সাবরিনা স. সেঁজুতি:
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই পারিবারিক সহিংসতার শিকার যেকোন ব্যক্তিকে তার নিজ গৃহ বা পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়। সুইডেনই সম্ভবত প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র দেশ যেখানে ১৯৮৬ সালে গড়ে উঠেছে পারিবারিক সহিংসতায় সংশ্লিষ্ট পুরুষদের জন্য ক্রাইসিস সেন্টার।
এই উদ্যোগের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল – যেসকল নির্যাতন বা পারিবারিক সহিংসতার কেইসে শিশু জড়িত, সেই সকল কেইসের অভিযুক্ত পুরুষকে পরিবার থেকে দূরে রাখা এবং পাশাপাশি শিশুকে তার চেনা-পরিচিত পরিবেশে একটি স্বাভাবিক জীবন-যাপনে উৎসাহী করা।
এরকম একটি সেন্টার সুইডেনের সেন্ট্রাল গোথেনবার্গে অবস্থিত- যেখানে পুরুষরা কেইস চলাকালীন অবস্থান করেন এবং প্রয়োজনে আগ্রাসী আচরণ বা মনোভাব ও ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের উপর বিভিন্ন মনোবৈজ্ঞানিক সেশন ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। অপরাধী পুরুষ ছাড়াও যেসকল পুরুষ বিবাহবিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তাদের একটি বড় অংশ এখানে অবস্থান করে থাকেন।
এই সেন্টারটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তখন এটা ছিল বিশ্বের একমাত্র সেন্টার যেখানে নির্যাতিত নয়, বরং নির্যাতনকারীর জন্য নানা ধরনের সেবা প্রদান করা হতো। সেন্টারটিতে অস্থায়ী বাসস্থানের সুবিধা শুরু হয় ২০১০ সালে। বর্তমানে সেখানে চারটি এপার্টমেন্ট আছে, যেখানে নির্যাতন বা সহিংসতায় জড়িত পুরুষেরা অবস্থান করছেন।
অভিযুক্ত পুরুষ এখানে সর্বোচ্চ চার মাস অবস্থান করতে পারেন যতক্ষণ পর্যন্ত সোসাল সার্ভিস কোন সিদ্ধান্তে উপনীত না হয়। এই সময়ে অভিযুক্তকে নিয়মিত ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের উপর সেশনে অংশগ্রহণ করতে হয় এবং ১৫ দিনে একবার একজন সোশ্যাল ওয়ার্কারের সাথে দেখা করা বাধ্যতামূলক।
গবেষণায় দেখা যায় পুরুষের ক্রোধ বা আগ্রাসী মনোভাবের পেছনে তার বেড়ে ওঠা, অক্ষমতা, নিরাপত্তাহীনতা এবং উদ্বেগ কাজ করে। যেসকল পুরুষের শৈশব কেটেছে পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে তাদের মধ্যে আগ্রাসী আচরণে লিপ্ত হবার আশংকা বেশি। পাশাপাশি যারা মাদকাসক্ত তাদের মধ্যেও আক্রমণাত্মক মানসিকতা প্রবল। এই সকল মানসিক অস্থিতিশীলতা সঠিক কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে কমিয়ে আনা সম্ভব। যেহেতু এই সকল অভিযুক্ত পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য আশঙ্কাজনক, তাই তাদের মধ্যে আত্মঘাতী চিন্তাও প্রবল। কাউন্সেলর এবং সোশ্যাল ওয়ার্কারের সাথে নিয়মিত সেশন তাই তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ফলপ্রসূ।
এখন পর্যন্ত সুইডেনের এই এপার্টমেন্টগুলোতে প্রায় ৯০ জন পুরুষ সেবা লাভ করেছেন। অভিযুক্ত পুরুষদের সেন্টারে পাঠাবার আগে সোশ্যাল ওয়ার্কাররা একটা বিষয় নিশ্চিত করেন- তা হলো, সেন্টারে থাকার সময়ে যেন এই পুরুষেরা কোনভাবেই পরিবারে ফিরে গিয়ে আবার কোন ধরনের অপরাধ বা নির্যাতনমূলক ঘটনায় জড়িয়ে না পড়েন। ৭০ শতাংশ অপরাধী পুরুষ সেন্টার থেকে সেবা গ্রহণের পর, ফিরে গিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং পরিবারের সাথে একটি সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
যদিও অপরাধী পুরুষদের জন্য এই সার্ভিস বা সেবার বয়স প্রায় ৩৫ বছর, সামাজিকভাবে এর গ্রহণযোগ্যতা এখনও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের মতো জনপ্রিয় নয়। সুইডেনের ২৯০ টি মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৯টি-তে এ ধরনের সেন্টার গড়ে উঠেছে। সমাজের মানসিকতা পরিবর্তন এবং সেন্টারগুলোর উপকারিতা সম্পর্কে সাধারণের জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে হয়তো এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো সম্ভব।
সূত্র: দি লোকাল এবং ক্যালিফোর্নিয়া স্টেইট ইউনিভার্সিটি।