ইমতিয়াজ মাহমুদ:
(১)
লিন-ইন নারীবাদ কথাটা বিদ্রূপ করেই বলা হয় বটে, কিন্তু খুঁজলে আপনি এইরকম নারীবাদীদের আপনার আশেপাশেই খুঁজে পাবেন। কারা এই লিন-ইন নারীবাদী? লিন-ইন কথাটা এসেছে ইংরেজিতে লেখা Lean In বইটা থেকে, বইটা লিখেছেন শেরিল স্যান্ডবার্গ, সাথে আরেকজন সহলেখক আছেন। শেরিল স্যান্ডবার্গ ছিলেন ফেসবুক কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজন- একজন ক্যারিয়ারসফল নারী। তিনি যে বইটা লিখেছেন, লিন ইন, এটার কথা অনেকটা ঐসব মোটিভেশন দেওয়া বক্তারা আছে না, ওদের মতো। লেখকের স্বীকার করছেন যে নারীরা বাণিজ্যিক দুনিয়ায় বা ফ্যাশন করে যেটাকে ওরা বলে কর্পোরেট দুনিয়ায় অনেকটাই পিছিয়ে আছে। বড় বড় কোম্পানির বোর্ডে নারীদের সংখ্যায় খুবই কম। খুব কম কোম্পানিই আছে যাদের প্রধান নির্বাহী পদে নারীরা আছে। তাহলে কী করতে হবে? লিন ইন। মানে হচ্ছে নারীদেরকে ক্যারিয়ারের দিকে ঝুঁকে থাকতে হবে। যেসব সামাজিক বা পারিবারিক সমস্যা আসে নারীর ক্যারিয়ার বিকাশে বাধা হয়ে, সেগুলিকে জয় করতে হবে ইত্যাদি।
যথারীতি এই বইটা খুবই জনপ্রিয় হয়েছে, লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে সারা দুনিয়ায়। অনুবাদ হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বছর দশেক হয়েছে বইটা বের হয়েছে, এখনও বিভিন্ন লিস্টিতে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের চলমান তালিকায় আপনি এই বইটার নাম দেখতে পাবেন। ঢাকায়ও পাওয়া যায় বিভিন্ন দোকানে, পাইরেটেড কপিও মিলে দেখেছি। বছর চারেক আগে এক ভদ্রমহিলা কানাডা নাকি আমেরিকা থাকেন, তিনি আমাকে বার্তা পাঠালেন, তিনি নাকি বইটা ধীরে ধীরে অনুবাদ করছেন, বইটা ওর খুবই ভালো লেগেছে, আমি এই বইটার বহুল প্রচারে কিছু করতে পারি কিনা! আমি হু হা করে পার করে দিয়েছি, খুব আগ্রহ দেখাইনি। আবার উল্টা কোন বিরক্তিও দেখাইনি, কেননা তিনি যদি এইরকম ধারণা পোষণ করেন যে লিন ইন দিয়ে নারীর বিশাল উপকার হয়ে যাবে, তিনি সেই লক্ষ্যে কাজ করুন। আমি কেন বাগড়া দিতে যাবো! মুশকিল হচ্ছে যে এই লিন ইনপন্থী লোকজন এরা আবার নিজেরা বেশ নারীবাদী নারীবাদী শ্লোগানও দেয়, আর এর ফলে শেরিল স্যান্ডবার্গ তিনিও বেশ একটা নারীবাদী আইকনে যেন পরিণত হয়েছে। এইটা তো ঠিক পছন্দ করার মতো ব্যাপার না আরকি।
কেন?
