কল্পিত আদর্শ নারী ও তার পরসমাচার; কেইস: পরীমনি

স্নিগ্ধা রেজওয়ানা:

গত চার-পাঁচ দিনের বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের সবচেয়ে আলোচিত খবর হচ্ছে চিত্রনায়িকা পরীমনি। তার অভিযোগ, তাকে ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ভীষণ অদ্ভুতভাবে মিডিয়া জগতে আলোচনার বর্তমান ট্রেন্ড হচ্ছে তার লাইফ-স্টাইল, ক্লাবে যাবার প্রসঙ্গ। গণমাধ্যমে এ-ও দৃশ্যত হয়ে চলছে যে চলচ্চিত্র সমিতির মুখপাত্র জায়েদ খান বা মিশা সওদাগর যত না পরীমনির সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার নিন্দা প্রকাশে তৎপর, তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী পরীমনির আচার-আচরণ, তার কী করা উচিত ছিল বা ছিল না, ক্লাবে যাওয়া সঠিক আচরণ ছিল কী ছিল না, অথবা আমরা মা-বোনকে কীভাবে দেখতে অভ্যস্ত, শিল্পী হিসেবে কী ধরনের আদর্শ জীবনাচার অনুসরণ করা প্রয়োজন, সেসকল বিষয়ে তারা অনেক বেশি ব্যতিব্যস্ত।

এটি খুব সহজেই অনুমেয় যে, কী কারণে চলচ্চিত্র সমিতির এই মুখপাত্রগণ নির্যাতিত নারীর পক্ষে না দাঁড়িয়ে মূলস্রোতের সাথে গা ভাসানো ‘ভিকটিম ব্লেমিংয়ে’ সক্রিয় হয়ে ওঠেন। আজ থেকে বছর দশেক আগেও যেখানে সমাজের বৈষম্য, নিপীড়ন অথবা নির্যাতনের প্রতিবাদে দেশের শিল্পী সমাজ ছিল একটি আশার জায়গা; সেখানে পরীমনির ঘটনাটি স্পষ্টত দেখায় যে বাংলাদেশের বর্তমান শিল্পী সমাজ সংগঠিতভাবে কোন এক অযাচিত জুজুর ভয়ে কেবল নীরবতাই পালন করে না; ক্ষেত্রবিশেষে কেউ কেউ অন্যায়ের স্বপক্ষে অনৈতিক ও বৈষম্যমূলক মতধারাকে উৎসাহিত করতেও তৎপর হয়ে উঠেন। বিষয়টি আরো বেশি দৃশ্যমান হয় যখন আলোচনার কেন্দ্রে থাকে কোন নারী অবমাননা অথবা ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়। তাইতো কখনো অনন্ত জলিলের কাছ থেকে আমরা নারীর পোশাকের ব্যাপারে পরামর্শ পাই, আবার মিশা সওদাগর বা জায়েদ খানের কাছ থেকে নারীর লাইফ-স্টাইল কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে দেখি।

লক্ষ্য করে দেখুন, এ সকল ক্ষেত্রই নারীকে শাসন করা বা সদুপদেশ দেয়ার চর্চা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। যার নেপথ্যে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা হয় যে নারী মাত্রই অজ্ঞ, যে কিনা নিজের ভালো-মন্দ বোঝে না, যাকে শেখাতে হবে বা শেখানোর প্রয়োজন তার কী করা উচিত এবং কী করা উচিত না। অর্থাৎ অলিখিত, অঘোষিতভাবেই নারীর অভিভাবক হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় সমাজের ক্ষমতাবান তথাকথিত পুরুষ অথবা পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত ও অনুগত নারীকূল।

আবার ফিরে যাই মূল প্রসঙ্গে, পরীমনি প্রথম যখন মিডিয়ার সামনে আসেন তখন যে বাক্যটি ভীষণভাবে আমার কানে বাজে সেটি হচ্ছে, “আমি সাধারণভাবে চেষ্টা করেছি, কেউ আমার কথা শোনেনি।” কী অসম্ভব নিগুঢ় সত্য লুকিয়ে আছে এই বাক্যে! সাংবাদিকদের মাঝেও খুব অদ্ভুতভাবে ফুটে উঠেছিল পরীমনির প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা; যেখানে তাকে কখনও ‘আপনি’ না বলে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করা, অথবা তাঁকে প্রশ্ন করার ঢংয়ের মাঝে লুকায়িত ছিল ভীষণমাত্রার অসহিষ্ণুতা। ধর্ষণের প্রচেষ্টায় আক্রান্ত নারীর প্রতি যে সংবেদনশীলতা দেখাবার প্রয়োজন তার ছিঁটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি প্রেস কনফারেন্সগুলোতে। ধর্ষণের প্রচেষ্টায় আক্রান্ত নারীর মানসিক ট্রমার বীভৎসতা অনুধাবনে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হবার চর্চা যদি একজন খ্যাতিমান তারকা না পান, ভাবুন তো এদেশের মফস্বল শহরগুলো অথবা গ্রামাঞ্চলের আমার আপনার মতো সাধারণ মেয়েদের বাস্তবতা কীরুপ আকার ধারণ করতে পারে?

