পরীমনি সিন্ড্রোমে ভুগছে সবাই

ফারদিন ফেরদৌস:

আমি পরীমনির মুভি দেখিনি, তাঁর অনুরাগীও নই। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যন্ত জনপ্রিয় Pori Moni ‘র লাইকারও আমি নই। তবে বিরানব্বই লাখ ফলোয়ারের মধ্যে আমার বন্ধু-বান্ধব স্বজন অনেকেই আছেন।

আচ্ছা একটা বিষয় খেয়াল করেন তো। পরীমনিতে যারা লাইকার, তারা ওঁর টাইমলাইনে কী দেখতে যায়? অথবা বলতে পারি কী লেসন পেতে যায়? স্বল্পবসনা এবং সাজসজ্জায় সজ্জিত নায়িকার হেলেদুলে দেয়া বিভিন্ন পোজের ছবি ছাড়া ওই টাইমলাইনে কিছু মেলে? তাহলে আমরা কিন্তু জানি এই নায়িকা কী করেন, কোথায় যান, কী খান এবং কারা তার বন্ধুস্থানীয়।

রাজায় রাজায় যুদ্ধবাজির ট্র্যাপে পড়ে উলুখাগড়ার প্রাণপাতের মতো এখন একটা দুর্বিপাকে পড়েছেন বলে সেই নায়িকার চারিত্রিক সনদপত্র আমরা দেয়ার অধিকার কেমনে রাখি? আমাদের ধারণা যদি এটাই হয় যে, মেয়েমানুষ মানেই কালো কাপড়ে অবগুন্ঠিত হয়ে ঘরে পড়ে থাকবে, রাতবিরাতে বাইরে যাবে না, নাভি বের করে ফেসবুকে ছবি আপলোড করবে না – তাহলে সবার আগে কী করা উচিত? ওই নায়িকার ফলোয়ার হওয়া থেকে নিজের নামটা কেটে দেয়া উচিত। মুমিনদের তো এটা করা ফরজে আইন। কারণ পৃথিবীর কোনো হিরোইনই পর্দা করে মুভি করতে নামবে না। ঘোমটা দিয়ে আর যাই হোক, অভিনয় হয় না। সিনেমার অভিনেত্রী নৃত্যপটিয়সী ও স্বল্পবসনা হবেন -এটাই চরম বাস্তবতা। ধর্মীয় ব্যারিয়ার তারা মানবে না এটা আমরা জানিই। তাহলে ওই নায়িকার টাইমলাইনে আমরা আসলে কী খুঁজতে যাই? কেন যাই?

বিরানব্বই লাখ ফ্যান ফলোয়ারের অধিকাংশই পরীকে গালাগাল করছে। মগজের কী যে এক দুঃসহ জ্বালা মেটাচ্ছে। ঘোষণা দিয়ে দিচ্ছে যে, চলচ্চিত্রে যারা অভিনয় করবে, ধর্ষণের শিকার হওয়াই তাদের পাপের নিদান। কী জঘন্য চিন্তা ও চেতনা। মুভির হিরোইনকে তারা ধর্ষণের শিকার হওয়ার শাস্তি লিখে দিচ্ছে। এমনকি কেউ কেউ পরীর ছবি নিজেদের টাইমলাইনে ছাপিয়ে বলে দিচ্ছে, রাইতের বেলায় যে নারী ক্লাবে যায়, তার পরিণতি এমনটাই হবে।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, তেমন কেউ নাসির ইউ মাহমুদ, তুহিন সিদ্দিকী অমি গং, মদের আখড়া ক্লাব কালচারের বিরুদ্ধে কথা বলছেন না। এমনকি একশ্রেণীর পিতৃতান্ত্রিক নারীও ওই নারীকে দোষারোপের বাইরে চিন্তা করতে পারছে না। এসব ক্লাবের হোমরাচোমরা যারা তাদের নিয়ে ‘টুঁ’ শব্দটি করছে না। ঘুরেফিরে কেষ্টাবেষ্টা চোরের মতো সব দোষ ওই পরীমনির। কারণ পরীমনি একজন মেয়ে, তার ওপর আবার চলচ্চিত্রের নায়িকা। এখন বেশ্যা, পতিতা, ধর্ষিতাসমেত যত পুরুষতান্ত্রিক মগজপ্রসূত শব্দবন্ধ আছে সবটাই পরীমনির জন্য প্রযুক্ত করা যায়।