কিছু লোকজন তো আছেই যারা মনে করেন যে সংসদে যদি আরও বেশী বেশী নারী সদস্য থাকেন তাইলে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে বা বড় বড় কোম্পানির বোর্ডরুমে যত বেশি নারীরা থাকবেন ততোই নারীর প্রতি সমতা নিশ্চিত হবে বা যত বেশি নারী মন্ত্রী হবে বা সরকার প্রধান হবে তত বেশি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে ইত্যাদি। ওদের কথা যে একদম বাজে কথা সেটা তো নয়। সংসদে আরও অনেক নারী সদস্য থাকা প্রয়োজন। কিন্তু পুরুষদের মনোনীত, পুরুষতন্ত্রের নিয়ম মেনে, পেটের মধ্যে নারীবিদ্বেষ পুষে রেখে যিনি সংসদ সদস্য হবেন, তিনি নারী হলেই কী আর পুরুষ হলেই কী! তাতে বরং অনেক সময় লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। ধরেন পার্লামেন্টে একজন এমপি যদি বলেন যে, মেয়েরা ছোট ছোট কাপড় পরে বাইরে যায় বলেই দেশে ধর্ষণ হয়, তাইলে আপনি তার প্রতিবাদ করবেন। কিন্তু কথাটা যদি একন নারী এমপি বলেন তাইলে আপনার প্রতিবাদের কাজটা কি একটু কঠিন হয়ে যায় না? অথবা নারী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করতে গেছেন আপনি, কারখানার সিইও যদি নারী হয় তাইলে কি তাতে আপনার কোন লাভ হবে? বাংলাদেশে তো মাঝের কিছু বিরতি বাদ দিয়ে গত ত্রিশ বছর ধরে সরকার প্রধান নারী, বিরোধী দলের নেতাও নারী। এখন তো স্পিকারও নারী। তাতে কি উত্তরাধিকার আইনে নারীর সমতার পক্ষে আমরা একটা পদক্ষেপও এগুতে পেরেছি?
(২)
না, কোম্পানিগুলির ডাইরেক্টর বা সিইও হতে হলে বা দেশের এমপি বা মন্ত্রী হতে হলে বা অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে নারীর জন্যে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে সেগুলি তো দূর করা দরকার। কিন্তু সেটা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে যেন নারীর প্রতি বৈষম্য দূর হয়। একজন বা দুইজন নারীকে ক্ষমতাবান করে নারীর কোন লাভ নাই বা বঙ্গভবনে বা হোয়াইট হাউজে একজন নারী অধিষ্ঠিত হলেও নারীর কোন লাভ নাই বা বিশ্বের বড় বড় কর্পোরেশনগুলি সবগুলির প্রধানও যদি নারীদেরকে করে দেন, তাইলেও নারীদের কোন লাভ নাই। আপনি লিন ইন করেন, কর্পোরেট ক্যারিয়ার আপনার সফল হোক, আপনি বহুত টাকা কামাইতে থাকেন, আপনাকে অভিনন্দন। কিন্তু মেহেরবানী করে আপনার ব্যক্তিগত সাফল্যকে নারীর সাফল্য বলে চালাতে আসবেন না।
নারীর সংগ্রাম বড় কোম্পানির বোর্ড রুমে বসার জন্যে সংগ্রাম নয়। নারীর সংগ্রাম খুবই সোজা, বৈষম্য থেকে মুক্তির সংগ্রাম আর সমতার জন্যে সংগ্রাম। আর এই বৈষম্য কেবল সাংস্কৃতিক বৈষম্য নয় বা এই সমতা মানে আলগা আলগা সামাজিক আচার আচরণে সমতা নয়। বৈষম্য দূর করা মানে সমাজের সকল পর্যায়ে বৈষম্য দূর করা- সেটা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সকল পর্যায়ে অংশগ্রহণের বৈষম্য থেকে শুরু করে সমাজের সকল পর্যায়ে সমাজের সকল কর্মকাণ্ডে এবং সমাজের সকল সুবিধা ভোগ করার ক্ষেত্রে এবং সমাজের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নিয়ামক ভূমিকায় অংশগ্রহণের সুযোগে বৈষম্য। সকল বৈষম্য দূর করার সংগ্রামই হচ্ছে নারীর সংগ্রাম। এটাকে এবার আপনি নারীবাদ বলেন, অথবা অন্য যেকোনো নামেই ডাকেন, এইটাই নারীর সংগ্রাম। এবং নারীর সংগ্রাম কেবল নারীর জন্যে সমতা অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, নারীর সংগ্রাম সকলের জন্যে সমতা অর্জনের সংগ্রামের সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত।