এবার একটা ভিন্ন বিষয়ে দৃষ্টিপাত করি, আশা করি আমাদের মনোজগতে আমরা এখনো মুনিয়াকে ভুলে যাইনি। পরীমনি অথবা মুনিয়া উভয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুটি ভিন্ন ভিন্ন অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের চোখে পড়েছে। খেয়াল করে দেখুন, মুনিয়া এবং পরীমনি দুজনই হয় বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভির অথবা নাসির উদ্দিন ইউ আহমেদের অকথ্য, অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজের শিকার। একথা কাউকে বলতে শুনবেন না যে, তাদের এই গালিগালাজ করার অধিকার কারও নেই। কারণ নারীমাত্রই অশ্রাব্য কথোপকথনের বৈধতা। মধ্যবিত্ত নারীর সামাজিক গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি সামান্য পারিবারিক পরিসরেও, প্রতিদিন প্রতি নিয়ত ভীষণ অবলীলায় নারীকে ছোট করার জন্য, তাকে থামিয়ে দেয়ার জন্য তার গায়ে হাত তোলা বা তাকে গালিগালাজ করা এই সমাজের আদর্শ পারিবারিক সংস্কৃতিরই অখণ্ড অংশ।

এবার একটু দৃষ্টিপাত করা যাক ঘটনার পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার দিকে। ঘটনার পর থেকেই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরীমনির ব্যক্তিগত জীবন, তার সংসার জীবন, তার পুরানো সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তার তারকা খ্যাতির বিড়ম্বনার কারণেই হোক অথবা ‘ভিকটিম ব্লেমিং’ এর সুকৌশল রাজনীতির অংশ হিসাবে হোক একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী বরাবরই নির্যাতিত নারীর ব্যক্তিজীবন, পেশাগত জীবন, লাইফ-স্টাইল, পোশাক, আচরণ ইত্যাদি নানা বিষয়ের বাগাড়ম্বরপূর্ণ আলোচনা প্রদর্শনে উৎসাহিত থাকে। যার মধ্য দিয়ে ভিক্টিমকে সামাজিক মানদন্ডের আলোকে ‘আদর্শবান নারী নন’ এইরূপে প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রকৃত অর্থে এই আদর্শ বিষয়ক আলাপচারিতা আসলে কেবলমাত্র আপনার মনোযোগ ঘটনা থেকে সরিয়ে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার সুকৌশল রাজনীতিই শুধু নয়, বরং নারীর নির্যাতন ও ধর্ষণ প্রসঙ্গ এক ধরনের তামশিক ও স্বাভাবিকীকরণের একটি সুসংগঠিত কৌশল।

আবার গত কয়েকদিনে এটিও লক্ষ্য করা যায় যে, বিভিন্ন প্রগতিশীল ও সুশীল নাগরিকদের অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন “বেশ্যাকেও ধর্ষণ করার অধিকার কারও নেই।” এ বিষয়টি আশাব্যাঞ্জক যে একটি নেতিবাচক আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে হলেও কোন যৌন মজুরকে ধর্ষণ করার অধিকার কারও নাই, সে বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি হচ্ছে।

কিন্তু প্রসঙ্গ হলো, কেন এবং কী কারণে ঠিক এই মুহূর্তে ‘বেশ্যা’ সম্পর্কিত আগ্রহ বা আলাপ জরুরি হয়ে ওঠে? আপনার চিন্তায় কখন এবং কীভাবে কোন নারীকে ‘বেশ্যা’ বলে সম্বোধন করার বৈধতা অর্জন করা হয় সেটি একটু ভেবে দেখুন। এই ‘বেশ্যা’ কি কেবলই যৌন মজুরদের নির্দেশক? নাকি তথাকথিত কল্পিত আদর্শ নারীর ছাঁচে যে বা যাকে যখনই ফেলা সম্ভব হয় না তাকে আক্রমণের হাতিয়ার? তাই ‘বেশ্যা’ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে পোস্টারটি ঘুরে বেড়াচ্ছে তার পেছনে লুকোনো মননশীলতার অসল রুপটি কী? এটি কি সমাজের তথাকথিত যৌন মজুরদের যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে অবস্থান? নাকি প্রচলিত আদর্শ নারী চরিত্রে যে বা যারা পড়ে না তাদের সকলকেই ‘বেশ্যা’ তকমা লাগানোর রাজনৈতিক প্রয়াস?

পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বরাবরই নানা রকম রাজনীতি করে যুগ যুগ ধরে নারীকে দমিয়ে রেখেছে, নারীর প্রতি দমন-নিপীড়ন, নির্যাতিত নারীর প্রতি অবজ্ঞা অবহেলা প্রদর্শন। এসবকিছুর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো এই ধরনের ‘ভিকটিম ব্লেমিং’ অথবা ‘ওভার এন্থুসিয়াজম’। দয়াপূর্বক উভয় প্রকার কার্যকারিতা বিষয়ে সচেতন হোন। অন্যথায় নিজের অজ্ঞাত ভুলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার তথাকথিত আদর্শগত চর্চার টিকে থাকার সুকৌশল রাজনীতিতে ও আদর্শবান নারী চরিত্রের কল্পিত নির্মাণে আপনি এবং আমি নারীর প্রতি নিপীড়নমূলক সমাজ নির্মাণে সক্রিয় শরিকদার হয়ে উঠব।

স্নিগ্ধা রেজওয়ানা
শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.