পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন নিয়ে আমার দুটো কথা

জান্নাতুন নাহার:

নিজের গুণগান করতে বসতে হবে নিজেকেই এ কোনদিন ভাবিনি আমি। আপনারা যারা দুর্নামের বোঝা চাপিয়েছেন, হৃদয় যদি এর ভার সইতে না পারে তাই আগে ভাগেই দু’কলম লিখতে বসা। আমার স্বামী রোজ ক’ব্যাঞ্জনে ঢেঁকুর তোলে সে গল্প আজ বলবো না। আপনারা যারা আমাকে অসংসারী তকমা দিয়েছেন, তারা তো আমার প্রতিবেশী নন। আদর আপ্যায়ন জোটেনি বলেই যে ক্রোধের বসেই এ সুসম্ভাষণ, তাও বলবো না। আজ বরং আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু কথা বলি।

প্রথম গর্ভপাতের পর যখন আমার ঋষভ এলো, অনেক অনুরোধেও একটি বেবি শাওয়ার করিনি। অথচ কী আকাঙ্খা ছিল- আমি বসে আছি আর কেউ আমাকে বসিয়ে কয়েকপদ বেড়ে খাওয়াচ্ছে, অন্তত একটি দিনের জন্য এই ভূভারতের রাজরানী আমিই। দাসীবাঁদী সকলেই সেদিন ব্যস্ত কীসে মহারাণীর সুখ! আমার ভয় ছিল একটিই- সুখের পর যদি চিরস্থায়ী দুঃখ এসে ধরা দেয়, তখন সইতে পারবো তো!

৩৫ উইকের সময় সিদ্ধান্ত নিলাম স্কুলে আর যাবো না। আমার স্বামী আসবে আরও এক মাস পর। মাসের বাজার করে ফেললাম। ত্রিশ-চল্লিশ কেজি বাজার একা দোতালায় টেনে তুললাম। সেদিন যখন একটি খাড়া পর্বতশৃঙ্গ অতিক্রম করার মতোই সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ কষ্টেশিষ্টে পেরোচ্ছিলাম, শুধু মনে হচ্ছিল- এই বুঝি ঋষভ এক্ষুণি বেরিয়ে আসবে, আর বলবে- “মা, আমার এ অপরিপুষ্ট চোখে এ পৃথিবীর এতো আলো সইতে পারবো না আমি। আমি আসবো, আসবো তোমার কাছে, আমায় আরেকটু সময় দাও, দয়া করে এরকম হিঁচড়ে বের করো না আমায়, তুমি কী জানো না, তোমাকে দেখার অপেক্ষায় সৃষ্টির শুরুর দিন থেকে কি উদগ্রীব হয়ে আছি আমি”!

বাজার তোলা শেষে আমি যখন সেই কাঞ্চনজঙ্ঘায় পৌঁছে জয়ের আত্মতৃপ্তিতে শ্বাস নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়েছি, পরদিন আমার ব্যস্ত স্বামী এলো। অপরাধীর মত নত মুখে বললো- “তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে এলাম”। রাতে অসাবধানতায় আমার হাতের একটি হাড় আরেকটি হাড়ের উপর উঠে যেতো। ঋষভের বাবা বেবি মনিটরে দেখতে পেতো, শুনতে পেতো-আমার চিৎকার। ডাক্তার এক্সরে করে বললো- হাতের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে রিস্ট ফ্রাকচার হয়েছে, অর্থোপেডিক্স এর কাছে রেফার করলো। ঋষভের জন্মের পর যখন আমার দ্বিতীয় গর্ভপাত হলো, বুকে অসম্ভব ব্যথা হতো, যেন এক্ষুণি দমবন্ধ হয়ে মারা যাবো। ভাবলাম, এ ভাঙা হৃদয়ে কে আর অনুপ্রবেশ করবে! নিশ্চয়ই আর্টারি ব্লক। ডাক্তার সব টেস্ট করিয়ে বললেন- “তোমার হৃদয়টা একেবারেই নির্ভেজাল, কেউ ভালো-টালো বাসেনি বুঝি কোনদিন! বরং দেখছি অভিমানে পাঁজরটাই সরেছে কিছুটা”- রিবস ডিসপ্লেসমেন্ট, দীর্ঘদিন একভাবে শোওয়ার কারণে। নারী ডাক্তার পরিস্কার দোষারোপও করলেন- “কী অক্ষম মা তুমি! ঘুমের মধ্যে স্তন্যপানের এ কু অভ্যাস! বাচ্চাকে দেখি শেখাতে পারোনি কিছুই”।
আমি বলতে পারিনি সেদিন আমার কথা ডাক্তারকেও, বাধ্য ছাত্রের মতো শুনে গেছি।

আর কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না, সব কি লেখা যায়! আর ব্যক্তিগত এসব লেখা কি ভালো দেখায়! আচ্ছা, আপনারা এটাকে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বলছেন তো! সে বলুন, গালভরা নাম নিয়ে দায়মুক্তি ঘটান। যারা মা হয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন নিজেকে মহিমান্বিত কেউ প্রমাণ করতে এই লেখা লিখছি না। কত কত কঠিন ঝড় ঝাঁপটা আপনাদের নীরবে সামলে নিতে হয়েছে, আমার এ প্রলাপ সেখানে মৃদু আশ্বিনী বাতাস। আর নিশ্চয়ই শুনতে হয়েছে – বাবা এইটেই তো সমাজের নিয়ম, ঈশ্বরের নিয়ম।

প্রিয় ঋষভ, তোমাকে দেখলে শুধু ঐ দুটি লাইনই আমার মনে হয়- “এত ভেঙ্গে চুরে আর কাউকে ভালবাসিনি আমি এর আগে”। মায়ের চোখের জলের আয়নায় তুমি কি দেখতে পাও তোমার প্রতিবিম্ব! কত কত রাত মায়ের চোখ থেকে নির্বাসিত হয়েছে ঘুম। মায়ের শরীরে ইনসুলিনের প্রতিটি দাগ, সি সেকশনের ঐ কালো রেখা, জেনে রেখো এ তোমার মায়ের শরীরের ক্ষত নয়, এ ক্ষত এই সমাজের মনস্তত্বের ক্ষত। অনেক বড় হও তুমি। তারপর একদিন এ সমাজটা ভেঙে এক ভুল রেলগাড়িতে উঠে পড়ব তুমি আর আমি। জারুল শিরীষের বৃক্ষ কেটে ছুটবে আমাদের ট্রেন। শেষ বিকেলে হাওয়ায় মিশে তুমি আমায় বলবে- “মা দেখো, ঐ তো দূরে পাহাড় আর সেখান থেকেই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে এক মস্ত সূর্য”।

লেখক: জান্নাতুন নাহার, পিএইচডি

শেয়ার করুন: