অর্পিতা শামস মিজান:
কী কষ্টের কথা যে কিছু আলাপ কখনই পুরাতন হয় না।
সেদিন একাত্তর টেলিভিশনে একটা টকশোতে ছিলেন নায়িকা পরীমণি। তিনি খুব স্পষ্টভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখয়েছিলেন যে চিত্রনায়িকা হিসেবে তিনি খোলা চিঠি লিখতে “বাধ্য” হয়েছেন কারণ সাধারণ নারী হিসেবে তিনি চেষ্টা করে ফল পাননি।
খুব আবেগঘন আবেদন ছিল। সেখানে রাসেল নামে একজন লিখেছে, পরীমণি আর অন্য মেয়েরা লিটনের ফ্ল্যাটে যাওয়ার সময় কেন কিছু মনে থাকে না। হাহা রিআ্যক্ট একগাদা। আরেকজন মন্তব্য করেছে, নায়িকা মানে বেশ্যা, তাদের আবার ধর্ষণ হয় নাকি!
অর্থাৎ সমাজ শিখিয়ে দিল ছেলেদের নিয়ন্ত্রণ কম, এটাই স্বাভাবিক, তাই মেয়েদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। মোদ্দা কথা হলো, আইন পাল্টাতে হবে। ডাক্তার ডায়াবেটিসের রোগীকে মিষ্টি খেতে নিষেধ না করে বরং ময়রাকে শাস্তি দিক যে কেন ব্যাটা ময়রা তুই মিষ্টি বানাস? তুই মিষ্টি না বানালেই তো রোগী মিষ্টি খাবে না।
কিন্তু একথা কেউ বলবে না যে, আমাদের দেশে যে পুরুষেরা কামুক হিসেবেই বড় হয়, কারণ সামাজিক প্রেক্ষাপটে সবাইকেই যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণের দীক্ষা দেয়া হয় না, স্বাভাবিক যৌন জ্ঞানার্জন করতে দেয়া হয় না, ফলে অনেক বিকৃত মানসিকতার মানুষ তৈরি হয়। অথচ যৌনতা সব মানুষেরই থাকে। মেয়েরা কি ছেলেদের প্রতি কখনও আকৃষ্ট হয় না? হয়। ৯০ এর দশকে কত মেয়ে নোবেলকে নিয়ে, শিমুলকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো। সালমান শাহ আজও কত মেয়ের স্বপ্নের নায়ক! এই পুরুষদের তো আর নারীরা হাতের কাছে পান না। তা বলে কতজন নারী সামনে যে ছেলে পেয়েছে তার ওপর হামলে পড়েছে? কতজন পুরুষ বলতে পারবেন তারা মেয়েদের যৌন লালসার শিকার হয়েছেন? পুরুষাঙ্গকে (পুরুষের সম্মতির বিরুদ্ধে) স্পর্শ করে কতজন নারী নিজের যৌনসুখ মেটান?
না মেয়েরা পুতুল, তাদের চাহিদা থাকতে নেই। কিন্তু আমার যে নারীরা আসেক্সুয়াল, মানে যৌন চাহিদা আসলেই নেই, তেমন নারী আবার পুরুষের চোখে খুঁতওয়ালা নারী। সমাজে মেয়েদের স্বাধীনতা অনেক কম। মেয়েদের পদে পদে হুকুম দেয়া হয়। মেয়েরা চাইলেও তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে না।
কাজেই বিকৃত মানসিকতার কথা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে কেবল দেখানো হয় যে পুরুষেরা তো এমন করবেই, মেয়েদেরই নিজেকে সামলে চলা উচিৎ। সম্মতি? সে আবার কী? সম্মতি খালি ছেলেরাই দিবে। ছেলেরা সব দুধের শিশু, তারা কিছু বুঝে না। মেয়েদের দায়িত্ব নিয়ে চলতে হয়। কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে মেয়েরা যখন “না” বলে, তখন আবার সেই না-কে নাকচ করতে এসব দুধের শিশুর সমস্যা হয় না। কোন মেয়ের গায়ে হাত দেয়া উচিত, সে বেলায় এই অবুঝ পুরুষ ভারী সেয়ানা।
আসলে সবকিছুর গোড়ায় হলো আমাদের চিন্তাধারা, যা ছোট থেকে একাধারে পরিবার, সমাজ আর ধর্মের তল্পিবাহকেরা শেখান, যে
১. মেয়েদের সামলে চলতে হবে। পুরুষের ফিত্রত এমনি। কাজেই মেয়ে তুই নিজের ইজ্জত সামলা।
২. মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়, যে মেয়ের ইজ্জত তার শরীরে, তার কাজে না, অর্জনে না, সামাজিক প্রতিষ্ঠায় না।
৩. মেয়ের ইজ্জত তার একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ “জিনিস”. শারীরিকভাবে পবিত্র হওয়ার তকমা না থাকলে তুমি যে হনু হও, তোমার ইজ্জত নাই, মানে তোমার কোন অর্জন কোন কৃতিত্ব কোন পরিচয় নাই।
৪. কাল একজন বললেন, এই ঘটনা বিপাশা বা মৌ বা শাবানার সাথে হলে পাবলিক রিয়াকশন আলাদা হতো। কিন্তু পরিমণি নিজেকে নাকি এতো “যৌনাবেদনময়ী” করে ফেলেছেন যে তিনি জনসমর্থন পাবেন না।
৫. এক বিচারককে চিনি যিনি বলেছিলেন জিন্স পরলে তো মেয়েরা ধর্ষণ হবে। আরেকজন বলেছিলেন, (মফস্বল শহরে) মেয়ে মানুষের এতো ঘুরাঘুরি কেন, তুমি হাউসওয়াইফ, সেভাবে চলো, নয়তো স্বামী পেটাবে না তো কী করবে!
বাহ! জনসমর্থন পাওয়ার জন্য আমি কোন অপরাধের শিকার তা জরুরি না, জরুরি হলো আমি কেমন দেখতে, আমার অভিনীত মানে মিথ্যা জল্পিত চরিত্র কেমন, সেসব অলীক জিনিস।
এই না হলে আমাদের সমাজ!