সাবিহা শবনম:
কিছুদিন আগে চলে গেলো বাবা দিবস। প্রতিদিনের এই আটপৌরে জীবনযাপনে কোনো সম্পর্কতেই ভালোবাসা প্রকাশ করা হয়ে ওঠে না। অথচ প্রকাশেই ভালোবাসার পূর্ণতা। বিশেষ দিনগুলোতে ভালোবাসা প্রকাশের বিশেষ সুযোগ থাকে। এই প্রকাশে ভালোবাসার মানুষটি পরিপূর্ণবোধ করে।
পূর্ণতায় আরো প্রগাঢ় হয় সম্পর্ক। এজন্য বিশেষ দিন নিয়ে আমার আদিখ্যেতা আছে। বাবা দিবস আমার কাছে আরো স্পেশাল। এর বিশেষ কারণ আছে। আমার মা তার জন্মের এক বছরের মাথায় তার বাবাকে হারিয়েছিলো। আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি তার আজন্ম হাহাকার। বাবা ছাড়া একটা বাচ্চা সমাজে কতো অসহায়ভাবে বড় হয় সেটা আমি আমার মায়ের কাছ থেকে জেনেছি। অন্যদিকে আমি আমার বাবার সংস্পর্শে জেনেছি জীবন কতো সহজ – বাবাই সহজ করে দিয়েছেন- ঠিক ম্যাজিকের মতো। আসলেই বাবারা ম্যাজিকম্যান।
আমি আমার বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। প্রথম বললে ভুল হবে। কারণ আমার মায়ের প্রথম ছেলে সন্তান জন্মের পরপরই মারা যায়। সে হিসেবে আমিই তাদের স্নেহে বেড়ে ওঠা প্রথম সন্তান।সে হিসেবে খুব আহ্লাদে বড় হয়েছি আমি। আমাদের পারিবারিক এলবামের একটা ছবি আমাকে মুগ্ধ করে। ছোট্ট আমি শুয়ে আছি বিছানায়, আম্মুও আমার পাশে আর আব্বু আমার সাথে প্রাণ খুলে হাসছেন। অকৃত্রিম স্নেহের প্রকাশ। এলবামের নানা ছবির ভীড়ে আমি এই ছবিটিতে থেমে যেতাম। পিতৃস্নেহের পূর্ণ প্রকাশ! কতো স্নেহ মমতা দিয়ে বাবা-মা সন্তানদের বড় করেন। ওই ছবিগুলো আমাকে দারুণ উদ্দীপিত করে। আরেকটি ছবি ছিলো – আমি আব্বুর সানগ্লাস পরেছি, কিন্তু আমার মুখের চেয়ে গ্লাসটি বড় হওয়াতে পরে যাচ্ছে নিচে। আব্বু এই ছবিটা খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে দেখাতেন। সেই সময়ের স্নেহ তখন তার চোখেমুখে ফিরে আসতো। কী অদ্ভুত মায়া! পিতা-মাতা আর সন্তানের বাঁধন!
আমার পরিষ্কার মনে আছে দুস্বপ্ন দেখে কেঁদে উঠলে আব্বু কাঁধে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘুম পাড়াতেন। কতশত গল্প করে ভয় তাড়াতেন। আমি নিশ্চন্তে আবার ঘুমিয়ে যেতাম। ওই ভয়ের রাক্ষসপুরী থেকে আব্বুই আমাকে রক্ষা করতেন। এই বাবার কাঁধই সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। আব্বুকে নিয়ে লিখা কখনোই পরিপূর্ণ হবে না। আব্বু আমার চোখে সুপারহিরো। আমার সমস্ত মুস্কিল তিনি নিমেষে আসান করতেন, করেন।
ছোটবেলায় আমার প্রতিদিনের সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্ত ছিলো আব্বুর কলেজ থেকে ফিরে আসা। আমি কেন জানিনা এতো আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম। হয়তো সব বাচ্চারা এমন হয়। আমার ছেলে তার বাবা বাসায় ফিরে ডোরবেল বাজানোর মুহূর্তেই বাবাআআ বলে ছুটে যায় দরজার কাছে। ঠিক বুঝে যায় তার বাবা এসেছে। ঠিক বুঝে যায় পরিপূর্ণ হলো তার সব। আমিও এমনটা বুঝতাম। আব্বু বাইরে থাকা অবস্থায় ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে আমার চিন্তার অন্ত থাকতো না। এই দূরদেশে, আব্বুর কাছে থেকে এতো দূরে থেকেও আমি এই চিন্তা থেকে বের হতে পারি না।
আমার জীবনের কোনো চাওয়া আব্বু অপূর্ণ রাখেননি। খুব সামান্য হোক আর বড় হোক- আব্বু পূরণ করেছেন। মন চেয়েছে নদীর পাশে হাঁটবো, অথবা রিকশা করে পুরো শহর ঘুরবো, অথবা কোথাও বসে চা খাবো- আব্বু সবসময় সাথে ছিলেন। আমি নির্দ্বিধায় সমস্ত কিছুই আব্বুকে বলতে পেরেছি বন্ধুর মতো। কতো মন খারাপের সময় আব্বু আমাকে ঘুরতে নিয়ে গেছেন। তার মধুর স্নেহভরা কথায় মন ভালো করে দিয়েছেন। আগলে রেখেছেন তার সমস্ত দিয়ে।
