সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্তের পাঠক প্রতিক্রিয়া

আসলাম আহমাদ খান:

“ছোটদের বড়দের সকলের
গরিবের নিঃস্বের ফকিরের
আমার এ দেশ সব মানুষের, সব মানুষের।
হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, দেশ মাতা এক সকলের।।”

মুক্তিযুদ্ধের সময় রচিত কালজয়ী এ গানটি শুনেননি- এমন মানুষ বাংলাদেশে বসবাস করেন বলে আমার মনে হয় না। এটি শুধু গান নয়, বাংলার মানুষের হৃদয় থেকে উৎসারিত কথামালা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গানের সুর ও কথামালায় অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। দেশ মাতৃকাকে শৃঙ্খলমুক্ত করার সে যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ছিলো সামনের কাতারে। তারাও রণাঙ্গনের যোদ্ধা। নয় মাসের যুদ্ধে, তিরিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে সত্য, কিন্তু সবচে বেশী মাসুল দিতে হয়েছে নারীদের। পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী ধর্ষণের মতো পৈশাচিকতাকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাদের জিঘাংসা আর পৈশাচিকতার সবটুকু গেছে নারীর উপর দিয়ে।

পাকিস্তানীদের আমরা বিতাড়িত করেছি সেই ৫০ বছর আগে। দেশে তো আর এখন কোন বর্গী নেই, নেই কোন উপনিবেশিক শাসন। রক্তমূল্যে কেনা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক আমরা। সংবিধানের ২৮ এর ১ এবং ২ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট লিখা আছে, “রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী–পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন।”
“কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী–পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।”

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঝাণ্ডাধারী রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংসদদের সমন্বয়ে গঠিত সংসদীয় কমিটি নারী ইউএনও-দের গার্ড অব অনার নিষিদ্ধ করে পুরুষ কর্মকর্তাদের দিয়ে গার্ড অব অনার প্রদানের যে বিকল্প প্রস্তাব করেছেন, তা কেবল সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীই না, নারীর জন্য প্রচণ্ড অবমাননাকর, নৈতিকতার জন্য কলংকজনক। ভুলে গেলে চলবে না এ দেশ নারী-পুরুষ সবার।

জাতির অভিভাবকদের(?) কে বোঝাবে যে ইউএনও একটা প্রাতিষ্ঠানিক পদবীর নাম। এটার কোন পুংলিঙ্গ- স্ত্রী লিঙ্গ নেই। তাছাড়া নারীরা এ পদে কোন বিশেষ কোটায় বা কারো আনুকুল্য নিয়ে আসেনি; যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এ পদে আসীন হয়েছে।

আচ্ছা, আপনারা এতো কিছু বোঝেন, গার্ড অব অনার এবং জানাযার পার্থক্য বোঝেন না? কে আপনাদের বোঝাবে- রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এক বিষয় নয়। এই জ্ঞান-গরিমা নিয়ে আপনারা ১৭ কোটি মানুষের শাসক হয়ে বসে আছেন! নাকি হেফাজতিদের মূর্তি আর ভাস্কর্যের পার্থক্য বোঝাতে বোঝাতে হেফাজতের প্রেতাত্মাই আপনাদের ঘাড়ে ভর করেছে?
আপনারা যখন শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার বন্দনা করেন, তখন তো এ চিন্তাটি আপনাদের মাথায় আসে না যে, উনি একজন নারী? তাহলে ইউএনও-দের ক্ষেত্রে কেন?
মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী ও পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যখন যুদ্ধ করেছে তখন তো রাজাকার আলবদর ছাড়া কেউ বলেনি যে, নারীর হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া নাজায়েজ?

তাহলে কি আমরা ভূতের পায়ের মতো পেছনের দিকে হাঁটছি? নাকি দিনে দিনে ক্লাউনের দেশে পরিণত হচ্ছি! একটা ঘটনা শেষ হতে না হতেই নতুন ঘটনার জন্ম হচ্ছে। এবং বলাই বাহুল্য, সমস্ত ঘটনাই নেতিবাচক। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের এক তারকা ক্রিকেটার স্ট্যাম্পে লাথি মেরে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়া বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের নিয়ে হাস্যরস করছে। সে ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই, রাজনীতির তারকারা নারীর অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্থ করতে হাস্যকর এক সুপারিশ করেছেন।

জাতীয় সংসদ কোন খেলার মাঠ নয়। সংসদীয় কমিটিকে ভুলে গেলে চলবে না, সংবিধান ও নৈতিকতা বিরোধী কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার দেশের জনগণ তাদেরকে দেয়নি। আপনারা যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তা আইন ও সংবিধান বিরোধী। বাংলাদেশের জনগণ তা মানবে না। কাজেই, দুর্গন্ধ ছড়ানোর আগেই সুপারিশটি প্রত্যাহার করা হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

১৫ জুন ২০২১
নিউ ইয়র্ক।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.