কাজের কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
তিনি বাঁচতে চেয়েছিলেন, নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। ছোটবেলার পোলিও আর একটু বড় হবার পর দুর্ঘটনা, এই দুই মিলে তাঁর শারীরিক অবস্থা ছিল খুবই ভঙ্গুর। জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তাঁকে কাটাতে হয়েছে শয্যায়। কলারবোন ভাঙা ছিল, কোমরের ওখানে আঘাতপ্রাপ্ত ছিল, হাড় ভাঙা ছিল শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। সর্বক্ষণ তীব্র শারীরিক ব্যথায় ভুগতেন। এই সবকিছুর সাথেই তিনি লড়ে গেছেন মৃত্যুর আগের মুহূর্তটি পর্যন্ত। সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের সাথে তাঁর এই নিজের বাঁচার লড়াই এইটাও ছিল আরেকটা সংগ্রাম। দুই ফ্রন্টেই লড়ে গেছেন অপরিসীম সাহসের সাথে। তাঁর এই শারীরিক যন্ত্রণা এবং লড়াইয়ের চেতনা দুইই প্রতিফলিত হয়েছে ওঁর ছবিতে। তিনি খুব স্পষ্ট করেই বলতেন, ‘ওরা মনে করে যে আমি ছিলাম পরাবাস্তববাদী, কিন্তু আমি তো কখনো আমার স্বপ্ন আঁকিনি। আমি আমার নিজের জীবনের বাস্তবতা এঁকেছি।‘
নিজের প্রেম কামনা শরীর ভালোবাসা সবকিছু নিয়েই স্পষ্টভাষী ছিলেন ফ্রিদা কাহলো। ডিয়েগো রিভেরার সাথে তাঁর প্রেম, কাম, বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, আবার বিবাহ, এইসব তো সকলেরই জানা। সেইসাথে তিনি যে উভকামি ছিলেন সেটাও তিনি স্বীকার করেছেন অকপটে। ওঁর সময়ে একজন নারীর পক্ষে নিজের উভকামিতা বা আরেকজন নারীর প্রতি প্রণয় বা কামজ আকর্ষণের কথা স্বীকার করা সে ছিল এক অকল্পনীয় ব্যাপার। কিন্তু এইটা নিয়ে ফ্রিদা সমাজকে বা সমাজের কাউকেই এক ফোঁটা ভয় পাননি, কোন শঙ্কা ছিল না তাঁর। তিনি কার সাথে শোবেন সেটা নিয়ে তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোনদিন কাউকে কৈফিয়ত দেননি। (ফ্রিদার একজন উল্লেখযোগ্য প্রেমিকা ছিলেন জোসেফাইন বেকার। জোসেফাইন ছিলেন জাতে ফরাসী, জন্মেছিলেন আমেরিকায়।)
এই ছিলেন আমাদের ফ্রিদা কাহলো। খুব বেশিদিন তিনি থাকেননি এই পৃথিবীতে। কিন্তু যতদিন ছিলেন, তিনি তাঁর জীবন যাপন করেছেন আপন শর্তে, নিজের পছন্দে। বেছে নিয়েছিলেন সংগ্রামের পথ, নারীর জন্যে মুক্তির লড়াইয়ের পথ আর মেহনতি মানুষের মুক্তির পথ। আজকে তাঁর মৃত্যু এতোগুলি বছর পরেও তাই এই নারীটির মধ্যে বিশ্বময় সকল নারী দেখতে পায় তার নিজের লড়াকু রূপ আর খুঁজে পায় তার নিজের লড়াইয়ের প্রেরণা।
শুভ জন্মদিন উপলক্ষে কমরেড ফ্রিদা, আপনাকে লাল সেলাম।