আমি প্রথম সমুদ্র দেখি আব্বুর সাথে। আমি সমতল অঞ্চলের মানুষ। পাহাড়, সমুদ্রের প্রতি কী এক মুগ্ধতা ছিলো। আমার বিস্ময় মেটাতে আব্বু নিয়ে গিয়েছিলো পাহাড় আর সমুদ্রের কাছে। আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিলো সেদিন। সারাদিন আব্বুর সাথে অক্লান্ত হেঁটেছিলাম সমুদ্রে। কলকাতা গিয়ে প্রথম আবদার ছিলো নিকো পার্কে যাবো। ছোট বাচ্চাদের যা হয়। আব্বু আমাদের শুধু নিয়েই যাননি, নিজেও সেদিন বাচ্চাদের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের আনন্দে তার আনন্দ। হাজারও অম্লান স্মৃতি গাঁথা পড়ে আছে। সব মণিমুক্তার মতো জ্বলতে থাকবে আমৃত্যু।
আব্বু ভীষণভাবে একজন স্বাধীনচেতা মানুষ। আমিও আব্বুর কাছ থেকে পেয়েছি পূর্ণ স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতাবোধের পরিষ্কার ধারণাও আব্বুর কাছ থেকে পেয়েছি। জেনেছি মানুষের সৌন্দর্য তার ব্যক্তিত্বে। ভাবনার খোরাক যোগাতে আব্বু উপহার দিয়েছে অসংখ্য বই। আমি মেয়ে- এই বোধ আব্বু আমাকে কখনো মনে করিয়ে দেননি। মনে করিয়ে দিয়েছেন যোগ্য হয়ে ওঠার কথা। প্রতি মুহূর্তে আমার, আমাদের অনুপ্রেরণার পাথেয় আব্বু।
আমাদের পড়াশোনার চিন্তা ছিলো তার কাছে সর্বাগ্রে। মনে আছে লোডশেডিং খুব কমন বিষয় ছিলো তখন। সন্ধ্যায় আমাদের যেনো পড়াশোনার ব্যাঘাত না হয় এজন্য নিজ হাতে হারিকেনের গ্লাস পরিষ্কার করে রেডি করতেন। কখনো কখনো টেবিল গুছিয়ে রেডি রাখতেন। আমরা সন্ধ্যাবেলা খেলা শেষে ঘরে ফিরে দেখতাম সব রেডি। আমাদের সব বিষয়ে ছিলো তার মনোযোগ। আব্বুর সাথে নোটবুক বাঁধাই করা আর বইয়ের মলাট লাগানো ছিলো উৎসবের মতো। কতো গল্প বলে বলে আব্বু নিখুঁতভাবে পরম যত্নে কাজগুলি করতেন। ফিরে পেতে ইচ্ছে করে দিনগুলি। বৃষ্টির দিনে একসাথে কেরাম খেলা- সাথে মুড়ি মাখা। কীভাবে দিন হারিয়ে যায়!
আব্বুর ব্যক্তিগত ড্রয়ারে খুব যত্নে জমানো আছে আমাদের সব স্মৃতি। কবেকার হাতের লেখা, স্কুলে ভর্তি হওয়ার কাগজ, আইডি কার্ড, প্রতিটি সনদ- কী নেই সেখানে! সেদিন আমাকে আমার অনেক পুরনো একটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাঠিয়েছেন। এও সম্ভব! এই প্রশ্নপত্রও জমিয়ে রেখেছেন! সব জমানো ভালোবাসা। বাবারা হয়তো এমনই। তবে আমার বাবা অবশ্যই স্পেশাল।
ছোট থেকেই আমার একটুতে ঠাণ্ডা লেগে যেতো। হেমন্তের দিনগুলোতে সকালের দিকে হঠাৎ ঠাণ্ডা পড়তো। আমরা থাকতাম গভীর ঘুমে। আব্বু ঠিক ভোরবেলা উঠে আমাদের ঘরে এসে ফ্যান বন্ধ করে দিতেন। সমস্ত দুশ্চিন্তা নিজের করে নিয়ে তার সন্তানদের নির্ভার করেছিলেন। অথচ চাইলেও এখন তার দুর্ভাবনাগুলো নিয়ে নিতে পারি না। পারি না তাকে একটা চিন্তামুক্ত জীবন দিতে। পারি না তার একাকিত্ব দূর করতে। আমরা স্বার্থপর।
বাবা এক অপার্থিব স্নেহের আধার। বাবা শীতল আশ্রয়। বটবৃক্ষের চেয়েও বেশি। বাবা মানেই নিজের জীবন ক্ষয়ে ক্ষয়ে তার সন্তানকে অক্ষত রাখা। আর সেখানেই অক্ষয়। আমি গর্বিত – এক অসাধারণ বাবার সন্তান আমি। আমার বাবাই আমার একমাত্র দ্বিধাহীন আবদারের স্থান। দীর্ঘদিন এই আবদারের জায়গাটুকু ধরে রাখতে চাই এটাই প্রার্থনা।
পৃথিবীর সব বাবাদের জন্য ভালোবাসা।