মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের বাবারা

সোনিয়া সরকার জয়া:

বাবা-সন্তানের সম্পর্কভিত্তিক তৈরি সিনেমা নিয়ে আলোচনা উঠলে আটটা মুভির কথা মনে পড়ে সবচেয়ে বেশি। এরমধ্যে প্রথম সাতটা নিয়ে বাবা দিবসেও কথা হয় অনেক, কিন্তু পরেরটা নিয়ে তেমন একটা না। কারণ প্রথম সাতটা মুভিতে তুলে আনা হয়েছে-

১/ দীপু নাম্বার টু- ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের লেখা এই গল্পে উঠে এসেছে মা চলে যাওয়ার পর একা হাতে ছেলেকে সুশিক্ষা দিয়ে বড় করা একজন দায়িত্বশীল সিঙ্গেল ফাদারের গল্প।

২/ Life is Beautiful- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এক বাবার গল্প যে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কনসেনট্রেশান ক্যাম্পের সব নির্যাতনকে সন্তানের কাছে খেলা হিসেবে ব্যাখ্যা করে গিয়েছিলো।

৩/ Miracle in cell no 7- মিথ্যা মামলায় ফেঁসে যাওয়া কিছুটা বুদ্ধি বৈকল্যে ভোগা এক বাবার কাছে জেলখানার সব নিষেধ ভেঙেও সন্তানকে কাছে নিয়ে আসার গল্প।

৪/ No Mercy- আত্মস্বীকৃত খুনিকে নির্দোষ প্রমাণের শর্তে মেয়েকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাওয়া এক ডাক্তার বাবার অসহায়ত্বের গল্প

৫/ The Pursuit of Happyness- চরম অভাব, দারিদ্রতার মাঝেও সন্তানকে আগলে রাখা বাবার গল্প

৬/ Dangal- পুত্র সন্তান না হওয়ার হতাশা চেপে নিজের স্বপ্ন কন্যাদের মাধ্যমে পূরণ করা কুস্তিগির বাবার লড়াইয়ের গল্প

৭/ Train to Busan- মৃত্যুকে নিজের শরীরে ধারণ করেও শেষ পর্যন্ত সন্তানকে বাঁচিয়ে দেয়া আরেক সিঙ্গেল ফাদারের গল্প।

এই সাতটা গল্পের বিপরীতে আছে আট নাম্বার মুভিটি:

৮/ Paa- দেশ আর রাজনীতির প্রতি অতিমাত্রায় ডেডিকেটেড হতে গিয়ে নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রতি অশ্রদ্ধা ও ঔরসজাত সন্তানকে মায়ের গর্ভেই এবরশন করতে চাওয়া এক দায়িত্বজ্ঞানহীন বাবার গল্প।

এই মুভিতে বাস্তব জীবনের বাবা ছেলের এবং ছেলে বাবার চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় দক্ষতার কারণে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অর্জন করে নেন অমিতাভ ও অভিষেক বচ্চন। নিখুঁত মেকআপ, ১২ বছরের প্রোজেরিয়া আক্রান্ত অরো চরিত্রে অমিতাভের দুর্দান্ত অভিনয় শৈলী, বিদ্যা বালানের চমৎকার দায়িত্বশীল পরিচয় নিয়ে অন্যরকম একটা প্লটে দাঁড় করানো হয়েছে এই সিনেমাটিকে। প্রাচীন ধ্যান-ধারণা বাদ দেয়া নিজের মায়ের সহযোগিতায় সমাজের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে অবিবাহিত অবস্থায় সন্তান জন্ম দেয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত ও প্রোজেরিয়ান সন্তানের দায়িত্ব পালন করা আরেক লড়াকু মায়ের গল্পটাই এখানে উঠে আসে বারবার। কিন্তু এসব সম্পর্ক থেকে দূরে রয়ে যাওয়া বা আড়ালে থাকা অভিষেক যার বলা একবার স্যরি আর নিজের প্রাক্তন ও সন্তানের মাকে বিয়ে করতে চাওয়ার কারণে মৃত্যুশয্যায় থাকা সন্তান শেষ পর্যন্ত ‘পা’ ডেকে তাকে বাবার স্বীকৃতি দিলেও ওই চরিত্রটাকে আসলেই “বাবা” বলে সম্বোধন করা যায় কিনা এই প্রশ্ন আমার মনে প্রায়ই জাগে।

সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখতে না দেয়া, মায়ের গর্ভেই ভ্রূণ হত্যা করা, জন্মের পর থেকে কখনোই সন্তানের মুখ না দেখা, নিজের সন্তানকে স্বীকার না করা, পিতৃ পরিচয় না দেয়া, সন্তানের জেন্ডার বিবেচনা করে তার প্রতি অবজ্ঞা পোষণ করা, ৪/৫ কন্যা ও তাদের মায়ের প্রতি ঘৃণা থেকে পুত্র সন্তানের আশায় আবার বিয়ে করা, সন্তানের সামনে পরকীয়া করা, সন্তানের ভুলে পাশে না থেকে তাকে ত্যাগ করা এমনকি পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে অনার কিলিং এ জড়িত থাকা অকৃতজ্ঞ পুরুষদের সর্বোচ্চ স্পার্ম ডোনার বলা যায় কিন্তু বাবা নামের অমূল্য শব্দে কী অভিহিত করা যায় আদৌ?
অবশ্যই না।

কারণ বলা হয় মা যখন গর্ভে ধারণ করেন তখন আবেগ-স্নেহ-মমত্ব-দায়িত্ব নিয়ে বাবা সন্তানকে ধারণ করেন হৃদয়ে ও মস্তিষ্কে। এই ধারণ করার জায়গায় গিয়ে ব্যর্থ হওয়া, সজ্ঞানে কেটে পড়া জন্মদাতাদের সংখ্যা এই পৃথিবীতে নেহাতই কম নয়। পুরুষত্বের অহংকার বজায় রাখতে সন্তান জন্মদানে অক্ষম পুরুষও আছে অনেক যারা স্ত্রীর ঘাড়ে ইনফার্টিলিটির দোষ চাপিয়ে নিশ্চুপ থাকে আজীবন। আবার অন্যের সন্তানের খাদ্যে বিষ মিশিয়ে দিয়ে, অধিকার নষ্ট করে, অর্থ পাচার, ঋণ খেলাপ বা শেয়ার বাজার লুটপাট করে নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে চাওয়া বাবারাও কিন্তু এখানে সংখ্যায় অসংখ্য।

কিন্তু এসবের বিপরীতের থাকা বাবাদের উদাহরণও আছে প্রচুর। পালিত শিশু কন্যার ধর্ষণের বিচার না পেয়ে তাকে নিয়ে ট্রেনের নিচে জীবন দিয়ে দেয়া বাবাটার গল্পও আমার মনে পড়ে। ডা. শামারুখ, ফেলানি, তনু, রিশাদের বাবাদের অসহায় আর্তনাদগুলোও প্রতিনিয়ত কানে বাজে। মনে আসে সন্তানকে নিজের কিডনি দিয়ে দেয়া বা মা হারা দুই ডাউন সিনড্রোম ও এক শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়েকে একা হাতে মানুষ করা বাবাদের গল্পগুলোও। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে কখনোই পিতৃত্বের স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে না জেনেও এতিম, অনাথ শিশুদের দিকে ভালোবাসাময় হাত বাড়িয়ে, সব কর্তব্য পালন করে সেই বাচ্চাটার সাথে সাথে নিজের অন্তরেও একজন পিতাকে লালন করতে শেখা মানুষগুলোর কথাও। পূর্ণ দায়িত্বের সাথে দায়িত্বহীন আচরণ করা পুরুষদের ভীড়েও এসব দেবদূতের মত বাবারা আছেন বলেই হয়তো পৃথিবী এখনো এতোটা আলোকিত।

এই বাবাগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর বছরের প্রতিটা দিনই বাবা দিবসের শুভেচ্ছা।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.