আপনি কি সৌন্দর্য ও শরীর নিয়ে চিন্তিত?

দিনা ফেরদৌস:

জন্মের পর থেকে ধাপে ধাপে বাড়ে আমাদের বয়স। একটি নবজাতক দেখলে যেমন এক রকম ভালো লাগে, তেমনি আধো আধো কথা বলা বাচ্চাটিকে দেখলেও অন্যরকম ভালো লাগে। সেই শিশুটি যখন টিন এজে পৌঁছায় তখন তার চলন, বলন, ফ্যাশন সব মিলিয়ে তাকে অতুলনীয় লাগে। কথায় বলে, “যৌবনকালে কাকও দেখতে সুন্দর লাগে “। সেই ছেলে/মেয়ে যখন কলেজ পেরিয়ে ইউনিভার্সিটি লেভেলে যায়, তখন শুধু শারীরিক সৌন্দর্য দিয়েই নয়; তার সাথে মেধা, বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব সব মিলিয়েই তার সৌন্দর্য মাপা হয়। মেধাবী ছেলে/মেয়েকে সবাই আলাদাভাবেই দেখে। সময় গড়ায়, বিয়ে হয়, সন্তান হয়, পারিবারিক দায়িত্ব বাড়ে, স্বাভাবিকভাবেই আগের চেহারা বা শারীরিক সৌন্দর্য একই জায়গায় বসে থাকে না।

ঠিক এই জায়গাটায় এসে পুরুষদের থেকে নারীদের বাহ্যিক সৌন্দর্যে একটু ভাটা পড়ে। কারণ বাচ্চা জন্মদানের কারণে একজন নারীর উপর দিয়ে কঠিন ধকল যায়। কারও কারও শরীর ভারী হয়ে যায় খুব, কারও সেইসময় ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, কারওবা থাইরয়েড, রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গিয়ে নানাধরনের জটিলতা দেখা দেয়। যার ফলে ওষুধ সেবনের পাশাপাশি খাদ্য তালিকায়ও বিশেষ পরিবর্তন আসে। যা কোন পুরুষকে সাফার করতে হয় না শারীরিকভাবে। তাই বলে পুরুষদের পরিশ্রম বা দায়িত্ব কোন অংশেই কম নয়। তাদের শারীরিক কারণে না হোক, যখন থেকে একজন পুরুষের ঘাড়ে পুরো পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে তখন ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়ানোর সময় যে চাকচিক্য থাকে, তা আর পাওয়া যায় না । ভুঁড়ির আয়তন বাড়তে থাকে, মাথায় টাক পড়তে থাকে, চুল দাঁড়িতে পাক ধরে, স্কিন লুজ হতে থাকে। আর মানসিক টেনশন তো আছেই। তবে বেশিরভাগ পুরুষই এইসব কেয়ার করেন না। যারা করেন, তাদের কেউ কেউ চুল দাড়িতে রঙ করেন, কেউ উইগ পরেন, কেউবা ইন ছাড়া ঢিলেঢালা টি-শার্ট পরে ক্রমবর্ধমান ভুঁড়িটি আড়াল করেন।

সেই জায়গাটাতেই এসে কঠিন সমস্যায় পড়েন সাধারণ নারীরা (বিশেষ যারা তারা সবসময়ই বিশেষ, তারা জানেন কীভাবে নিজেকে ঠিক রাখতে হয়) । বিশেষ করে চল্লিশের কাছাকাছি এসে যখন দেখেন চেহারায় আগের মতো গ্লো নেই, স্কিন লুজ, ব্রেস্ট ঠিক আগের মতো শেইপে নেই, তলপেটে জমেছে চর্বি ; তখন হীনমন্যতায় ভুগতে থাকেন। কেউ কেউ লজিকও বানিয়ে ফেলেন, স্বামীর বয়স থেকে কখনই স্ত্রীর বয়স বেশি হওয়া ভালো না, আগে বুড়ি হয়ে গেলে পরে স্বামী দাম দিবে না। কেউ বলেন, বেশি বয়সী বরকে বিয়ে করলে ভালো, সব সময় কচি বউকে মূল্য দিবে। তারাই আবার বলেন, কম বয়সী মেয়েদের বেশি বয়সের পুরুষ বিয়ে করলে, কলকব্জা দুর্বল হয়ে গেলে বউ চলে যাবে। কেউ কেউ বলেন, পাশাপাশি বয়সের হওয়া ভালো, একজন আরেকজনের ভাষা বুঝবে। তারাই আবার বলেন, পাশাপাশি বয়সের হলে বউ আগে বুড়িয়ে যাবে। এইসব বাছবিচার তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই করেন, যা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, অযৌক্তিকও বটে। তার আগে নিজেকে বোঝাতে হবে, বয়স সব সময় এক জায়গায় বসে থাকে না, তা যাকেই বিয়ে করেন। বয়স চলে তার নির্দিষ্ট ছকে।

