সুপ্রীতি ধর:
গতকাল থেকে দেশ তোলপাড় আবার। তিন ঘণ্টার এক পরীক্ষা দিতে ঢুকবার ঠিক আগ মুহূর্তে মোবাইল অফ করতে গিয়ে খবরটি দেখি। বিস্তারিত পড়ার সুযোগ পাইনি তখন, কিন্তু পরীক্ষাটা আমার আসলে আর দেয়া হয়ে উঠেনি। সম্ভব ছিল না। সেই থেকে কী এক অস্থির সময় পার করেছি, শরীর অবশ হয়ে আসছিল রাগে-ক্ষোভে-কষ্টে। হতে পারে সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম আমাদের খুব কাছের মানুষ বলেই আমাদের অনেকেরই একরকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে, আবার যারা তাকে চেনে কেবলই একজন সাংবাদিক হিসেবে, তাদের প্রতিক্রিয়া একটু হলেও ভিন্ন হবে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাদের প্রতিক্রিয়াটা হয়েছে একটা অন্যায় সংঘটিত হওয়ার কারণে। রোজিনা নামের একজন সাংবাদিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার কারণে।
বিদেশে থাকার সুবিধা যেমন আছে, অসুবিধা তার চেয়েও বেশি। যখন-তখন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাস যাদের, অসুবিধাটা তাদেরই বেশি। কাল মধ্যরাতেও যখন দেখছিলাম শাহবাগ থানার সামনে কতশত পরিচিত মুখ অবস্থান নিয়েছে, রোজিনাকে ‘রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির কবল’ থেকে মুক্ত করে আনার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, মনটা আমার সেখানেই পড়েছিল। বার বার মনে হচ্ছিল, এতো দেরি হচ্ছে কেন ওর বাসায় ফিরতে! ওর যে এতো রাতে ১০ বছর বয়সী মেয়ে আলভিনার কাছে ফিরে আসার কথা! যে মেয়েটা মায়ের জন্য রাত জেগে বসে থাকে, মায়ের সাথে কথা না বলে যে মেয়েটা ঘুমায় না, মাকে গান না শুনিয়ে যে মেয়েটার শান্তি হয় না, সেই মেয়েটার কাছেই তো ওর ফিরে আসার কথা। তা যত রাতই হোক। আলভিনার মুখটা ভেসে উঠছিল মনে। কী সুন্দর করে হেলেদুলে গান করে, রোজিনা যখন এই গানগুলো পোস্ট করে ফেসবুকে, সে তখন আর প্রবল প্রতাপশালী অনুসন্ধানী সাংবাদিক থাকে না, একজন মা হয়ে যায়। খুব সাধারণ একজন মা, যার মনের কোণে একজন শিশুর জন্য আকুতি ছিল দীর্ঘ বছর, অবশেষে সে যখন কোল আলো করে এলো, সেই থেকে আমরা তার প্রতিটি মুহূর্ত চিনি, জানি। কত কত কথা যে রোজিনা লিখে তার মেয়েকে নিয়ে, ও তার সুখের ভাগটা দিতে চায় আমাদের, আমরাও তা ভাগাভাগি করে নিই।
সাগর-রুনিকে যখন হত্যা করা হয় ২০১২ সালে, রোজিনা তখন হাসপাতালে, মেয়ের জন্মের অপেক্ষায়। কী যে অস্থির সময় কেটেছে ওর। আমরা তখন রাস্তায়, ও বার বার জানতে চাইতো কী করছি আমরা! ছটফট করছিল প্রিয় বন্ধুর এমন প্রয়াণে। অবশেষে ১৪ ফেব্রুয়ারি জন্ম হয় আলভিনার। সেই ক্ষণটি এখনও মনে আছে, যদিও তখন আমরা ভয়াবহ শোকে মুহ্যমান আর ক্ষুব্ধ সাগর-রুনিকে হারিয়ে। ওরাও যে হৃদয়ের কাছটিতে ছিল বহু বছর ধরে। সাগর আমার সহকর্মি ছিল, আর রুনি ছিল বিশেষ আদরের। মূলত রুনিদের সময়ই একদল মেয়ে সাংবাদিক কাজ করতে আসে, এবং দারুণ মেধার পরিচয় দেয় প্রত্যেকটি মেয়ে। কেউ কারও চেয়ে কম নয়। আমরা যারা কাজ করতে গিয়ে ভীষণ রকমের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছিলাম শুধুমাত্র ‘মেয়ে’ হওয়ার কারণে, সেই একদল মেয়ে যেন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল সেই প্রতিবন্ধকতা, মুখের ওপর প্রতিবাদ ছুঁড়ে দিয়ে ওরা সব কয়জনই নিজেদের জায়গা পোক্ত করেছিল, ফলে বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিল আরও মেয়েদের এই পেশায় আসার পথ। রোজিনা সেই তাদের একজন, অন্যতম উদাহরণ। রোজিনা জানে, কীভাবে নিউজরুমকে মোকাবিলা করে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, কীভাবে সচিবালয় ঘুরে শত শত রিপোর্ট মাটি খুঁড়ে তুলে আনতে হয়। কেবল সেখানেই যে সে লড়াই করে রিপোর্টের মালমশলা নিয়ে আসে তাই না, সেই রিপোর্ট তৈরির পর সেটিকে পত্রিকায় স্থান দেয়ার জন্যও একই রকম লড়াই চালাতে হয় প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মিডিয়া হাউজে, তা সে যতোই প্রগতিশীল হাউজ হোক না কেন, নারী প্রশ্নে সবাই এক।
আমরা যারা সাংবাদিকতা করেছি কম-বেশি, সবাই এই প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত। কিন্তু সবাই টিকতে পারে না, কেউ কেউ হাল ছেড়ে দেয়। রোজিনা বেশ শক্তপোক্ত অবস্থান তার চারপাশে তৈরি করে নিয়েছে নিজের যোগ্যতাতেই। তাই তো আজ যখন তাকে আদালতে তোলা হলো, শত শত পুলিশ তাকে যেভাবে ব্যারিকেড দিয়ে নিয়ে গেছে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে যেন কোন ভয়াবহ, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীকে বুঝি নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রোজিনার মাথা উঁচু করে থাকার দৃশ্যটা আমাদের যেমন কাঁদিয়েছে, তেমনি গর্বেও বুক ভরে গেছে। এভাবেই মাথা উঁচু করে থাকতে হয়। যে সৎ হয়, সে এমনই নির্ভীক হয়।
কিন্তু প্রিজনভ্যানে লোহার রডগুলো ধরে দাঁড়িয়ে থাকা রোজিনার ছবিটা হজম করতে কষ্ট হয়েছে আমার। যদিও তার দৃঢ় দৃষ্টি আবারও সেই গর্বিতই করেছে, তথাপি সেই চোখে আমি যেন তার কন্যাটির জন্য আকুতিও দেখতে পেয়েছি। হয়তো সে এতো এতো মানুষের ভিড়ে খুঁজেছে সেই পরমপ্রিয় মুখটি, যে মুখটি না দেখলে একটা দিনও থাকতে পারে না, যে মেয়েটার গন্ধ না পেলে তার মায়ের মন শান্তি পায় না। যে মেয়ের মা ডাক না শুনলে অস্থির হয়ে যায়। রোজিনার চোখ দুটি যেন সেই আলভিনাকেই একবার দেখতে চেয়েছে কারাগারে যাবার আগমুহূর্তে। যে কারাগারের অনিয়ম আর দুর্নীতি নিয়ে তার দিনের পর দিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেই কারাগারেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
জানি না কেমন আছে রোজিনা সেখানে। কেমনই বা আছে আলভিনা মা আমাদের!
শুনেছি, টিভিতে ও দেখে ফেলেছিল তার মাকে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে। বার বার জানতে চাইছিল কী হয়েছে মায়ের? তাকে বলা হয়েছে, মা অসুস্থ, কয়েকদিন পর আসবে। আলভিনা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করে আছে মায়ের জন্য। অসুস্থ মা সুস্থ হয়েই ফিরে আসবে তার কাছে। ও যে জানে না একটা অসুস্থ দেশের ততোধিক অসুস্থ পরিবেশে সবাই হাঁসফাঁস করছে, তার মাও যে সেই অসুস্থ পরিবেশের শিকার হয়ে গেছে, এটা ও জানে না। তবে জানবে। সাগর-রুনির সন্তান মেঘ যেমন জানে, জেনে গেছে বিগত বছরগুলোতে, আলভিনাও জানবে তার মায়ের কী হয়েছিল একদিন! হয়তো তখন গর্বও হবে তার মায়ের জন্য, মায়ের মাথানত না করার জন্য, এই দু:সময়ে বেচাকেনার জগতে মায়ের বিক্রি না হয়ে যাওয়ার জন্য।
ফিরে আসুক রোজিনা তার আত্মজা আলভিনার কাছে, এই কামনাই করছি আজ মনেপ্রাণে। মুক্তি পাক সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম। মুক্ত হোক গণমাধ্যম।