প্রিয়াঙ্কা দাস মিলা:
মা-বাবা বুড়ো হয়ে গেছে, সংসারের কাজ করতে পারে না, তাই ছেলেকে বিয়ে করাও। বউ মরে গেছে, সংসারের কাজ কে করবে, বাচ্চা কে দেখবে? আবার বিয়ে করো। মায়ের বয়স হইছে, একা একা ভালো লাগে না, একটা বউ থাকলে সময় ভালো কাটতো! নাতি-নাতনির মুখ দেখতে চায় নানা বা নানী, ছেলে বিয়ে করাও— এগুলো হলো কমন কারণ আমাদের দেশে পুরুষদের বিয়ে করার। অতঃপর বউ শাশুড়ির ঝগড়া, বউয়ের বা মায়ের নালিশ, সংসারের অশান্তি, ডিভোর্স পর্যন্ত গড়ায় এর ফলাফল! আমাদের দেশের বেশিরভাগ পুরুষ মা এবং বউয়ের মাঝে ব্রিজ হতে পারেন না। হয় এসপার না হয় ওসপার! ফলাফল ডিপ্রেশন, পরকীয়া! আরেকটা ব্যাপার ঘটে কিছু সংসারে, মা/বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে দেয়া।
আমাদের দেশের বৃদ্ধাশ্রম একেকটা এতিমখানা। একবার যদি এখানে কাউকে রেখে আসে, ভুলেও সন্তান আর ওমুখো হয় না, যতক্ষণ না সে নিজে সেখানে আবাস গড়ে তোলে। অনেক সন্তান তো চি্রবিদায় পর্যন্ত নিতে যায় না! মজার ব্যাপার হচ্ছে, সব দোষ এসে পড়ে ‘ছেলের বউয়ের’ ঘাড়ে! যাই হোক, যা বলতে চাচ্ছিলাম, বৃদ্ধাশ্রম ব্যাপারটাকে একটু অন্যভাবে দেখি আসুন।
ইদানিং ইয়াং মেয়েদের অনেক ট্যুর গ্রুপ হয়েছে। মেয়েরা বিভিন্ন জায়গায় চলে যায় এডভেঞ্চারে। আমার সুযোগ হয় না কখনও এসব গ্রুপে এটেন্ড করার। কিন্তু আমার ইচ্ছা হলো, যদি বেঁচে থাকি, সুস্থ থাকি, বয়োজ্যেষ্ঠ নারীদের একটা গ্রুপ করবো। মাসে দুই-তিন বার বিভিন্ন জায়গায় ট্যুর দিবো।এখন চাইলেই যেতে পারি না। চাকরি, সংসার, সন্তান, দায়িত্ব— নিজের জন্য সময় নাই। একটা সময় আমি রিটায়ার করবো, বাচ্চারা বড় হবে, যার যার আলাদা সংসার হবে, নিজের সংসার বলতে আমরা টোনাটুনি থাকবো। হয়তো আমি থাকবো না, হয়তো আমার পার্টনার থাকবে না, যেই থাকবো, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেঁচে থাকবো। মাসে একদিন বা দুইদিন আমিও নাতি/নাতনিকে দেখতে তাদের বাড়ি যাবো, কিংবা ওরা আসবে। সাধ্যমতো যত্ন করবো। উইল করে সব সম্পত্তি ওদের নামে দিয়ে দিবো। এটা অন্তত আশা করি না, সকালে উঠে আমার ছেলের বউ আমার জন্য নাস্তা বানাবে বা রান্না করবে, তারপর আমি খাবো, নাইলে আমি বউয়ের নামে চুগলি করবো কিংবা ছেলের স্ত্রী আমার উপর বিরক্ত হয়ে আমাকে অন্য কোথাও রেখে আসতে বলবে!