বয়সের সাথে সাথে শারীরিক পরিবর্তন অবধারিত। বুঝতে হবে প্রতিটি বয়সের সৌন্দর্যই আলাদা। বরং আমরা যখন যে বয়সে পৌঁছাবো তাকে যদি সময় থাকতে সাদরে গ্রহণ করতে পারি নিজের চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে; তবে সেই সৌন্দর্যকে আশেপাশের মানুষজনও গ্রহণ করবে একইভাবে। বেশিরভাগ নারী তা না করে ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেন। কোন সুন্দরীকে দেখলে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বি বানিয়ে ফেলেন। খামোকা স্বামীকে সন্দেহ করেন (কেউ কেউ যে সন্দেহের মতো কাজ করেন না, তা নয়)। ভারতীয় চল্লিশোর্ধ নায়িকার ফিগার বা বুকের সাইজ দেখে নিজে হীনমন্যতায় ভোগেন। এই জায়গাটায় বলবো একটু ভাবুন তো, আপনি কি জীবনেও ভেবেছেন যে ফিগার মেইনটেইন করে চলবেন? আর এতোদিন সংসার করার পরে যদি মনে হয় শুধুই শরীরের জন্যেই স্বামীর কাছে মূল্য পেয়েছেন; তাহলে বুঝতে হবে আপনার নিজের কোন ব্যক্তিত্ব নেই, ভালোবাসা নেই আপনাদের মধ্যে। আপনার জন্যে করুণা রইলো শরীরের বাইরে নিজের আলাদা কোন অবস্থান তৈরি করতে না পারার জন্যে।

মোটেও এই ভুলটি করবেন না। বিশ্বাস করুন, যেই নায়িকাকে দেখে আফসোস করছেন সেই নায়িকা আপনারই মতোই। তার পেশা শরীর দিয়ে, সে এর যত্ন নেবে, সে যখন পাবলিকের সামনে আসবে, তখন সেইরকম সেজেই আসবে যাতে তার সৌন্দর্যের ঘোর ভক্তদের চোখে, হৃদয়ে জায়গা নিয়ে থাকে। তার স্বামীই জানেন তার আসল ফিগারের অবস্থা। যার ফলে দেখা যায় মহানায়িকা ‘সুচিত্রা সেন’ শেষ সময়ে এসে আর নিজের চেহারাই দেখাবার সাহস করেননি। চেয়েছেন সেই একই চেহারার ইমেজ নিয়ে ভক্তকুলের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখতে। আর যেইসব নায়িকাদের উন্নত বুক দেখে নিজের সঙ্গে তুলনা করে হীনমন্যতায় ভোগেন, তারা কেউই ব্রা ছাড়া আসেন না। পুশআপ বলে এক ধরনের ব্রা আছে, যা ব্রেস্ট’কে নিচ থেকে উপরের দিকে চাপ দিয়ে রাখে, ফলে ষাটোর্ধ্ব কোন নারীও যদি এটা ব্যবহার করেন, তো সুন্দর না লেগে উপায় নেই। তাই এইসব নিয়ে চিন্তা করাটাই বোকামি। এই ভুলের ফলে অনেক নারী কঠিন গরমের মধ্যেও ফোমের ব্রা পরে থাকেন সারাক্ষণ। ফলে বাতাস পাস না হয়ে এবং ময়েশ্চারাইজ না থাকার কারণে দ্বিগুণ ক্ষতি হয়। অনেক সময় ব্রেস্ট লুজ হয়ে যাওয়ার এটাও একটা কারণ, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক না হওয়ার জন্যে।