আচ্ছা পরীমনি তাহলে এত্তো খারাপ? খারাপকে তো আমাদের এভয়েড করারই কথা। খারাপের সহবতে আমরাও তো খারাপ হয়ে যেতে পারি, তাই না?
অথচ বোটক্লাব ইনসিডেন্টের আগে পরীমনির ফেসবুক ফলোয়ার ছিল ৯০ লাখের অনেক নিচে। আজ সকালে ছিল ৯১ লাখ। আর এই লেখাটি লেখার সময় পর্যন্ত ৯২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আশা করছি আগামী সাতদিনেই কোটি স্পর্শ করবে।

এটা কী প্রুভ করে?
আমরা পুরুষরা জন্মগতভাবেই একেকজন নাসির ইউ মাহমুদ। এরমধ্যে দু’চারজন ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেয়ে নিজেদের শোধরাতে পারে, বাকিরা তলে তলে প্রায় সবাই যৌন অবসেশনে ভোগা নারীবিদ্বেষের গোঁসাই। এরা যেনতেনভাবেই নারীকে ফলো করে, নারীর রূপে যৌনকাতর হয় আবার সেই নারীকে পতিতা কল্পনায় গালিগালাজ করে অবদমন দূর করবার প্রয়াসী হয়।

গালাগাল ও নিন্দামন্দ এতোটা মাত্রা ছাড়িয়েছে যে বিবিসি বাংলা তাদের বোটক্লাব নিউজের সোশ্যাল মিডিয়া শেয়ারিং এর নিচে লিখে দিতে বাধ্য হয়েছে, কারো মন্তব্য যদি ঘৃণা, অপমান, আক্রমণাত্মক ও গালিগালাজ হয়, তবে আমরা সেটা ডিলিট করছি এবং অনেককে ব্যান করতে বাধ্য হচ্ছি। আশা করি আপনারা ব্যক্তিগত আক্রমণ, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও ভাষার ব্যবহারে সচেতন থাকবেন।

একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ও বিকৃতমনা মনুষ্যের ক্ষেত্রেই কেবল এমন নির্দেশনা জারি করতে হয়!

বাঙালি এখন এমন এক অদ্ভুত রোগেই ভুগছে। একেকসময় একেকজনকে তারা গালিগালাজ করবার সুযোগ পায়। এই এখন যেমন সবাই পরীমনি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত।

দেশে যদি
∆ প্রপার নৈতিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতো,
∆ যথার্থ ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চিত হতো,
∆ বিশুদ্ধ রাজনীতি চর্চার সুযোগ রাখা হতো
-তাহলে হয়তো প্রায় সর্বমানুষের এমন দুর্মর বাজে মোটিফ বা ইনটেনশনকে শোধরানো যেত। বর্তমান বাস্তবতায় অবশ্য সে আশা দূরাশা মাত্র।

মানুষের ব্যক্তিচরিত্র যেমনই থাক কেউ যখন নিপীড়ন বা শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়ে বিচারপ্রার্থী হয়, তখন সেই মজলুমের পক্ষে দাঁড়ানোই মানুষের কাজ। কাপুরুষ শয়তানের বন্দনা করতে গিয়ে নারীর প্রতি হিংসা উদ্রেক করবার নাম সভ্যতা নয়, ইথিক্স নয়। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ, অথচ আমরা ধর্মতত্ত্বের খোঁজটাও ঠিকমতো রাখি না। আমাদের প্রিয় রাসূলুল্লাহ (সা.)ও বলেছেন, মুমিন কখনো অশ্লীলভাষী, গালিবাজ ও কটু মন্তব্যকারী হয় না। (তিরমিযী, ১৯৭৭)

তাহলে আমরা কারা?
আমরা আমাদের নিজেদেরকে চিনতে পারছি তো?

ফুটনোট:
নারীকে পণ্য করে উপস্থাপন করবার মূল কারিগর ঘুরেফিরে ওই একজন পুরুষ। নারী সেই পুরুষতান্ত্রিকতার দাসানুদাস ক্রীড়নক মাত্র। তারপরও গালি খাওয়ার কপাল কেবল ওই নারীরই। এই অতল গহ্বর থেকে মুক্তির উপায় নারীকেই খুঁজতে হবে সচেতন হয়ে।

ফারদিন ফেরদৌস
লেখক ও সাংবাদিক

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.