কিংবা মা কিংবা স্ত্রী দুজনের মধ্যে যেকোনো একজনকে আমার ছেলেকে বাছাই করতে হবে! আমার জন্য তারা তাদের পারসোনাল লাইফ ত্যাগ করবে! বৃদ্ধ মা- বাবাকে বাসায় রেখে চাইলেই কি বাইরে ঘুরতে যাওয়া যায়? ক’জন যায়? এজন্যই আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভালবাসাবাসি হয় না, নিজেদের মধ্যে ইন্টিমিসি হয় না। ৫/৭/১০ বছর প্রেম করে বিয়ে করার পরও ২/৩ বছর পর ডিভোর্স হয়ে যায়! অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটাও একটা কারণ।
বয়স্ক মানুষ একাকিত্বকে ভয় পায়। তারা হয়ে যায় শিশুদের মতো, এজন্য তারা চায় তাদের প্যাম্পার করা হোক। এতো এতো দায়িত্বের ভিড়ে কখন আপনি আলাদা দায়িত্ব পালন করবেন? সারাদিন অফিস করে বাসায় আসার পর স্বাভাবিকভাবেই মন চাইবে আরাম করতে, তখন যদি আপনার বুড়ো মা-বাবা বলে তাদের সাথে গল্প করতে, কতোক্ষণ ভালো লাগবে আপনার?
কিন্তু ভাবুন তো, তাঁরও যদি একটা গ্রুপ থাকতো, যেখানে সে আড্ডা দিচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে। তার ভালোও লাগছে, ভালো লাগাটাই স্বাভাবিক। ছোটবেলার মতো, যেখানে তাঁর কোন দায়িত্ব নেই, কিন্তু শখ পূরণের সুযোগ আছে। বাগান করছে, কিংবা বই পড়ছে কিংবা জেলায় জেলায় ঘুরছে, আবার যদি সে কিছু উপার্জন করতে পারছে সেখান থেকে আপনাকে গিফট পাঠাচ্ছে, ব্যাপারগুলো কি এতোই খারাপ হবে?
আমাদের দেশে একটা নির্দিষ্ট সময় পর মা-বাবা বিশেষ করে বাবাও সন্তানের উপর আর্থিকভাবে ডিপেন্ডেন্ড হয়ে পড়ে, কারণ যৌবনের কষ্টার্জিত সমস্ত অর্থই তারা সন্তানের পিছনে ব্যয় করে নিঃস্ব হয়ে যায় একপ্রকার। এখন সময় এসেছে সন্তানের মা-বাবার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করার। আমি যখন আমার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবো তখন আমার মা/বাবা কিংবা মা-বাবা যেন অনাথ হয়ে না যায়, তাদের যেন আমাদের উপর ডিপেন্ডেন্ড হয়ে বেঁচে থাকতে না হয়। শুধুমাত্র আমার জন্ম দেয়া সন্তানকে দেখাশোনা করার জন্য কিংবা আমার বাসা-বাড়ি সুরক্ষিত করার জন্য আমরা না চাই, ‘আমার মা-বাবা হাজার বছর বেঁচে থাকুক’। তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন শেষে যেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়তে পারে আসুন আমরা সেই ব্যবস্থা করি। আমরা ভালোবাসার বাড়ি বানাই, যেখানে মা- বাবারা তাদের যৌবনকাল ফিরে পাবে। সংসারে বউ-শাশুড়ি একে অন্যের উপর অপবাদ দেয়া থেকে মুক্তি পাবে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার ছেলেকে বিয়ে দিয়ে আলাদা সংসার করতে বলবো। যেখানে আমার ছেলের স্ত্রী তার সংসার তার নিজের মতো করে সাজাবে।যেখানে আমার মতো তারাও টোনাটুনির সংসার করবে। তারা নিজেরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবে। আমাদের সম্মান করবে। সমাজের রক্তচক্ষু কিংবা অপমানকে উপেক্ষা করার জন্য আমার ছেলের স্ত্রী আমার বা আমার পার্টনারের সেবা করবে না। আমাকে ভালোবেসেই আমার সেবা করবে। সর্বোপরি আমাকে আমার সন্তানের উপর মানসিক বা আর্থিক কোনভাবেই যেন নির্ভর করতে না হয় সেই ব্যবস্থা আমরাই করি। নিজেদের ভালোবাসি, অন্যকে ভালোবাসি। নিজেকে সম্মান করি, অন্যকে সম্মান করি।