দিনা ফেরদৌস

সাধারণত চল্লিশ পার হওয়ার পর বা পঞ্চাশের দিকে মেনোপজ হয়। পুরো এক বছর ধরে যদি পিরিয়ড না হয়, তবে বুঝতে হবে মেনোপজ হয়েছে। এইসময় কারো কারো হাড়ের ব্যথা হয়, ঘুম কম হয়, মেজাজ খিটখিটে হয়, ওজন বাড়ে। এই সময়টা অনেক নারীই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন না। কথা প্রসঙ্গে নিজের পিরিয়ড়ের বিষয়টি নিয়ে আসেন, মানে এখনো ফুরিয়ে যাইনি, এই ধরনের ভাব থেকে সেই প্রকাশ।
কথা হচ্ছে, ফুরিয়ে যাবার প্রশ্নই তো আসে না। বরং এই সময়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটা বাচ্চার মা চাইলেই যেকোনো সময় স্বামীর শারীরিক সম্পর্কে যেতে পারে না, বাচ্চাদের কথা ভেবে, বাচ্চারা ঘুমের পর, বাসার কাজ সামলে মা-বাবারা থাকে ক্লান্ত। এদিকে পঞ্চাশের পরে একজন নারী অনেক স্বাধীন। বাচ্চারা থাকে নিজেদের কাজেকর্মে ব্যস্ত, তাদের খাওয়া, ঘুম এইসব নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। বাচ্চারাও জানে যখন-তখন বাবা-মায়ের রুমে ঢুকে যাওয়া যায় না। ফলে স্বাধীনভাবে স্বামীর সাথে আরও বেশি সময় পাওয়া যায়, তার সঙ্গে একটু আত্মবিশ্বাস হলেই চমৎকার কাজ করে। এই আত্মবিশ্বাসটা অনেক নারীই ধরে রাখতে পারেন না, যার প্রভাব স্বামীর উপর গিয়েও পড়ে। কিছু কিছু নারী মনে করেন এই বয়সে এইসব আর কী, লজ্জা পান। অনীহা মাঝেমধ্যে থাকতেই পারে শারীরিক নানা কারণে। কিন্তু এই বয়সে এইসব আবার কী বলে যদি প্রতিদিনই এড়িয়ে যান, তবে মনে রাখবেন আপনি নিজের ক্ষতি করছেন। আপনার স্বামীর চাহিদা যদি থেকে থাকে, তবে তিনি তা যেকোনভাবে পূরণ করবেনই।

এখন যদি বলেন সমাধান কী? বলবো নিজের যত্ন নিন বেশি বেশি। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করুন, হাইট অনুযায়ী ওজন রাখার চেষ্টা করুন, হাঁটাচলা করুন, পারলে হালকা ব্যায়াম করা ভালো। নিজেকে কাজেকর্মে ব্যস্ত রাখুন। অথবা মনে আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে, আমি যেমন আছি তেমনি থাকবো, কে কী ভাবলো আর না ভাবলো তাতে কিছুই যায় আসে না। আমি মডেল না, সংসারী মানুষ, ফিগারের দরকার আমার নেই, তাহলে শান্তিতে থাকবেন। আর তা না হলে অন্যের ফিগার দেখে সারাক্ষণ জ্বলে পুড়ে মরতে হবে। স্বামীর সামনে সারাক্ষণ সুন্দরী মেয়েদের বদনাম খুঁজে এনে জড়ো করে বোঝাতে হবে, শরীর আগের জায়গায় না থাকলে কী হবে, আমিই দুনিয়ায় ‘সেরা সতী’ নারী। বাকি দুনিয়ায় যতো নায়িকা/গায়িকা/মডেল নিজের বান্ধবী থেকে শুরু করে পাশের বাসার হাঁটুর বয়সী সুন্দরী মেয়েটিকেও দুশ্চরিত্রা বানিয়ে সারাক্ষণ মনের মধ্যে এক প্রতিযোগিতা নিয়ে চলতে হবে। এটাকে বলে মিড-লাইফ ক্রাইসিস। অন্যের কোনকিছু দেখে নিজের ভেতরে খামোকাই শূন্যতা অনুভব করা। এ ফিগার বানিয়ে ফেললো, তার বর তাকে নিয়ে একটু বেশিই ন্যাকামি করে, ও সুন্দরী তাই সকলে গুরুত্ব দেয়। বিশেষ করে নিজের ভেতরে যা নেই, তা সারাক্ষণ জ্বালায় অন্যেরটা দেখে।

এতোক্ষণ যা বললাম তা আমার নিজের কাছ থেকে দেখা কিছু মানুষের সাথে চলে অভিজ্ঞতার আলোকে অর্জন করেছি। সবার এই ধরনের সমস্যা বা পরিস্থিতি আছে এমন না। যাদের নেই তাদের জন্যে শুভ কামনা রইলো। যাদের আছে, তারা একটু ভেবে দেখবেন। ভালো থাকুন সকলে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.