আপনাদের মনে থাকবে ডমিটিলা চুঙ্গারার কথা। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সনে আন্তর্জাতিক নারী দশকের সূচনায় মেক্সিকোতে একটা নারী সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে আমেরিকা ইউরোপ থেকে নারীবাদীরা গেছেন। অন্যান্য দেশ থেকেও গেছেন। বলিভিয়া থেকে এসেছেন খনি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের নেতা ডমিটিলা চুঙ্গারা। ডমিটিলা চুঙ্গারাও নারীবাদী হিসেবেই পরিচিত বটে, কিন্তু তাঁর নিজের সংগ্রাম ও আন্দোলনের ক্ষেত্রটা ছিল বলিভিয়ার খনি এলাকায় শ্রমিক আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের অধিকার আদায় করা এবং নারীদেরকে সংগঠিত করে লা পাজের রাজপথে প্রত্যক্ষ শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা। ডমিটিলা সেখানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে খুব চাঁছাছোলা স্পষ্ট ভাষায় বললেন, পুরুষদের মতো মদ খাওয়া, বিড়ি খাওয়া আর লাম্পট্য করার সমান অধিকারের সংগ্রাম আমার সংগ্রাম নয়। আমার সহযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা আমার প্রথম কাজ নয়। আমার প্রথম কাজ হচ্ছে আমার সহকর্মীদের সাথে মিলে, অর্থাৎ পুরুষের সাথে মিলে সমাজ বদলের সংগ্রাম অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়া এবং এমন সাম্য তৈরি করা যেখানে আমরা পরস্পরের জন্যে বাঁচবো, আর যেখানে নারী ও পুরুষ দুইই জীবনের অধিকার, কাজের অধিকার আর সংগঠনের অধিকার উপভোগ করবো।
(৩)
ডমিটিলা চুঙ্গারা খুব স্পষ্ট করেই বললেন, ‘১৯৪৮ সনে পৃথিবীর সকল দেশ একসাথে মিলে জাতিসংঘ তৈরি করেছে। সেখানে মানবাধিকারের জন্যে নানারকম আইন তৈরি হয়েছে, এইরকম একটা আইন নারীদেরকে অধিকার দিয়েছে মানুষ হিসাবে সকল বিষয়ে অংশগ্রহণ করার জন্যে। কিন্তু সেই ১৯৪৮ থেকে আজ পর্যন্ত কোন সরকার কি সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্যে কোন শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা উৎসাহের ব্যবস্থা করেছে? কেউ করেনি। যারা কিছু কিছু আইন করেছে সেগুলি করেছে যাতে করে তারা নারীকে বিশেষ কোন শ্রেণী বা বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলের জন্যে ব্যবহার করতে পারে। এরপর ওরা নারীদের কথা ভুলে যায়। একজন নারী ওদের কাছে যেন এক টুকরা ন্যাকড়া, নোংরা টেবিল পরিষ্কারের জন্যে ন্যাকড়াটা ব্যবহার করে এক কোনায় লুকিয়ে রাখা হয় যতক্ষণ না সেটা আবার ব্যাবহারের জন্যে দরকার হয়। ওরা আমদেরকে এইভাবেই ব্যবহার করে আর আমরাও ওদেরকে সুযোগ দিই যেন ওরা আমাদেরকে এইভাবে ব্যবহার করতে পারে। আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কী চাই, কেননা নারীরা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে লড়ছে নানা কায়দায় নানা ধরনের মুক্তির জন্যে নানান কারণে।‘ (হুবহু অনুবাদ নয়)।
এইটাই হচ্ছে নারীর সংগ্রামের মূল চেতনা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং একই দেশে ভিন্ন ভিন্ন সমাজে নারীরা লড়ছে ভিন্ন ভিন্ন পথে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নে। কিন্তু সকলের যে সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু, সেগুলি যদি দেখেন, তাইলে দেখবেন যে সকলের লড়াইয়ের মূল কারণ একটাই- নারীকে নিতান্ত নারী বলেই একটা বাড়তি বৈষম্যের শিকার হতে হয়। মনে করেন একজন কারখানা শ্রমিক। সে তো শ্রমিক হিসাবে একটা শোষণের শিকার হয়, সেই সাথে আবার নারী বলে ওকে একটা বাড়তি বৈষম্যের শিকার হতে হয়। তাইলে নারী শ্রমিকের সংগ্রামের ক্ষেত্র হয়ে যায় দুইটা- প্রথমত শুধু শ্রমিক হিসাবে, দ্বিতীয়ত একজন নারী হিসাবে। এবং একজন নারী শ্রমিকের বঞ্চনার ব্যাপ্তি যদি কাছে থেকে নিয়ে বিবেচনা করেন, তাইলে দেখবেন যে কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ হিসাবে যে নারীটি কাজ করে তার শোষণ ও বঞ্চনার সাথে একজন নারী শ্রমিকের শোষণ ও বঞ্চনা অনেকখানিই মিলে যাবে।
এই দুইটা বৈষম্য, শ্রমিক হিসাবে শোষিত হওয়া আর নারী হিসাবে বঞ্চিত হওয়া, এর কোনটাই বিনা সংগ্রামে দূর হবে না। কেবল বোর্ড রুমে নারীর উপস্থিতি বাড়িয়ে হবে না। বোর্ড রুমে দুইজন নারী বাড়তি হলে বোর্ড রুমের গ্ল্যামার বাড়তে পারে, কিন্তু নারীর প্রতি শোষণ ও বঞ্চনা হ্রাস পাবে না। অথবা সংসদে নারীদের পাঁচটি সংরক্ষিত আসন বাড়িয়েও লাভ হবে না। দূর করতে হবে বৈষম্যের মূল কাঠামো। সেই সংগ্রামে শ্রমিক নারী, এক্সিকিউটিভ নারী আর সিনেমার নায়িকা নারী এদের সকলের সংগ্রাম এক, শত্রু এক, মুক্তির পথও এক ও অভিন্ন।
(৪)
ওরা আপনাকে বলবে যে, না, হিলারি ক্লিনটন বা ঐরকম কেউ প্রেসিডেন্ট হলে আমেরিকার নারীরা বিশাল অগ্রসর হয়ে যাবে। প্রশ্ন করবেন, কীভাবে? এর কোন উত্তর নাই। ও ভাই, স্বাধীনতা জিনিসটা তেল না বা টাকা পয়সা না যে ট্রিকল ডাউন ফর্মুলায় কাজ করবে। ট্রিকল ডাউন ফর্মুলা জানেন তো? রোনাল্ড রিগ্যানের সময় এই অর্থনৈতিক তত্ত্ব দেওয়া শুরু হয়েছে। বলে কিনা, দেশের বৈষম্য দূর করার দরকার নাই। বড় বড় কোম্পানিগুলি যাতে বেশি বেশি টাকা বানাতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। তাইলে ঐ বড় কোম্পানিগুলির হাত থেকে কিছু টাকা তো ট্রিকল ডাউন হবে বা চুইয়ে চুইয়ে পড়বে, তাতেই দেশের বাকি মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে। ঐ লিন ইন নারীবাদীরা হচ্ছে সেই ফালতু ফর্মুলার লোক, যেন অগ্রসর সুবিধাভোগী নারীদেরকে বড় বড় কর্পোরেশনের সিইও বানালে বা প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টার বানালে নাকি নারী স্বাধীনতা চুইয়ে চুইয়ে পড়বে, আর তাতেই নারীমুক্তি হয়ে যাবে।
এইসবই হচ্ছে ফালতু বাত। সমাজ বদলের লড়াইকে বিলম্বিত করা ছাড়া এইসব লিন ইন আর ফিন ইন এগুলিতে নারীর মুক্তি হবে না। এইগুলি নারীবাদী সংগ্রাম নয়- আসলেই এইগুলি কোন সংগ্রামই নয়। শ্রমিক নারীদের বাদ দিয়ে কোন নারীবাদী সংগ্রাম হতে পারে না।