বিবাহবিচ্ছেদ মানে কি সবসময় সম্পর্কচ্ছেদ?

ফাহমি ইলা:

তাহসান-মিথিলা লাইভে এসেছেন ইভ্যালির নিমন্ত্রণে, দুজনই ইভ্যালির সাথে সম্পৃক্ত। তাহসান ইভ্যালির চিফ গুডনেস অফিসার এবং মিথিলা ব্র্যান্ড এম্বাসাডর। লাইভের নিচের কমেন্ট পড়তে পড়তে বরফ ঠাণ্ডা পানিতে চুমুক দেই, বোঝার চেষ্টা করি।

প্রথমত, এই লাইভে আসার বিষয়টি কারও কারও কাছে ‘নাটক’ ঠেকেছে। কারণ এদের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদ মানে যোগাযোগ, শ্রদ্ধা, সম্মানের মাঝে স্পষ্ট দেয়াল তৈরি করা। বিবাহ বিচ্ছেদের পর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ বজায় রাখার কোনো উদাহরণ তারা আজ অবধি বাংলাদেশে দেখেনি কিংবা দেখলেও সেটাই তাদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকেছে। তাই এটি একটি ইভ্যালির সাজানো নাটক, খুব কষ্ট করে বুকে পাথর বেঁধে তাহসানকে এই লাইভের আসরে বাধ্য হয়ে বসতে হয়েছে। কেউ কেউ বলছে শুধু সন্তানের কথা চিন্তা করে তাহসানের এ স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, মিথিলা এ বিশ্বে গণহত্যা, ধর্ষণ, যুদ্ধ, বোমাহামলা, টেরোরিস্ট এট্যাক, নির্যাতনের চেয়েও বড় অপরাধ করেছেন। তিনি নারী হয়ে প্রথম স্বামী জীবন্ত থাকাবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, বিয়ে করেছেন কাঁটাতারের বেড়া টপকে ভিন্ন দেশে ভিন্ন ধর্মে। বিয়ের পর দুঃখে আছেন বা প্রাক্তন স্বামীকে মিস করছেন বা তার অপরাধবোধ হয়েছে এমনকিছুই প্রকাশ পায়নি। এদিকে তাহসান মিথিলাকে এতই ভালোবাসেন যে আজ অবধি বিয়ে করেননি। তাই তাহসানের বিয়ে না করা থেকে চাপদাঁড়ি রাখা, মুখ গম্ভীর থাকা থেকে পাঞ্জাবি পরা সব দোষ মিথিলার ওপর বর্তায়। মিথিলার সবচেয়ে বড় দোষ, তিনি এ বঙ্গে জন্মে বঙ্গের মুখে চুনকালি মেরেছেন।

তৃতীয়ত, তাহসান খুবই সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পাওয়ার মত কাজ করেছেন লাইভে এসে। কারণ বিচ্ছেদের পর তিনি প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে এক টেবিলে বসার মতো এক লাইভে বসতে পেরেছেন। এতে তিনি উদার হৃদয়ের প্রমাণ দিয়েছেন। তাকে স্যালুট জানিয়েছে ভক্তরা এবং এ লাইভের পর তার ভক্ত বেড়ে গিয়েছে আরও।

বর্তমান দুনিয়ায় Misogyny ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি প্রায় সকল সংস্কৃতির অংশ। তথাকথিত উন্নত বিশ্বের দেশগুলো আইনে কিংবা নৈতিকতার চর্চায় এ থেকে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করছে বটে। মিসোজিনি বলতে সোজা ভাষায় নারীর প্রতি বিদ্বেষ এবং বৈষম্যকে বোঝায়। এ বিদ্বেষ প্রকাশ হতে পারে সহিংসতা, বৈষম্য, সামাজিকভাবে বর্জন, বঞ্চিত করা, এন্ড্রোসেন্ট্রিক হওয়া, হেয় করা কিংবা অবজেক্টিফাই করার মাধ্যমে। মিসোজিনির বিপরীত শব্দ হচ্ছে ফিলোজিনি, যার মানে নারীর প্রতি ভালোবাসা, আকর্ষণ কাজ করা। কথা হচ্ছে, বিপরীত শব্দ হলেও নারীর প্রতি ভালোবাসা কাজ করলেও সেখানে মিসোজিনির আচরণ বিদ্যমান থাকতে পারে৷ আমাদের চিন্তার কাঠামোতে নারীর প্রতি যে প্রত্যাশা তৈরি থাকে সে বৃত্ত থেকে সে বেরিয়ে পড়লে তাকে গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এবং বর্জন না করেও তাকে নানাভাবে কোণঠাসা করা যায়৷ পুরুষের ক্ষেত্রে একই বিষয় ঘটলেও কনসিকোয়েন্সের মাত্রা, ধরন ভিন্ন হয়।

সাইবার বুলিং, নেতিবাচকতা প্রকাশের কারণস্বরূপ তাহসান বলছেন-‘আমরা এটা করি কারণ, আমরা নিজেদের হীনমন্যতাটা অন্যের ওপর প্রক্ষেপণ করতে চাই।’ বুঝতে পারলে এটা খুব সাধারণ সহজ কথা। এবং তিনি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বলছেন- ‘আমরা হয়তো আলাদা হয়ে গেছি, কিন্তু আমরা সসম্মানে পাশাপাশি বসে একে অপরের সাথে কথা বলতে পারি।’ মিথিলা বলছেন-‘We should be a positive example.’

কথাটুকু কে কতটুকু নিতে পেরেছে কে জানে, তবে শিখতে দোষ নেই। সমাজ-সংস্কৃতি যেহেতু পরিবর্তনশীল সেহেতু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সুস্থ চর্চার মধ্য দিয়ে একদিন আমাদের কাছেও সুন্দর-অসুন্দরের সংজ্ঞার পরিবর্তন হবে, সুন্দর স্বাভাবিক এবং অসুন্দর অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে। সেদিন আমরা বুঝতে শিখবো বিদ্বেষ, ঘৃণা, হীনমন্যতা, প্রতিহিংসা, নির্যাতন, বৈষম্যকে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক ভাববার মত ভুল আমরা করেছিলাম। একদিন আমরা উপলব্ধি করতে পারবো শুধুমাত্র আমাদের বৈষম্যের চর্চার ফলে জীবনকে সুস্থভাবে উপভোগ করতে পারা সম্ভব হয় না।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.